বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে সৃষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। বিগত সরকারের আমলে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য ব্যাপক
মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ যুক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল এই বৈষম্য থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। গণ-অভ্যুত্থানের দেয়াললিখনেও এর ছাপ ফুটে উঠেছিল। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর পদক্ষেপ থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত।

বাজেটে যেসব খাতের সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা যায়, তার মধ্যে রয়েছে করব্যবস্থা এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ। দেশে বিদ্যমান করব্যবস্থা বৈষম্যমূলক। কারণ, ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আহরণের বদলে দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ কর আদায়ে জোর দেওয়া হয়।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় ও বরাদ্দ করা অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় করতে না পারায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ের বেশির ভাগটা আসে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে, যা দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের পক্ষে বহন করা কঠিন। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল, অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিভিন্ন কমিশন, কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে এসব খাতে বৈষম্য দূর করতে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ করা হয়েছিল। প্রশ্ন হলো এবারের বাজেটে এসব সুপারিশ কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে?

আরও পড়ুনসংসদ ছাড়া বাজেট: জবাবদিহির ঘাটতি পূরণের পথ কী২২ ঘণ্টা আগে

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে প্রগতিশীল করব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করা হয়। এ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পরোক্ষ কর আদায়ের বদলে ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু এবারের বাজেটে এই সুপারিশের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।

বাজেটে বিভিন্ন ধরনের কর, শুল্ক, ভ্যাটের হ্রাস–বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হলেও সব মিলিয়ে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা আগের মতোই রয়ে গেছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকার যত কর আহরণ করবে, তার ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশই পরোক্ষ কর, যা ভ্যাট ও শুল্ক হিসেবে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে যাবে। আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষিত বিগত বাজেটে পরোক্ষ করের হার ছিল ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ১৫ শতাংশ বা জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া ব্যয়বহুল চিকিৎসায় আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সামাজিক ‘স্বাস্থ্যকবচ’ নামে স্বাস্থ্যবিমা চালু করার সুপারিশ করেছে।

এবারের বাজেটে এসব সুপারিশের কোনোটাই রক্ষা করা হয়নি। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। টাকার অঙ্কে বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় ৫০০ কোটি টাকা বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে কমেছে। গত অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা এবারের বাজেটে আরও কমে হয়েছে জিডিপির শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ।

আমরা একদিকে দেখছি, সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। গভীর সংস্কার করার জন্য নির্বাচন দেরিতে করার কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের কাজে সংস্কারের কোনো ছাপ পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সরকারের নিজের গঠিত কমিশন, কমিটি ও টাস্কফোর্সের বৈষম্যবিরোধী সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে পর্যন্ত অগ্রগতি নেই। প্রত্যাশা ছিল বাজেটে তার একটা প্রতিফলন পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটাও দেখা গেল না।

শিক্ষা বিষয়ে কোনো কমিশন গঠন করা না হলেও প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি প্রাথমিক শিক্ষায় বৈষম্য দূরীকরণে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল, যার মধ্যে রয়েছে ‘মিড-ডে মিল’ চালু, খাতা-কলম-ব্যাগ ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য বর্ধিত হারে অর্থসহায়তা প্রদান ইত্যাদি। কিছু উপজেলায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালুর জন্য ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ গত বাজেটের তুলনায় ৩ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা কমে গেছে।

বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এমনিতেই জিডিপির ২ শতাংশের কম। ইউনেসকোর পরামর্শ অনুসারে, জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ ছিল শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে এবং তার দুর্নীতিমুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করে পরবর্তী সরকারগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাওয়ার। দেখা যাচ্ছে, এবারের বাজেটে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা—সব মিলিয়ে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ টাকার অঙ্কে কিছুটা বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে বরাবরের মতোই কমেছে। বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

অর্থনৈতিক কৌশল–সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়—এমন কর্মসূচিকে সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচির আওতা থেকে বাদ দেওয়া, একই বিষয়ে আলাদা অনেকগুলো কর্মসূচি না রেখে একত্র করে ব্যয় হ্রাস ও অদক্ষতা দূর করা, শহুরে দরিদ্রদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা, যথাযথভাবে সুবিধাভোগী বাছাই করা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ভাতার পরিমাণ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয়ের ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করা হয়।

এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের কোনো কোনো কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ ৫০ থেকে ১০০ টাকা এবং সুবিধাভোগীর সংখ্যা কিছুসংখ্যক বাড়ানো হলেও
তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। যেমন বয়স্ক ভাতার মাসিক হার ৬০০ থেকে বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা কিংবা বিধবা ভাতা ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা করা হলেও
তা জাতীয় দারিদ্র্যসীমার আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংখ্যা ১৪০টি থেকে কমিয়ে ৯৫টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে; বরাদ্দ গত বছরের ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন যেসব কর্মসূচি অর্থনীতি–সংক্রান্ত টাস্কফোর্স কমিটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল, তার মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, কৃষি খাতে ভর্তুকি, সঞ্চয়পত্রের সুদ, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ ইত্যাদি। সঞ্চয়পত্রের সুদ ছাড়া বাকিগুলো বরাবরের মতো এবারের বাজেটেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসেবে দেখানো হয়েছে।

সরকারি কর্মচারীদের পেনশন বাবদ ৩৫ হাজার ২৮২ কোটি, কৃষি ভর্তুকি বাবদ ১৭ হাজার কোটি, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বাবদ ৪ হাজার ৮০০ কোটি এবং পাঠ্যবই বিতরণ বাবদ ২ হাজার ১৯২ কোটি টাকা বাদ দিলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। এই হার বিশ্বের অনেক নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ তো বটেই, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গড় বরাদ্দের (৩ দশমিক ৮ শতাংশ) মাত্র চার ভাগের এক ভাগ।

আমরা একদিকে দেখছি, সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। গভীর সংস্কার করার জন্য নির্বাচন দেরিতে করার কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের কাজে সংস্কারের কোনো ছাপ পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সরকারের নিজের গঠিত কমিশন, কমিটি ও টাস্কফোর্সের বৈষম্যবিরোধী সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে পর্যন্ত অগ্রগতি নেই। প্রত্যাশা ছিল বাজেটে তার একটা প্রতিফলন পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটাও দেখা গেল না।

আগের ধারাবাহিকতাতেই বাজেটে কর আহরণের কাঠামো পরোক্ষ করনির্ভর রাখা হলো, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির বদলে উল্টো কমানো হলো। অথচ এসব খাতে জনমুখী সংস্কারের জন্য সংবিধান সংস্কার কিংবা রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানোর মতো কোনো জটিলতা ছিল না। সরকারের সদিচ্ছাই বিদ্যমান তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে পারত। নিজের আয়ত্তের মধ্যে থাকা এই সংস্কারটুকু যে সরকার করার চেষ্টা করল না, সে সরকার যে সংস্কার বিষয়ে আসলেই আন্তরিক, দেশের মানুষ তা বুঝবে কী করে!

কল্লোল মোস্তফা লেখক ও বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স প র শ কর ছ র স প র শ কর ব যবস থ সরক র র র জন য বর দ দ দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

পুতিন এমন কিছু চান, যা তিনি কখনোই পাবেন না

ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই বলেছেন, তিনি কোনো সাধারণ নেতা নন, সিংহাসনে আসীন একজন আইনজ্ঞ শাসক। শুরু থেকেই তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের পরিচিতির অংশ হিসেবে একসময় যে তিনি আইনশাস্ত্র পড়েছেন, সেটা ভুলে যাননি। গত মে মাসে একদল ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি তাঁদের বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত তো আমি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রিধারী।’ সেই বৈঠকে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, একটি শান্তিচুক্তি হলে পশ্চিমা প্রতিযোগীরা রাশিয়ায় ফিরে আসতে পারে। এর উত্তরে পুতিন আরও বলেন, ‘আপনারা যদি আমাকে চুক্তিপত্রটি দেন, তাহলে আমি উল্টেপাল্টে দেখে বলে দেব কী করতে হবে।’

