গত বছরের ৫ আগস্ট একদিকে যেমন দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক স্থবিরতা ভেঙে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি মব সন্ত্রাস বা গণপিটুনির মতো এক গভীর সামাজিক ব্যাধি নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গণপিটুনিতে ১১৯ জন নিহত হয়েছেন; আহত ৭৪ জন। গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে। গত বছর এ ধরনের ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন।
সারাদেশে মব ভায়োলেন্সের যে চিত্র উন্মোচিত হয়েছে, তা কেবল আইনশৃঙ্খলার সংকট নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সামাজিক সংহতির অভাব এবং মানবিক মূল্যবোধের এক গভীর অবক্ষয়কে নির্দেশ করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণরোষ বা স্বতঃস্ফূর্ত জনতার প্রতিক্রিয়া নতুন নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিশেষ করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে আইনের শাসনের দুর্বলতা এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থাহীনতা গণপিটুনির মতো ঘটনাকে ইন্ধন জুগিয়েছে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন সরকার পরিবর্তনের সময়েও এমন প্রবণতার নজির পাওয়া যায়।
৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে মব সন্ত্রাসের যে ব্যাপকতা ও নির্মমতা দেখা গেছে, তা পূর্ববর্তী সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেছে।
এটা দুঃখজনক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে নির্ভয়ে রাজপথে যে তরুণ সমাজ নেমেছিল, তাদেরই একটি অংশকে গণপিটুনির মতো অমানবিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। এটি যেমন তাদের মহান ত্যাগের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তেমনি আইনের শাসনের প্রতি তাদের নিজেদেরই বিশ্বাসের দুর্বলতা ফুটিয়ে তোলে। সম্ভবত দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বিচারহীনতার হতাশা এবং তাৎক্ষণিক আবেগের বশবর্তী হয়ে তারা এমন কাজ করেছে, যা তাদের মূল লক্ষ্য ও আদর্শের পরিপন্থি।
এটি গভীর সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক সংকট, যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিজেই অন্যায়ের পথে পরিচালিত হচ্ছে। মব ভায়োলেন্স থেকে পরিত্রাণের পথ প্রথমত, সুসংহত রাজনৈতিক ও সামাজিক রোডম্যাপ। দ্বিতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ ও সহনশীলতার বার্তা প্রদান। চতুর্থত, গুজব ও ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে কার্যকর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গুজব ও ভুয়া তথ্য ছড়ানো ও সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে উস্কানিমূলক বা মিথ্যা তথ্য দ্রুত চিহ্নিত করে অপসারণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সাইবার অপরাধ দমনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানো এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
মব ভায়োলেন্স ঠেকাতে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা নাগরিক সমাজ, মানবাধিকারকর্মী এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।
এটা সত্য, ৫ আগস্টের ঘটনা প্রবাহ বাংলাদেশকে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা এবং সাধারণ জনগণের সুরক্ষায় জনতার পাশে থেকে কাজ করে গেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
সম্প্রতি জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের মবতন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান সাধারণ মানুষের মাঝে কিছুটা স্বস্তির আভাস দিয়েছে। বিশেষ করে রংপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বাসায় হামলার পর সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থানকে অনেকেই মব সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী বার্তা হিসেবে মনে করছেন।
আশা করা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম, সঠিক আইনি অবকাঠামো, সংবাদমাধ্যমের জোরালো ভূমিকা, একই সঙ্গে ব্যাপক জনসচেতনতা মব ভায়োলেন্সের ক্ষত সারিয়ে তুলবে।
রাজু আলীম: কবি ও লেখক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: মব ভ য় ল ন স গণপ ট ন র র জন ত ক আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ
চলতি অক্টোবর মাসে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশ এবং কারা হেফাজতে মৃত্যু সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। এ তথ্য তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির অক্টোবর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এমএসএফ বলেছে, এসব ঘটনায় জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ দুই ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।
এমএসএফ প্রতি মাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। আজ শুক্রবার অক্টোবর মাসের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে।
বেড়েছে অজ্ঞাতনামা লাশএমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মোট ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়; বরং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) এর সংখ্যা ছিল ৫২। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দী ও রক্তাক্ত বা শরীরে আঘাতের চিহ্নসংবলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং তা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১টি শিশু, ১ কিশোর, ১১ জন নারী ও ৫৩ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ বছর বয়সী শিশু; ১৫ বছর বয়সী কিশোর; ২০ থেকে ৩০ বয়সী ১৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী; ৩১ থেকে ৪০ বয়সী ১৯ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী; ৪১ থেকে ৫০ বয়সী ১ নারী ও ৫ জন পুরুষ এবং ৫০ বছর বয়সের বেশি ১১ জন পুরুষ ও ১ নারী রয়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বয়স শনাক্ত করা যায়নি।
এমএসএফ বলেছে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
কারা হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছেইএমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে কারা হেফাজতে মোট ১৩ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল মোট ৮। এ মাসে ছয়জন কয়েদি ও সাতজন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন কয়েদি ও দুজন হাজতি, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন কয়েদি ও শেরপুর জেলা কারাগারে একজন কয়েদি মারা যান। এ ছাড়া খুলনা জেলা কারাগারে, টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন করে হাজতি বন্দী মারা যান। সব বন্দীর মৃত্যু হয় কারাগারের বাইরে হাসপাতালে।
এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যু এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বৃদ্ধি মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা এবং সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ। কিন্তু একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো কাজ নেই।
সাইদুর রহমান বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধি জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
গণপিটুনিতে হত্যা চলছেই, বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতাঅক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ২ জন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী–সমর্থক। সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনা ঘটেছিল।
সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকাণ্ড এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। আগের মাসে এ ঘটনা ঘটেছিল ৪৩টি। এ মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।