প্রধান উপদেষ্টার অর্থবিষয়ক বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, ঋণ করা খারাপ নয়, বরং সরকারের ঋণ গ্রহণ জনগণের জন্য সঞ্চয়ের মতো। আর ঋণ ছাড়া সরকার চলতে পারে না।

আজ মঙ্গলবার ঢাকার বনানীর একটি হোটেলে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) আয়োজিত বাজেট–পরবর্তী পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আনিসুজ্জামান চৌধুরী এমন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি খারাপ কিছু নয়। ইন্দোনেশিয়াতে যখন প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল, তখন তাদের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ থেকে ১৩ শতাংশ। আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতি ১০ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, এটার খারাপ কোনো প্রভাব বের করা যাবে না। এটা আসলে রাজনৈতিক ইস্যু। রাজনৈতিকভাবেই এটা মোকাবিলা করতে হবে। তাই সুদহার বাড়িয়ে এটা কোথাও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বরং সুদহার বাড়ালে ছোট-বড় সবাই আক্রান্ত হয়। মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদের অস্ত্র খুব বেশি কাজ করে না।’

আনিসুজ্জামান বলেন, সরকারের ঋণ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। ঋণ খারাপ কিছু নয়। তবে ঋণের টাকা যথাযথভাবে ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি দেশকে গিলে ফেলছে। কর্ণফুলী টানেল পরিচালনায় প্রতিনিয়ত রাজস্ব থেকে অর্থ ব্যয় হচ্ছে।

দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ নিয়ে নিজের মত দেন আনিসুজ্জামান চৌধুরী। বলেন, ‘আমাদের এখানে বৈদেশিক বিনিয়োগ বা রাজস্ব বাড়েনি বিদেশি ঋণনির্ভরতার কারণে। বিদেশি ঋণ নিলে তাদের অনেক কথা শুনতে হয়। তখন হাত বাঁধা থাকে। স্বাধীনভাবে নীতি গ্রহণ করা যায় না।’ তবে সার্বিকভাবে এখানকার সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকে সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে করেন তিনি।

সংস্কারের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার এ বিশেষ সহকারী বলেন, ‘সংস্কার খুব কঠিন বিষয়। এটার সঙ্গে অনেক তিক্ত রাজনীতি মিশ্রিত রয়েছে। আবার সংস্কারের নির্দিষ্ট কোনো টেক্সট বুক নেই। কোন গতিতে যাব, সেটাও নির্দিষ্ট করা নেই। আবার দ্রুত করতে গেলে কলাপস হতে পারে।’

সেমিনারে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। আর এবারের বাজেটের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি বাড়বেও না, আবার কমবেও না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা বেশি হলে ব্যক্তি খাত ভোগান্তিতে পড়বে। সে জন্য বিদেশি ঋণ ভালো। আমরা অবকাঠামোর দিকে মনোযোগ দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নে নজর দিইনি। এবারও শিক্ষা–স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কম। ফলে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে না।’

সেমিনারে মূল বক্তব্যে উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সমন্বিত পদক্ষেপ নেই। ফলে ব্যক্তি খাতে ২৪ শতাংশ বিনিয়োগের লক্ষ্য পূরণ প্রায় অসম্ভব।

সভাপতির বক্তব্যে অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার উন্নতি না হলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। কাস্টমসের আধুনিকায়ন করতে হবে। লজিস্টিকসেও পিছিয়ে আছি আমরা।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র

এছাড়াও পড়ুন:

পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে

অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।

১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’

এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।

পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।

পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)

সম্পর্কিত নিবন্ধ