তখন কোরবানি ছিল একান্ত ঘরোয়া, আজ কোথাও কোথাও তা প্রতিযোগিতার
Published: 7th, June 2025 GMT
১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়, মাত্র চার বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ভারত থেকে খুলনায় এসেছিলাম। সেই থেকে এই মাটিতেই বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, কর্মজীবন আর জীবনের সব আনন্দ-বেদনার গল্প। ঈদ এসেছে, ঈদ গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে তার স্মৃতিগুলো, প্রতিটি সময়ের নিজস্ব রঙে রাঙানো। আজ ৮২ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে বুঝি, ঈদ কেবল উৎসব নয়, এটা সময়ের আয়নায় বদলে যাওয়া সমাজ ও জীবনের এক নিঃশব্দ সাক্ষী।
এখনকার ঈদ মানে আলোকসজ্জা, তোরণ আর প্যান্ডেলের জৌলুশ; সেই সময়ের ঈদ ছিল অনেকটাই সাদামাটা, কিন্তু তার আন্তরিকতা ছিল গভীর। খুলনা সার্কিট হাউসে ঈদের প্রধান জামাত হতো, তবে এখনকার মতো উপচে পড়া ভিড় ছিল না। মানুষ নামাজ আদায় করতেন, কোলাকুলি করতেন, একে অপরের খোঁজখবর নিয়ে ঘরে ফিরে যেতেন পরিতৃপ্ত মন নিয়ে। বিশাল আয়োজন না থাকলেও ছিল নির্মল আনন্দ আর সহমর্মিতা। টাউন জামে মসজিদেও হতো বড় জামাত।
ঈদের আরেক চিরচেনা অনুষঙ্গ ছিল সিনেমা দেখা। ঈদের সময় হলে কলকাতা ও পাকিস্তানের নতুন সিনেমা মুক্তি পেত। হলের সামনে লম্বা লাইন পড়ত, টিকিট পাওয়া ছিল ভীষণ কষ্টসাধ্য। এমনকি টিকিট কালোবাজারিও হতো। এক শ্রেণির মানুষের কাছে ঈদটা যেন সিনেমা না দেখলে অপূর্ণই থেকে যেত। আজকের প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে যেখানে মুঠোফোনের এক স্পর্শে বিনোদন হাতের মুঠোয়, সেখানে টিকিট পাওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করাটা হয়তো অবিশ্বাস্য মনে হবে।
কোরবানির পশুর হাটের স্মৃতিগুলোও বেশ স্বতন্ত্র। রূপসা নদীর অন্য পারে পূর্বরূপসায়, যেখানে খুলনা থেকে বাগেরহাট ট্রেন যাওয়ার স্টেশন ছিল, সেখানে বসত পশুর হাট। ডুমুরিয়ার শাহপুরের হাটও ছিল বেশ বড়। পাঁচ-ছয় দিন ধরে পশুর বেচাকেনা চলত, শেষ দুই দিন আগে কেনাকাটা জমে উঠত। অবাক করা বিষয় হলো, তখন খুলনা শহরের খুব বেশি মানুষ গরু কোরবানি দিত না, ছাগল কোরবানির চলটাই ছিল বেশি।
আজকাল যেমন বিশাল আকারের গরুগুলো গলায় মালা পরে প্রদর্শিত হয়, সে সময় এমনটা ছিল না। বড় গরু তখন সহজে পাওয়া যেত না, আর রাস্তাঘাটও এত ভালো ছিল না যে হাট থেকে গরু আনা সহজ হবে। তাই গ্রামের দিকে অবস্থাপন্নরা গরু কোরবানি দিলেও শহরে ছাগল কোরবানির চলই ছিল বেশি। আমাদের বাসাতেও ছাগল কোরবানি দেওয়া হতো। কসাইও এত ছিল না তখন, তাই অনেকেই ঈদের দ্বিতীয় দিনে কোরবানি দিতেন। তখন কোরবানির আয়োজন ছিল একান্ত ঘরোয়া। সেদিনের সেই সহজ জীবনযাত্রার সঙ্গে আজকের এই বৈচিত্র্যময় কোরবানি বাজারকে মেলাতে গেলে এক অন্য রকম অনুভূতি হয়।
পোশাক বা আপ্যায়নের ক্ষেত্রেও সে দিনের ঈদ ছিল ভিন্ন। এখনকার ছেলেমেয়েরা যেমন নিজেদের মতো করে বাইরে চলে যায়, আমাদের সময় সেই সাহস ছিল না। কোরবানির পর মাংস নিয়ে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় যেতাম, কখনো তারা জোর করে খাইয়ে দিতেন। আবার কখনো বাসায় কোরবানি দেওয়ার জায়গায় একটা ঝুড়িতে কিছু মাংস নিয়ে বসে থাকতাম, গরিব কেউ এলে সেখান থেকে কিছুটা দিতাম। এখন অনেক কিছুই রয়েছে, কিন্তু সেই আন্তরিকতার ঘনত্বটা যেন ফিকে হয়ে গেছে।
