সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) পদ্ধতিতে সম্ভাবনাময় খাতে বিনিয়োগ বাস্তবায়নের উদ্যোগ আরও জোরদার করার কথা ভাবছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরে পিপিপি তহবিলে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় এ তথ্য জানান অর্থ উপদেষ্টা  ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

অর্থ উপদেষ্টা ড.

সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। বিনিয়োগকারীদের দ্রুত ও সহজে সেবা দিতে বর্তমানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) পোর্টালের মাধ্যমে ৪৩টি সংস্থার ১৩৪টি সেবা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যবসা সহজীকরণের অংশ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় চালু করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো’ (বিএসডাব্লিউ)’। এর মাধ্যমে একটি প্ল্যাটফর্মে আবেদন, প্রক্রিয়াকরণ ও সেবা গ্রহণ করা যাচ্ছে।

বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি জানান, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একটি ‘ইনভেস্টমেন্ট পাইপলাইন’ তৈরি করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রতিশ্রুত বিনিয়োগগুলোকে কার্যকর বিনিয়োগে পরিণত করার প্রক্রিয়া সহজ হবে।

এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) পদ্ধতিতে সম্ভাবনাময় খাতে বিনিয়োগ বাস্তবায়নের উদ্যোগ আরও জোরদার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। এ লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে পিপিপি তহবিলে ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিকে টেকসই ও প্রতিযোগিতামূলক করতে হলে বেসরকারি খাতকে সামনে রেখে কাঠামোগত সংস্কার এবং বিনিয়োগ সহায়ক নীতিনির্ধারণ অপরিহার্য।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব সরক র বর দ দ

এছাড়াও পড়ুন:

অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার পূর্বাপর

চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক খাতে যে অসাধ্য সাধনের সুযোগ এনে দেয়, অন্তর্বর্তী সরকার সেই সুযোগগুলো একে একে হেলায় হারাচ্ছে। দেড় দশক শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনে পিষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি একদলীয় অবকাঠামোয় ঘুরপাক খাচ্ছিল; তার সমান্তরালে ফাঁপানো অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনার ফাঁদে পড়েছিল দেশ। উন্নয়নের রূপকথাসদৃশ পরিসংখ্যান ও জিডিপির চোখ ধাঁধানো অঙ্ক আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই অন্তঃসারশূন্য প্রমাণ হয়ে যায়। ধারণা করা হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী বাজেট কাটছাঁট করে বাস্তবমুখী ও জনবান্ধব করে তুলবে। জনস্বার্থ বিবেচনায় অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো স্থগিত রেখে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াবে। যেহেতু এই সরকারের কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই; সুযোগ ছিল রাজনৈতিক সরকারের সামনে বাজেটে কৃচ্ছ্রসাধন ও জনকল্যাণকর উদাহরণ তৈরির। অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার পতিত সরকারের বাজেট নিয়ে এগিয়েছে। পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো হলো কিনা; ভর্তুকি, সুদ পরিশোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোন কোন নীতি নেওয়া হলো– সংশোধনের সময় সরকার কিছুই বলল না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৪০ শতাংশই ভুয়া বলে আমরা শ্বেতপত্রে লিখেছি। এডিপি কোন নীতিমালায় সংশোধন হলো, মেগা প্রকল্প কোনটা বাদ দেওয়া হলো, কোনটার মূল্য সংশোধন করা হলো– সেগুলোও বুঝলাম না’ (সমকাল, ৩১ মে ২০২৫)। 

অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনৈতিক সংস্কারে টাস্কফোর্স কমিটিও করেছিল। গত বছরের ১ ডিসেম্বর শ্বেতপত্র কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়; টাস্কফোর্স কমিটি জানুয়ারির শেষ দিকে জমা দিয়েছে। দুই কমিটিরই সদস্য সেলিম রায়হান বলেছেন, ‘বলতে দ্বিধা নেই যে, এ দুটি প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো, বিশেষ করে অর্থ, বাণিজ্য ও পরিকল্পনার মতো যে মন্ত্রণালয়গুলো এ ক্ষেত্রে বেশি প্রাসঙ্গিক, তাদের মধ্যে এই প্রতিবেদনগুলো নিয়ে বড় কোনো আলোচনা দেখিনি’ (প্রথম আলো, ১ জুন ২০২৫)। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে সুদীর্ঘকাল যে অবহেলা-বঞ্চনা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার তা ভেঙে দিয়ে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারত। কেন করল না? আমলাতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখলে যতই শ্বেতপত্র প্রণয়ন ও টাস্কফোর্স কমিটি করুন না কেন, শেষ পর্যন্ত ‘যেই লাউ, সেই কদু’! সরকার যায়, সরকার আসে– কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা খাত দেখা দেয় না। রাষ্ট্রও তাই মানবিক হতে ব্যর্থ হয় শেষ পর্যন্ত। 