আমরা সাধারণত স্বৈরাচার মানেই এমন একজনকে ভেবে নিই, যিনি আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন না। এটা একদম সত্যি। কিন্তু পুতিনের মতো একজন একনায়কের কাছে আইনের লঙ্ঘনের চেয়ে বরং আইনের দোহাই দেওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সুশৃঙ্খল কাঠামো থেকে নির্দেশ মেনে চলতে চলতে প্রেসিডেন্টের আসন পর্যন্ত পৌঁছেছেন।

আজকের রাশিয়ায় রাজনৈতিক দমন-পীড়নের প্রতিটি নতুন ঢেউয়ের আগে নতুন কোনো আইন পাস হয় অথবা পুরোনো আইনে সংশোধন আনা হয়, যাতে আইন লঙ্ঘন না করেই আরও বেশি মানুষকে ‘আইনের আওতায়’ শাস্তি দেওয়া যায়।

একজন ব্যক্তির ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য আইনি ব্যবস্থাকে সীমাহীনভাবে ব্যবহার করে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটনাক্রমে একটি উচ্চতর বৈধতার দাবি করে। প্রকৃতপক্ষে পুতিনের সমগ্র রাজনৈতিক জীবনই কেটেছে এমন একটি বৈধতার উৎস খুঁজতে খুঁজতে, যেটা আইনের চেয়েও গভীর। নিজের কর্তৃত্ব প্রমাণের এটা একটা ব্যক্তিগত বাতিক। এটা বিজয়ের বাসনার মতোই একটি ব্যাপার। এটাই ইউক্রেন যুদ্ধে তাকে চালিত করেছে। এ যুদ্ধের লক্ষ্য হলো সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে রাশিয়াকে আবার বিশ্বশক্তির অভিজাত ক্লাবে ফেরত নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এ প্রত্যাবর্তন পশ্চিমা বিশ্বের স্বীকৃতি ছাড়া অসম্ভব। আর দিন দিন এ ধারণা পরিষ্কার হচ্ছে যে পুতিন সেই স্বীকৃতি হয়তো আর কখনোই পাবেন না।

পুতিনের রাজত্ব শুরুর বছরগুলোতে একটি কৌশল কাজ করেছিল। তিনি পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে সম্মেলনে অংশ নিতেন। দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালে তিনি যখন আবার প্রেসিডেন্ট পদে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন, তখন দেশজুড়ে বড় ধরনের প্রতিবাদ শুরু হয়। তখন থেকেই তিনি বিধ্বংসী পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে তথাকথিত রুশ ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ রক্ষার লড়াই শুরু করেন।

এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের অর্থ ছিল সরাসরি পশ্চিমের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া, যার পরীক্ষাক্ষেত্র হয়ে ওঠে ইউক্রেন। ক্রিমিয়া দখলকে পুতিন একটি ঐতিহাসিক অবিচারের ‘সংশোধন’ বলে তুলে ধরেছিলেন। এর পরপরই পূর্ব ইউক্রেনে হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসন শুরু করেন। এটিকে তিনি চমকপ্রদ বিদ্যুৎ গতির আক্রমণ মনে করেছিলেন। এটা তার পশ্চিমাদের প্রতি বৈরিতাপূর্ণ নীতির চূড়ান্ত রূপ।

পুতিন এখন সেই একই দ্বিধার পড়েছেন। যতটা সম্ভব ভূখণ্ড দখল করে নেওয়া এবং দখল করা অঞ্চলের ওপর বৈধতা প্রতিষ্ঠা—এই দুয়ের মধ্যে কোন পথটি তিনি বেছে নেবেন। স্তালিনও একসময় দ্বিধায় থেকে শেষ পর্যন্ত যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, পুতিনও সম্ভবত সেই পথেই হাঁটবেন।

এসব প্রচেষ্টা রাশিয়ার ভেতরে পুতিনের সমর্থন জয় করে নেওয়ার জন্য চোখে পড়ার মতো সফল ছিল। তবে একই সঙ্গে এগুলো রাশিয়া ও পশ্চিমের সম্পর্ক ভাঙার নয়; বরং তা নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টাও ছিল। এমনকি ক্রিমিয়া দখল ও পূর্ব ইউক্রেনে সংঘাতের পরও ক্রেমলিন আলোচনার পথ অনুসরণ করে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো মিনস্ক চুক্তি। এর লক্ষ্য ছিল কূটনৈতিক একঘরে অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনার টেবিলে নিজের আসন পুনরুদ্ধার করা। সেই প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হয় এবং পুতিন আরও ঝুঁকি বাড়ানোর পথ বেছে নেন। এখন ক্রেমলিন কিছু মাত্রায় নমনীয়তা দেখাতে প্রস্তুত।

সব অনমনীয় কথাবার্তার পরও ক্রেমলিন এরই মধ্যে কিছু চরম অবস্থান থেকে সরে এসেছে। মার্চ মাসে পুতিন ইউক্রেনকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রদান কিংবা যেকোনো আলোচনা শুরুর পূর্বশর্ত হিসেবে ইউক্রেনের নির্বাচন দেওয়ার মতো ধারণাগুলো নিয়ে এসেছিলেন। মস্কো এখন আর জোর দিয়ে বলছে না যে ইউক্রেনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা অর্থহীন এবং যেকোনো প্রকৃত চুক্তির আগে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা নিষিদ্ধকারী আইন বাতিলের জন্য ইউক্রেনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে দাবি তোলা হয়েছিল, সেখান থেকেও রাশিয়া নীরবে সরে এসেছে।

নিশ্চয়ই এ নতুন নমনীয়তারও একটা সীমা আছে। মস্কো এর মূল দাবিগুলো এখনো পরিত্যাগ করেনি। কারণ, গত তিন বছরে রাশিয়া এক যুদ্ধরত দেশে পরিণত হয়েছে। শত্রু হয়ে উঠেছে একপ্রকার পৌরাণিক শয়তান, সেনারা এখন নায়ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বেশি মানুষ আর কোনো যুদ্ধে নিহত বা আহত হননি। যুদ্ধ-অর্থনীতি সচল হয়ে উঠেছে; ভিন্নমত গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি পুতিন নিজেও এখন প্রায়ই ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ না বলে সরাসরি ‘যুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। যুদ্ধ যত দীর্ঘ ও বিস্তৃত হয়, এর ফলাফল ততই বিশ্বাসযোগ্য ও জোরালো হতে হয়।

এখানেই আসে দর-কষাকষির বিষয়টি। ক্রেমলিন স্পষ্টতই দর–কষাকষির বিষয়টাকে এমন একটা হিসেবে দেখছে, যেন সেখানে তারা একটি বিজয় দাবি করতে পারে, যেটা তারা যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জন করতে পারেনি। রাশিয়া কেন ইউক্রেনকে এমন সব এলাকা থেকেও সরে যাওয়ার দাবি তুলেছে, যেগুলোর ওপর দেশটির নিয়ন্ত্রণই নেই—এর ব্যাখ্যা এখান থেকে পাওয়া যায়। পুতিনের কাছে বিজয় মানে শুধু ভূখণ্ড দখল নয়। তাঁর কাছে বিজয় মানে, শর্ত চাপিয়ে দেওয়া, নতুন করে সীমান্ত আঁকা এবং সেই নতুন বাস্তবতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়। এভাবেই পুতিন তাঁর কাঙ্ক্ষিত বৈধতা নিশ্চিত করতে পারেন।

পুতিনের এ অবস্থান বুঝতে পারাটা মোটেই কঠিন নয়। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনে থাকা পুতিনের প্রতি সবচেয়ে সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরাও মনে করেন যে পুতিন অনেক বেশি দাবি করছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হতাশা স্পষ্টতই বাড়ছে। শান্তির জন্য তাঁর ৫০ দিনের সময়সীমা এখন কমে এসে ‘১০ বা ১২ দিনে’ দাঁড়িয়েছে, যা তাঁর ধৈর্য ফুরিয়ে আসারই প্রমাণ। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধক্লান্তির লক্ষণ ও বেদনাদায়ক আপসের বিষয়টি বিবেচনা করা সত্ত্বেও এটা বিশ্বাস করার এমন কোনো কারণ নেই যে মস্কোর চূড়ান্ত শর্ত মেনে নেবে। এমনকি এর কিছু অংশে যদি ওয়াশিংটন সমর্থন দেয়, তারপরও সেটা নয়।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হতাশা স্পষ্টতই বাড়ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পুতিন এমন কিছু চান, যা তিনি কখনোই পাবেন না