আজকের পয়সার আধিক্য আর জৌলুশ তখন ছিল না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছিল সীমিত, প্রতিটা ঘর কমবেশি এক রকম ছিল। সমাজব্যবস্থাটা ছিল অভিভাবকনির্ভর; অভিভাবকেরা যেটা দিতেন, তা-ই পরতে হতো। আবদার করার সুযোগ খুব বেশি ছিল না। যেহেতু রোজার ঈদে সবাই নতুন পোশাক পেত, কোরবানির ঈদে নতুন পোশাক পাওয়ার সম্ভাবনা বেশ কমই থাকত। কোরবানির ঈদে নতুন জামা দেওয়া অভিভাবকদের কাছে অনেকটা বিলাসিতা মনে হতো। ঈদের দিন একটু বিশেষ রান্না হতো, তবে পদের বাহার ছিল না। সাধারণত পোলাও, মাংস। এই সরলতাই হয়তো তখনকার দিনগুলোকে আরও সুন্দর করে তুলেছিল।
ঈদের দিনে নদীতে নৌকাবাইচ হতো, লাঠিখেলা হতো, ষাঁড়ের লড়াই কিংবা দড়ি টানা খেলায় মাতত পাড়া-প্রতিবেশীরা। এখন সেসব আয়োজন হয় খুবই সীমিতভাবে। তখন ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে কার্ড পাঠানোর রীতি ছিল। ঈদের আগে দোকানগুলোয় বাহারি কার্ড বিক্রি হতো। ডাকযোগে পাঠানো হতো কার্ড। ডাকপিয়নের অপেক্ষা করতাম সবাই। মাঝেমধ্যে লোকমারফতও কার্ড আসত। আজ প্রযুক্তির ছোঁয়ায় শুভেচ্ছা পৌঁছে যায় মুহূর্তে; কিন্তু কী যেন হারিয়ে গেছে, শুধু গতিই আছে, গভীরতা নেই।
তখন প্রাচুর্য ছিল না, কিন্তু তবু আনন্দ ছিল গভীর, আন্তরিক। ঈদের মেজাজ ছিল আত্মার, হৃদয়ের। আজ ঈদের আগে বাজারে হঠাৎ দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন হয়, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার লোভে আজ পণ্যের দাম বাড়ায়, উৎসবকে ঘিরে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিপরায়ণদের দৌরাত্ম্য দেখা যায়। কোনো কোনো রাজনীতিক ঈদের নামে প্রচারে মেতে ওঠেন। অনেকেই পশু কোরবানির চেয়ে তার প্রদর্শনী নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। একসময় যেখানে ঈদ ছিল আন্তরিকতার প্রতীক, আজ কোথাও কোথাও তা হয়ে উঠেছে প্রতিযোগিতার মাঠ।
আজ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে, ঈদের দিনে যাঁদের সঙ্গে হেসেছি, খেয়েছি, মিশেছি—তাঁরা অনেকেই আজ নেই। তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করি।
এই বয়সে এসে বুঝি, ঈদের প্রকৃত আনন্দ ছিল একে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে, ছিল হৃদয়স্পর্শী আন্তরিকতার মধ্যে। সেই ঈদে ছিল না প্রাচুর্য, ছিল না মুঠোফোন, ফেসবুক বা টিভির ঝলমলে অনুষ্ঠান। কিন্তু ছিল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর অকৃত্রিম সম্পর্কের বন্ধন। আজও ঈদ আসে, আনন্দ বয়ে আনে। কিন্তু পুরোনো দিনের সরল ঈদগুলো থেকে যায়-মনোজগতে, অনুভবের গহিনে; অলক্ষ্যে জ্বলতে থাকা এক উজ্জ্বল আলো হয়ে।
(অনুলিখন: উত্তম মণ্ডল, খুলনা)
লেখক: সাবেক কোষাধ্যক্ষ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক রব ন র ঈদ র দ র সময় আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
পুলিশের এখনকার ভূমিকার প্রশংসায় বিএনপির মাহদী আমিন