২.
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত সপ্তাহের সর্বশেষ তথ্যে দেশে মাথাপিছু গড় বার্ষিক আয় এখন ২ হাজার ৮২০ মার্কিন ডলার। এই সংখ্যা যদি চলতি অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ন থাকে, তবে তা হতে যাচ্ছে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের রেকর্ড। যদি দেশের মানুষের সম্মিলিত পরিশ্রমের স্মারক হতো এই রেকর্ড, নিশ্চয়ই তা উদযাপনের বিষয় হতো। এই গড় অঙ্ক প্রকৃত বাস্তবতা বোঝায় না। এটি দেশের বড় বাজারকে উপস্থাপন করে; কিন্তু অভ্যন্তরে রয়ে যায় শুভঙ্করের ফাঁকি। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ১০ শতাংশ মানুষ দেশের মোট আয়ের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। খাতাপত্রের প্রয়োজন নেই, চোখ মেললেই দেখা যায়, প্রান্তিক অঞ্চলে মানুষের কর্মহীনতা। কৃষি খাতে সরকারের সুদৃষ্টির অভাব অর্থনীতিকে আরও বিপর্যস্ত করছে।
গত ৯ মাসের উপাত্তের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান ব্যুরো অন্তর্বর্তীকালীন জিডিপির যে অঙ্ক জানিয়েছে, সেখানে সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরের তুলনায় এ বছর কৃষি প্রবৃদ্ধি অনেক কমেছে। উচ্চ মূল্যফীতির সময়ে নিজস্ব খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে ব্যর্থ হলে মূল্যস্ফীতি কমবার কোনো কারণ নেই। কৃষির নিম্নমুখী আবর্তনকে রক্ষায় সরকারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বিদেশি সহায়তা ভিক্ষার হাত বাড়াবে কেবল; আত্মবিশ্বাসী হাত তৈরি করবে না– সরকারকে এই সরল সত্য কে বোঝাবে! দেশের মানুষে মানুষে আয় ও সুযোগের যে পাহাড়প্রতিম দূরত্ব; কোনো পরিসংখ্যান বা আলোচনাই এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারছে না। না বিগত স্বৈরাচারী সরকার; না বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার– প্রত্যেকে কোনো রকমে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টাতেই বাজেট-দর্শন অব্যাহত রেখেছে। 

৩.
দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা সব ধরনের সৎ উদ্যোগকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করবার জন্য যথেষ্ট। বিশেষত রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব নয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দিনের পর দিন দাবিদাওয়ায় রাজধানীর প্রধান সড়ক অবরোধ করে রাখছেন। রাজপথ বন্ধ থাকলে জনসাধারণের উপার্জনের পথও বন্ধ হয়ে যায়। দিন এনে দিন খাওয়াদের আর্থিক অবস্থা ৯ মাসে তলানিতে; সেই সঙ্গে রয়েছে যত্রতত্র মব সন্ত্রাস। উগ্রবাদীরা মব আতঙ্ক ছড়িয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতির সুবিধা নিচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি আইনের শাসন যেমন বিঘ্নিত করে, তেমনি বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনাও কমিয়ে দেয়। যে কোনো বিনিয়োগকারীই সবার আগে চান নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা। কভিডের অর্থবছর বাদ দিলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সিকি শতাব্দীর মধ্যে সর্বনিম্ন; বিনিয়োগও গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। বিনিয়োগ না থাকায় কর্মসংস্থান কমে আসছে; পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা।

অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ক্রমবর্ধান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সরকার বিশেষ কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? শ্বেতপত্র কমিটি বা টাস্কফোর্সের সুপারিশ গ্রাহ্য না করে সরকার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার বদলে আজ এ দেশ, কাল সে দেশ থেকে অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি জানানো হচ্ছে। অদম্য অভ্যুত্থানজয়ী কোটি কোটি পরিশ্রমী মানুষের সামনে শুধু অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আশা জাগায় না। এ দেশের মানুষ পরিশ্রমী; তাদের সামনে কাজের সুযোগ তৈরির দায়িত্ব সরকারের। ভিক্ষার হাত তৈরি সরকারের কাজ হতে পারে না। 
অন্তর্বর্তী সরকারকে স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক রোডম্যাপও হাজির করতে হবে; সেখানে অর্থনৈতিক চিন্তারও সমন্বয় থাকবে। অর্থনৈতিক রোডম্যাপ ছাড়া রাজনৈতিক অভীষ্ট হাসিল সম্ভব নয়। আর এই দুই কাজ তখনই সম্ভব হবে, যখন জাতির সামনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বৃহস্পতিবার জাপানের টোকিওতে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘ডিসেম্বরে ভোট চাইছে একটি দল।’ আগের দিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তারুণ্যের সমাবেশে জোর দিয়ে বলেছেন– নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে হবে। এমন পাল্টাপাল্টির মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফায় বৈঠক শুরু হয়েছে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে বর্তমান সরকারের শম্বুকগতি ও অনির্দিষ্ট গন্তব্য দেশের পরিস্থিতি আরও অনিশ্চিত ও অস্থির করে তুলছে। সরকারকে অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার সুনির্দিষ্ট এবং রাজনৈতিক পথনকশা সুস্পষ্ট করতে হবে। গণতন্ত্রের পথে নির্বিঘ্ন ও দ্রুত যাত্রা শুরুর ব্যাপারে সরকার দৃঢ়তা ও স্পষ্টতা যত দ্রুত দেখাবে; মানুষের সামনে থেকে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা তত দ্রুত দূর হবে।

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নতুন বিনিয়োগ চিন্তা পরের কথা, বিদ্যমান ব্যবসা নিয়েই দুশ্চিন্তা
  • সব করদাতার অনলাইনে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক হচ্ছে
  • ১১ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের পরিকল্পনা
  • বাজেট কিছুটা গতানুগতিকই হয়েছে
  • অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দিকনির্দেশনা নেই বাজেটে
  • লেনদেন কর বাদ দেওয়া প্রয়োজন: এমসিসিআই
  • পণ্য রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ
  • মে মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ 
  • অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার পূর্বাপর