যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা মানবিক সহায়তা সংগঠন ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ আজ বুধবার গাজা উপত্যকায় কোনো ধরনের ত্রাণ বিতরণ না করার ঘোষণা দিয়েছে। ত্রাণ নিতে গিয়ে বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার এক দিন পর এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের সীমানার বাইরেও বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা বাড়াতে সংস্থাটি ইসরায়েলের ওপর চাপ দিচ্ছে।

গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বলেছে, তারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করেছে যেন তারা সামরিক সীমানার কাছে জনসাধারণের চলাচল এমনভাবে পরিচালনা করে যাতে বিভ্রান্তি বা উত্তেজনার ঝুঁকি কমে। এ ছাড়া সাধারণ নাগরিকদের জন্য আরও স্পষ্ট দিকনির্দেশনা তৈরি করা এবং বেসামরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণ বাড়িয়ে দেওয়ারও অনুরোধ জানানো হয়েছে।

গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের এক মুখপাত্র বলেন, ‘ত্রাণ নিতে আসা মানুষদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করাটা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের জায়গা।’

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র আজ গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের দিকে যাওয়ার রাস্তাগুলোকে ‘যুদ্ধাঞ্চল’ বলে উল্লেখ করেন। ওই সব এলাকায় চলাচলের বিষয়ে সাধারণ মানুষদের সতর্ক করেন তিনি।

গতকাল মঙ্গলবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের খাদ্যসহায়তা বিতরণকেন্দ্রের কাছে জড়ো হওয়া একদল মানুষকে ‘হুমকি’ মনে করে গুলি চালিয়েছে তারা।

আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি বলেছে, এ ঘটনায় অন্তত ২৭ জন নিহত এবং আরও অনেকে আহত হয়েছেন। গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বলেছে, এ ঘটনা তাদের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের ‘অনেক বাইরে’ ঘটেছে।

গতকাল গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিরা বলেছেন, ঘটনাস্থলে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল। ভিড়ের মধ্যে সবাই সাহায্য পেতে ঠেলাঠেলি করছিলেন। কেউ ত্রাণ হস্তান্তরের কাজ তদারকি করছিলেন না, পরিচয়পত্রও যাচাই করা হচ্ছিল না।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও গাজায় মানবিক সহায়তার প্রবেশ নিশ্চিত করার বিষয়ে আজ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটি হবে।

গাজা থেকে ১১ সপ্তাহের অবরোধ তুলে নেওয়ার পরও সেখানে বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাত চলার কারণে খুব সীমিত পরিমাণে ত্রাণ পৌঁছাতে পারছে।

জাতিসংঘ ও অন্য মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে থাকে। জাতিসংঘ মনে করে, এ সংস্থা নিরপেক্ষ নয় এবং এর ত্রাণ বিতরণের পদ্ধতি মানবিক সহায়তাকে সামরিক রূপ দিচ্ছে। ত্রাণ বিতরণস্থলে সহায়তা পৌঁছাতে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি নিরাপত্তা ও লজিস্টিকস কোম্পানির সহায়তা নেয় গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব তরণক ন দ র র ইসর য় ল

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল

যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।

দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে। 

গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে। 

প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়। 

আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫

দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ। 

জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন? 

আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫

তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন। 

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক

দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ত্রাণ বিতরণে ইসরায়েলের ওপরই ভরসা ট্রাম্পের
  • গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল