কতটা বৈষম্যবিরোধী হলো এবারের বাজেট
Published: 5th, June 2025 GMT
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে সৃষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। বিগত সরকারের আমলে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য ব্যাপক
মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ যুক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল এই বৈষম্য থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। গণ-অভ্যুত্থানের দেয়াললিখনেও এর ছাপ ফুটে উঠেছিল। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর পদক্ষেপ থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত।
বাজেটে যেসব খাতের সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা যায়, তার মধ্যে রয়েছে করব্যবস্থা এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ। দেশে বিদ্যমান করব্যবস্থা বৈষম্যমূলক। কারণ, ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আহরণের বদলে দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ কর আদায়ে জোর দেওয়া হয়।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় ও বরাদ্দ করা অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় করতে না পারায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ের বেশির ভাগটা আসে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে, যা দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের পক্ষে বহন করা কঠিন। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল, অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিভিন্ন কমিশন, কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে এসব খাতে বৈষম্য দূর করতে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ করা হয়েছিল। প্রশ্ন হলো এবারের বাজেটে এসব সুপারিশ কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে?
আরও পড়ুনসংসদ ছাড়া বাজেট: জবাবদিহির ঘাটতি পূরণের পথ কী২২ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকার গঠিত অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে প্রগতিশীল করব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করা হয়। এ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পরোক্ষ কর আদায়ের বদলে ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু এবারের বাজেটে এই সুপারিশের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।
বাজেটে বিভিন্ন ধরনের কর, শুল্ক, ভ্যাটের হ্রাস–বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হলেও সব মিলিয়ে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা আগের মতোই রয়ে গেছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকার যত কর আহরণ করবে, তার ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশই পরোক্ষ কর, যা ভ্যাট ও শুল্ক হিসেবে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে যাবে। আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষিত বিগত বাজেটে পরোক্ষ করের হার ছিল ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ১৫ শতাংশ বা জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া ব্যয়বহুল চিকিৎসায় আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সামাজিক ‘স্বাস্থ্যকবচ’ নামে স্বাস্থ্যবিমা চালু করার সুপারিশ করেছে।
এবারের বাজেটে এসব সুপারিশের কোনোটাই রক্ষা করা হয়নি। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। টাকার অঙ্কে বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় ৫০০ কোটি টাকা বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে কমেছে। গত অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা এবারের বাজেটে আরও কমে হয়েছে জিডিপির শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ।
আমরা একদিকে দেখছি, সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। গভীর সংস্কার করার জন্য নির্বাচন দেরিতে করার কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের কাজে সংস্কারের কোনো ছাপ পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সরকারের নিজের গঠিত কমিশন, কমিটি ও টাস্কফোর্সের বৈষম্যবিরোধী সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে পর্যন্ত অগ্রগতি নেই। প্রত্যাশা ছিল বাজেটে তার একটা প্রতিফলন পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটাও দেখা গেল না।শিক্ষা বিষয়ে কোনো কমিশন গঠন করা না হলেও প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি প্রাথমিক শিক্ষায় বৈষম্য দূরীকরণে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল, যার মধ্যে রয়েছে ‘মিড-ডে মিল’ চালু, খাতা-কলম-ব্যাগ ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য বর্ধিত হারে অর্থসহায়তা প্রদান ইত্যাদি। কিছু উপজেলায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালুর জন্য ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ গত বাজেটের তুলনায় ৩ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা কমে গেছে।
বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এমনিতেই জিডিপির ২ শতাংশের কম। ইউনেসকোর পরামর্শ অনুসারে, জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ ছিল শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে এবং তার দুর্নীতিমুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করে পরবর্তী সরকারগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাওয়ার। দেখা যাচ্ছে, এবারের বাজেটে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা—সব মিলিয়ে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ টাকার অঙ্কে কিছুটা বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে বরাবরের মতোই কমেছে। বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
অর্থনৈতিক কৌশল–সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়—এমন কর্মসূচিকে সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচির আওতা থেকে বাদ দেওয়া, একই বিষয়ে আলাদা অনেকগুলো কর্মসূচি না রেখে একত্র করে ব্যয় হ্রাস ও অদক্ষতা দূর করা, শহুরে দরিদ্রদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা, যথাযথভাবে সুবিধাভোগী বাছাই করা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ভাতার পরিমাণ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয়ের ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করা হয়।
এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের কোনো কোনো কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ ৫০ থেকে ১০০ টাকা এবং সুবিধাভোগীর সংখ্যা কিছুসংখ্যক বাড়ানো হলেও
তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। যেমন বয়স্ক ভাতার মাসিক হার ৬০০ থেকে বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা কিংবা বিধবা ভাতা ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা করা হলেও
তা জাতীয় দারিদ্র্যসীমার আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংখ্যা ১৪০টি থেকে কমিয়ে ৯৫টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে; বরাদ্দ গত বছরের ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন যেসব কর্মসূচি অর্থনীতি–সংক্রান্ত টাস্কফোর্স কমিটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল, তার মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, কৃষি খাতে ভর্তুকি, সঞ্চয়পত্রের সুদ, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ ইত্যাদি। সঞ্চয়পত্রের সুদ ছাড়া বাকিগুলো বরাবরের মতো এবারের বাজেটেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসেবে দেখানো হয়েছে।
সরকারি কর্মচারীদের পেনশন বাবদ ৩৫ হাজার ২৮২ কোটি, কৃষি ভর্তুকি বাবদ ১৭ হাজার কোটি, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বাবদ ৪ হাজার ৮০০ কোটি এবং পাঠ্যবই বিতরণ বাবদ ২ হাজার ১৯২ কোটি টাকা বাদ দিলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। এই হার বিশ্বের অনেক নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ তো বটেই, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গড় বরাদ্দের (৩ দশমিক ৮ শতাংশ) মাত্র চার ভাগের এক ভাগ।
আমরা একদিকে দেখছি, সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। গভীর সংস্কার করার জন্য নির্বাচন দেরিতে করার কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের কাজে সংস্কারের কোনো ছাপ পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সরকারের নিজের গঠিত কমিশন, কমিটি ও টাস্কফোর্সের বৈষম্যবিরোধী সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে পর্যন্ত অগ্রগতি নেই। প্রত্যাশা ছিল বাজেটে তার একটা প্রতিফলন পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটাও দেখা গেল না।
আগের ধারাবাহিকতাতেই বাজেটে কর আহরণের কাঠামো পরোক্ষ করনির্ভর রাখা হলো, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির বদলে উল্টো কমানো হলো। অথচ এসব খাতে জনমুখী সংস্কারের জন্য সংবিধান সংস্কার কিংবা রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানোর মতো কোনো জটিলতা ছিল না। সরকারের সদিচ্ছাই বিদ্যমান তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে পারত। নিজের আয়ত্তের মধ্যে থাকা এই সংস্কারটুকু যে সরকার করার চেষ্টা করল না, সে সরকার যে সংস্কার বিষয়ে আসলেই আন্তরিক, দেশের মানুষ তা বুঝবে কী করে!
