গাজায় বিতরণ করা বিতর্কিত সংস্থা জিএইচএফের ত্রাণের বাক্সে কী আছে
Published: 31st, May 2025 GMT
চার কৌটা টুনা মাছ, কয়েক প্যাকেট স্প্যাগেটি ও এক লিটার তেল।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মধ্যাহ্নের প্রচণ্ড গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর কপালে যেসব খাদ্যসামগ্রী জুটেছে, এটি তারই একটি নমুনা।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল পরিচালিত বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) দাবি করেছে, তারা গত মঙ্গলবার থেকে অসহায় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ১৪ হাজার বাক্স খাবার বিতরণ করেছে। ত্রাণ সংস্থাগুলোর মতে, চলমান গণ-অনাহার মোকাবিলায় এই সংখ্যা একেবারেই যৎসামান্য।
গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট একটি সংগঠন। গাজা উপত্যকায় ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নিতে সংগঠনটিকে ইসরায়েল অনুমোদন দিয়েছে।
নতুন এই ত্রাণব্যবস্থা খাদ্য বিতরণ–ব্যবস্থাকে মাত্র কয়েকটি কেন্দ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। এসব কেন্দ্র আবার পাহারা দেন বেসরকারি মার্কিন নিরাপত্তা কর্মীরা। এ ব্যবস্থা জাতিসংঘ নেতৃত্বাধীন ত্রাণ সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বিতরণ কার্যক্রম কেড়ে নিতে চায়।
জাতিসংঘ ও অন্যান্য প্রধান মানবিক সংস্থা বারবার এই নতুন ত্রাণব্যবস্থার সমালোচনা করেছে এবং বলেছে, এটি গাজার ২১ লাখ মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারবে না। উল্টো সেখানকার মানুষের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে ইসরায়েলকে খাদ্যনিয়ন্ত্রণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দেবে।
ত্রাণের একটি বাক্স পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করার সময় কমপক্ষে তিনজন ফিলিস্তিনি নিহত হন। আহত হন আরও অনেক ক্ষুধার্ত পুরুষ, নারী ও শিশু।সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলেছে, ত্রাণ সংগ্রহ করতে আসা মানুষের সঙ্গে ইসরায়েলি সেনাদের সংঘর্ষ বেধে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
তবে এসব সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে ইসরায়েল উল্টো হামাসের বিরুদ্ধে ত্রাণ চুরির অভিযোগ তুলেছে। দেশটি বলেছে, হামাস যাতে ত্রাণ সরিয়ে নিতে না পারে, সে জন্য গাজায় খাদ্য প্রবেশে অবরোধ আরোপ করেছে তারা।
কিন্তু ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক সিন্ডি ম্যাককেইন এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, অধিকাংশ লুট হওয়া ত্রাণ অসহায় ফিলিস্তিনিরাই নিচ্ছে।
গাজায় ত্রাণ সরবরাহকেন্দ্রে খাবার নিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে এক শিশু.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ ইসর য় ল ব তরণ
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল
যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।
দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে।
প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়।
আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ।
জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন?
আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।
● অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক
দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত