প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ বিষয়ে দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জানান, সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, যা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি।

আরো পড়ুন:

বাজেটে মেট্রোরেলে বরাদ্দ ১১ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা

ব্রিফকেসবিহীন বাজেট যেসব কারণে ব্যতিক্রম

তিনি বলেন, “সরকারের এমন সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে রাষ্ট্রসংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করেছেন তারা।”

তিনি মনে করেন, “সরকার দুর্নীতিকে উৎসাহ দিয়ে রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।”

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “কর হার যা–ই হোক না কেন, এটি সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে যে অনুপার্জিত আয় অবৈধ হবে।”

তিনি বলেন, “কালোটাকা সাদা করার সুযোগ একই সঙ্গে বৈষম্যমূলক। কারণ, এই সিদ্ধান্তের ফলে আবাসন খাতে অবৈধ অর্থের মালিকদের অধিকতর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সৎ উপার্জনকারীদের ফ্ল্যাট বা ভবনের অংশীদার হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে।”

তিনি জানান, রাজস্ব আদায় বাড়াতে এর ব্যবস্থাপনা থেকে নীতিকে আলাদা করার সঙ্গে এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের কৌশলগুলো বাজেট বক্তৃতায় উঠে না আসা হতাশার।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড.

সেলিম রায়হান বলেন, “আমরা এবার একটু ভিন্ন কিছু প্রত্যাশা করেছিলাম। গত বছর জুলাইয়ে একটি কর্মসংস্থান আরেকটি বৈষম্যবিরোধী ধারণাকে নতুন করে সামনে আনা হয়। এই ‍দুইটি জায়গায় বাজেটে কতটকু প্রতিফলন হলো সেটি দেখার বিষয়।”
 
তিনি বলেন, “পুরাতন বাজেট কাঠামোর মধ্যে নতুন করে কিছু বলার চেষ্টা করেছেন প্রস্তাবিত বাজেটে। পুরাতন বাজেটের কাঠামোতে পুঞ্জিভূত সমস্যা আছে। পুরাতন বাজেটে বড় সমস্যা হলো, বড় আকারের বাজেট হয়; কিন্তু বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। বাজেটে যা প্রস্তাব করা হয় তার ৭৫ শতাংশ খরচ হয়। সেই পেক্ষাপটে এই প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু সমস্যা থাকবে।”  

“দ্বিতীয়ত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ জরুরি। বাজেটের কিছু কিছু জায়গায় কিছু উদ্যোগের কথা অর্থ উপদেষ্টা বলার চেষ্টা করেছেন। সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগের যে চিত্র আছে, তা স্থবির রয়েছে। এই স্থবিরতা কাটাতে কর খাতে ছাড়, শুল্ক কমানো, প্রনোদনা, ওয়ান স্টপ সার্ভিস এগুলো পুরাতন বিষয়। বিনিয়োগ একটা ইকোসিস্টেরে মাধ‌মে প্রবাহিত হয়। ইকোসিস্টেম যেটা আছে সেটা এখনো বিনিয়োগে জন্য সহায়ক নয়। বিনিয়োগের বিষয়ে বাধা হচ্ছে একটা অনিশ্চয়তা। বিনিয়োগের বাধা কাটানোর জন্য বাজেটে কোনো বার্তা নেই”, যোগ করেন তিনি।

ড. সেলিম রায়হান বলেন, “প্রস্তাবিত বাজেটে যে গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট নেওয়া হয়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৫ শতাংশে উন্নতি করা ও মূল্যস্ফিতির হার কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা। তাতে আমার প্রশ্ন, এমন বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে কিভাবে জিডিপি উন্নতি করা হবে। অপরদিকে, মূল‌স্ফিতি কিভাবে কমানো হবে সেটা বোধগম্য নয়। সবকিছিু মিলিয়ে আমার কাছে বাজেটে নতুন কিছু দেখতে পাইনি।”

তিনি বলেন, “জুলাই যোদ্ধাদের বিষয়ে যে করহার নির্ধারন করা হয়েছে, বিষয়টি ইতিবাচক। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বড় পেক্ষাপট হচ্ছে তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এর অন্যতম কারণ ছিল কর্মসংস্থান স্থবিরতা। এর পরিবর্তন আনতে গেলে তার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ, তার সঙ্গে আর্থিক ও কর খাত এবং অন্যান্য বিনিয়োগের যে প্রস্তাবনা আছে; সেগুলো কতটুকু বাস্তবায়নের জন্য কি ধরনের কর্ম পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো বাজেটে পরিস্কার করা হয়নি।”

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, “করমুক্ত আয়সীমা আগের মতো আছে। পুরোনো বাজেটকে ঘষামাজা করে সংস্কার করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যেমন- কোনো কোনো খাতে শুল্ক কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ বা ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। বাজেটের কর কাঠামোতে জুলাই যোদ্ধাদের জন্য যা করেছে সেটা ভাল উদ্যোগ। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের রোডম্যাপ উল্লেখ নেই বাজেটে।”  

তিনি বলেন, “বিনিয়োগের জায়গায় নতুন কিছু নেই প্রস্তাবিত বাজেটে। আগের মতো ওয়ান স্টপ সার্ভিসসহ নানা বিষয় রয়েছে। তাতে কতটুকু বিনিয়োগ বাড়বে তা বোধগম্য নয়। বিনিয়োগের জন‌ বিদ্যুৎ-গ্যাসের নিশ্চয়তাসহ নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিষয়ে কোনো দিক নির্দেশনা বাজেটে নেই। তাই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে হচ্ছে না।”

ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে বাজেট ততটা আশাব্যঞ্জক নয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ।

তিনি বলেন, “বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে বাজেট আশাব্যঞ্জক নয়। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, নূন্যতম করের সমন্বয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুমোদনযোগ্য বিয়োজনের আওতা বৃদ্ধি, করজাল সম্প্রসারণ এবং অটোমেটেড রিটার্ন ব্যবস্থা চালুর মতো ইতিবাচক পদক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, সহজে ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশ উন্নয়ন, সিএমএসএমই এবং ব্যাংকিং খাত সংস্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় সার্বিক ব্যবসা ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ততটা সহায়ক নয়।” অনেক ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের অনুপস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যিক কার্যক্রম বেশ চাপের মধ্যে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

তাসকীন আহমেদ বলেন, “প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বেশ বড়। যা অর্জন বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। ব্যক্তি পর্যায়ের করের সীমা অপরিবর্তিত রাখা এবং স্ল্যাব উঠিয়ে নেওয়ায় মধ্যবিত্ত ও বিশেষকরে চাকরিজীবীদের করের বোঝা আগামী অর্থবছর হতে আরো বেশি বহন করতে হবে।”

বাজেটে মূল্যস্ফীতি হ্রাসে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালন ব্যয় বাড়বে, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির গতিকে মন্থর করবে। ব্যাংক খাত হতে ঋণ গ্রহণের খরচ ৬ থেকে ৭ শতাংশ নামিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান ডিসিসিআই সভাপতি। এসএমই খাতের উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কোন রোডম্যাপ এ বাজেটে পরিলক্ষিত হয়নি বলেও জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক মো. আল-আমিন বলেন, “এবারের বাজেট সংকুচিত করা হয়েছে। দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা রয়েছে। একটা নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করে আছে বিনিয়োগকারীরা। ফলে বড় কোনো বিনিয়োগ আসছে না। বাজেটে মেগা কোনো প্রকল্প নাই। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের রাজনৈতিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।” 

তিনি আরো বলেন, “বাজেটে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে, সেটি অনেক সময়ই অর্জন হয় না। বাজেটের ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক ঋণ নেওয়া হবে, তার জন্য সুদের হার বৃদ্ধি পাবে। সরকারের সুদ প্রদান করতে হবে সেটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্রব্য মূল‌ নিয়ন্ত্রণ আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। বড় বিনিয়োগ আসছে না সেটিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।”

ঢাকা/এনএফ/মাসুদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রস ত ব ত ব জ ট ন র জন য সরক র র পর ব শ নত ন ক র পর ব ন বল ন কর ছ ন কর র স ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

সাভারে যাত্রীর অপেক্ষায় দূরপাল্লার পরিবহন

ঈদুল আজহা সামনে রেখে রাজধানী ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন ঘরমুখো মানুষ। তবে, এখনো ঈদযাত্রার তেমন প্রভাব পড়েনি শিল্পাঞ্চল সাভার ও আশুলিয়ার সড়কগুলোতে। উত্তরবঙ্গগামী বাসগুলো যাত্রীর অভাবে দীর্ঘ সময় ধরে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। 

বুধবার (৪ জুন) সকালে সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে, দূরপাল্লার বাসগুলো যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে বাইপাইল ও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় উত্তরবঙ্গগামী সোনালী, হানিফ, এনা ও সীমান্তসহ কয়েকটি পরিবহনের বাস সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখানে যাত্রীর দেখা নেই বললেই চলে।

আশুলিয়ার বাইপাইলে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা সোনালী পরিবহনের চালক সালাউদ্দিন হক বলেন, “অনেকক্ষণ হলো বসে আছি। এখনো যাত্রী পাইনি। আশা করছি, আজ বিকেলের পর থেকে চাপ বাড়বে। গত ঈদে ধাপে ধাপে কারখানাগুলো ছুটি হয়েছিল, এবার একসঙ্গে ছুটি হলে রাস্তায় পরিবহনের চাপ বাড়বে, যানজটও হতে পারে।”

আরো পড়ুন:

সাভারে ৩ মহাসড়কে চাপ বাড়ছে

ঈদে বাড়ি ফেরা: গাজীপুরের ২ সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক

সাভারের বিভিন্ন শিল্পকারখানা সূত্রে জানা গেছে, বুধবার থেকেই আশুলিয়া ও সাভারের অধিকাংশ গার্মেন্টসে ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। ফলে দুপুরের পর থেকে মহাসড়কে যাত্রীর চাপ বাড়বে। দুই মহাসড়ক দিয়ে হাজার হাজার মানুষ গ্রামে রওনা হবেন। তখন যানবাহনের সংকট ও যানজটের শঙ্কা রয়েছে।

সাভার হাইওয়ে থানার ওসি ছালেহ আহমেদ বলেন, “গতকাল মঙ্গলবার রাতে গাড়ির কিছুটা চাপ ছিল। আজ সকাল থেকেও গাড়ির চাপ আছে, তবে কোনো সমস্যা নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে চলছে। গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি, যাতে সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে ঈদযাত্রা করতে পারে।”

এদিকে, সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।

ঢাকা/সাব্বির/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