কল্লোল মোস্তফা লেখক ও বিশ্লেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স প র শ কর ছ র স প র শ কর ব যবস থ সরক র র র জন য বর দ দ দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
যদি সে মৃতদেহটিরে চিনিবারে পারি
দ্বৈতসত্তার ধারণা আছে অধ্যাত্মবিদ্যায়, দর্শনে, মনোবিজ্ঞানে, এমনকি পদার্থবিদ্যার সাম্প্রতিক শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্সে। অধ্যাত্মবিদ্যায় স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে একই সাথে আবার পরস্পরের পৃথক সত্তা হিসেবে কল্পনা করা হয়। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড স্রষ্টার সত্তার অংশ আবার সৃষ্টি ও স্রষ্টা পৃথক সত্তাও বটে। দর্শন আরেক কাঠি সরেস। সে বিদ্যা এমনকি ব্যক্তির মন ও শরীরকে পৃথক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে। যেখানে একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্বই নেই। মনোবিজ্ঞানে দ্বৈতচেতনা বলে আলাদা তত্ত্ব তৈরি হয়েছে; যার ওপর ভিত্তি করে মৃগী রোগীদের চিকিৎসা পরিচালনা করা হয়। মনে করা হয়, মানুষের মস্তিষ্কের ডান ও বাম অংশ পৃথক পৃথক ভাগ। অপারেশন করে তাদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে একই ব্যক্তির ভেতর একদম পৃথক দুটো সত্তার প্রকাশ ঘটবে; যার একটির সাথে অন্যটির যোগাযোগ বা নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত থাকবে না। আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স তো ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তা ছাড়িয়ে সমান্তরাল বিশ্বের (Parallel Universe) ধারণা দিয়েছে। যেখানে সমরূপ বিশ্ব একই সাথে বিরাজমান। মানে আমাদের পৃথিবীর মতো ঠিক আরেকটি পৃথিবী মহাশূন্যে অন্য কোথাও আছে। এমনকি আমার মতো আরেকজন শোয়াইব জিবরান সে পৃথিবীতে বসে এই সময়ে একই লেখা লিখেছে! বেশ বিদঘুটে আর গোলমেলে ব্যাপার। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন স্রষ্টা গল্পটি লিখতে গিয়ে নিজেই সে গল্পের ভেতর ঢুকে পড়েন। গল্পের ভেতর আটকা পড়েন। চরিত্র হয়ে ওঠেন।
আখ্যানে সেটি সহজে চিহ্নিত করা যায়। সে চিহ্নিত করার হাতিয়ারটির নাম পয়েন্ট অব ভিউ। কার দৃষ্টিতে লেখা হয়েছে বা বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু টুলটি যে সব সময় নিশ্চিতভাবে কাজ করে, এমনটি নয়। তাই আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি না অপু কি নিজেই বিভূতিভূষণ, মিসির আলী কি হুমায়ূন আহমেদের যুক্তিবাদী আর হিমু কি বাউণ্ডুলে সত্তা? সে তর্ক আপাতত তোলা থাক। অখনে কথাসাহিত্য বাদ দিয়ে কবিতায় যাওয়া যাক।
আমাদের হাতে আসা পৃথিবীর প্রাচীন অন্যতম কবিতাটি একজন নারীর লেখা। তাঁর নাম সাফো। তিনি লেসবন নামক শহরে বাস করতেন। অনেকে মনে করেন লেসবিয়ান শব্দটি সে শহরের নাম থেকে এসেছে। সাফো ছিলেন মন্দিরের দাসী। তাঁর কবিতাটিতে একজন নারীর প্রতি আরেকজন নারীর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে। তাতে কি আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারি সাফো নিজে সমকামী ছিলেন? নাকি তিনি তাঁর অপর সহকর্মীদের নিয়ে লিখেছিলেন? নাকি নিজের অজানা কোনো সত্তা নিয়ে লিখেছিলেন? আমরা ঠিক উত্তরটি নিশ্চিত করে বলতে পারব না। কবিতা সাধারণত কী কী নিয়ে লেখেন, এর একটি তালিকা করতে বললে একজন সাধারণ মানুষও বলবেন, ফুলপাখি, নদীনালা, নারী, দেশ ও মানুষকে নিয়ে লেখেন। আসলেই কি তাই? আমার তো মনে হয়, কবিরা এগুলোর কোনোটাকেই নিয়ে লেখেন না। লেখেন একটি বিষয় নিয়েই। নিজেকে লেখেন। গল্প বা উপন্যাসে যেমন অসংখ্য চরিত্র থাকে। তার মধ্যে একটি প্রধান চরিত্রও থাকে। কবিতারও তেমনি প্রধান চরিত্রটি কবি নিজে। বাকিগুলোও তাঁরই চূর্ণ।
২.
নব্বই দশকের আমার পরিচিত এক তরুণের কবিতার উদাহরণের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করতে পারি। তার কবিতায় নগরে সদ্য আসা একটি তরুণকে দেখতে পাই। যে নগর বিদ্যালাভে এসে সব হারিয়ে নিজেকে শেখ ফরিদের সাথে উপমিত করছে। লিখছে– শেখ ফরিদের জীবন। চক্ষু দুটো দিয়েছি তাকে। অন্ধতা নিয়ে আজ তোমার দরোজায়। পুত্র ফিরেছি মা গো, দোয়া ইউনুস পড়ে তোমারে যে ডাকি, দ্বার খুলে দাও। জ্ঞান লাভে যে পুত্র শহরেতে যায়, সে মানুষ থাকে না, তার দেহ থাকে না, হৃদয় থাকে না, ঈমান থাকে না, শুধু কাকের ঠোঁটের মতো তীক্ষ্ণ বেঁচে থাকার নখর ইচ্ছে ছাড়া। (শেখ ফরিদ)
বোঝা যাচ্ছে ছেলেটি শহরে এসে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। তাই ডুব দিচ্ছে ফেলে আসা শৈশবে। কিন্তু শৈশবের সব স্মৃতিও তার কাছে ঝাপসা। সে ইশারাগুলো ধরে যেন ফেলে আসা জীবনে ঢু মারছে–
রাত্রি ছিল। রাস্তায় একা পেয়ে শুনিয়েছ গান, মানে বুঝিনি। ... ভাষা তার অর্ধ বুঝি। যিনি জেগে আছেন মাঠের ওপারে, বটগাছ নদী আর বাতাস নিয়ে। আত্মা মাঝে মাঝে পাঠাই তার খোঁজে, কী কঙ্কাল বেঁচেবর্তে থাকা, অর্ধ স্বপ্ন আর অর্ধ জাগরতা নিয়ে। দিবানিশি। ... সে ডাকে। দিঘির জলে ডুবে গেলে চাঁদের দেহ। আমি কি আর ফিরে যেতে পারি? ফিরে কি কেহ? যে ফেলে এসেছে ছায়া পথের ধুলোয়। (ছায়া এলিজি)
এই শহরকে তার ভয় লাগে। মনে হয় সে কোনো বুনো মানুষ। নিষাদের পুত্র। মাথায় পালক নিয়ে বনে শিকারে করে ক্ষুন্নিবৃত্তি মেটাত। কিন্তু শহরের রাস্তায়ই এখন সে পোশাকে বের হওয়া ঠিক হবে কিনা ঠিক করতে পারছে না।
মাথায় পালক নিয়ে এই অসময়ে বেরুনো কী ঠিক হবে?/ চারিদিকে আগুন নদী, পথঘাট অগ্নিবাতাস। যারা গিয়েছিল অন্ধ পাখি হাতে কোড়া শিকারে/ ফিরেনি। রক্তের ঘ্রাণ বাতাসে/ চাপ চাপ ছড়িয়ে আছে। (শিকারী)
তার তখন সে শহরে একটি আশ্রয়ের দরকার, ভালোবাসা দরকার। ঘর দরকার।
একটুখানি ঘরের জন্যই তো/ আমাকে এত বাহিরে ঘুরে মরতে হয়/ ঝড়, বৃষ্টি, আগুন ঝঞ্ঝায়, একেলা সন্ধ্যায়। ... আমি দশ ফুট বাই দশ ফুট ছায়ার জন্য ঘুরিয়া বেড়াই দশ দিগন্ত। (ঘর)
আমরা ওই তরুণের পরের কবিতাগুলোতে দেখতে পাই নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে সে ঘরটি, এমনকি ভালোবাসার মানুষটি পায়। কিন্তু ততদিনে তার কাছে এগুলো অর্থহীন হয়ে পড়েছে। ততদিনে সে ভেতর থেকে মরে গেছে। একদিন সে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় তার সে ঘরের ভেতর, তার আত্মার ভেতর একটি লাশ পড়ে আছে। তরুণটির কাছে সে লাশটি খুব পরিচিত মনে হয়।
কী ভেবে দিচ্ছি উঁকি/ নিজ সত্তার গভীরে/ যদি সে মৃতদেহটিরে/ চিনিবারে পারি/ একটুখানি। (যমজ ভাই)
হ্যাঁ, লাশটি সে দেখতে পায়। বিপন্ন বিস্ময়ে তরুণটি বুঝতে পারে এ মৃতদেহটি তার নিজেরই।
আর এই লেখাটির লেখকও উপলব্ধি করেন নব্বই দশকের সে তরুণ কবিটি তিনি নিজেই। কবিতার সে মৃহদেহটিও তার।