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এসে পুলিশের আচরণে পরিবর্তন দেখছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন।
মাহদী আমিন বলেছেন, ‘অন্ততপক্ষে গত এক বছরে পুলিশকে দেখছি আমরা অনেক কমফোর্টেবল একটা জায়গা থেকে। আমাদের রেসপেক্ট হচ্ছে। আজকে এভাবে কথা বলছি বা ফ্রিলি কমপ্লেন দিতে পারছি।’
আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কার: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন মাহদী আমিন। যৌথভাবে এ গোলটেবিলের আয়োজন করে প্রথম আলো ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতি। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।
বৈঠকে আলোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের আমলের পুলিশকে প্রশংসায় ভাসানোর আগে আওয়ামী লীগ আমল নিয়ে সমালোচনা করেন মাহদী আমিন। তখন বিএনপি সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘দেখা গেছে, বিএনপির অনেক নেতা আছে, যাদের নামে ৩০০, ৪০০ বা সাড়ে ৪০০ করে মামলা হচ্ছে। গায়েবি মামলা, যিনি মারা গিয়েছেন, ওনার নামেও মামলা হচ্ছে। বিদেশে আছেন, ওনার নামেও মামলা হচ্ছে।’
মাহদী আমিন বলেন, ‘হিউম্যান রাইটসের ক্ষেত্রে পুলিশের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল মানবাধিকার ধরে রাখা, তারাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল, একটা অংশ। বাক্স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার বদলে বাক্স্বাধীনতা হরণ করেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে আইন লঙ্ঘন করেছে।’
আরও পড়ুনমাঝেমধ্যে শুনতে হয়, ‘উনি কি আমাদের লোক’: আইজিপি১ ঘণ্টা আগেপুলিশকে ‘রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠনের মত’ ব্যবহার বন্ধ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দেন তারেক রহমানের উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। ভবিষ্যতে যারা সরকারে আসবে, সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব তাদের। এর সঙ্গে জড়িত সব অংশীজনকেও পরিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
পুলিশের সামাজিক মর্যাদা ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে মাহদী আমিন বলেন, ‘আমরা ও যারা ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসবে, কীভাবে আরও ডিগনিটি দেওয়া যায়, আরও রেসপেক্ট নিশ্চিত করা যায়, একটা সোশ্যাল মর্যাদা নিশ্চিত করা যায়, তার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
আরও পড়ুনগোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার না হলে পুলিশ সংস্কার অর্জিত হবে না: ইফতেখারুজ্জামান২ ঘণ্টা আগেস্বাধীন পুলিশ কমিশন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক মতৈক্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন মাহদী আমিন।
এই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতির সভাপতি এম আকবর আলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, পুলিশের অতিরিক্ত আইজি কাজী মো. ফজলুল করীমও বৈঠকে অংশ নেন।
আরও পড়ুন‘আমার লোক, তোমার লোক’ ব্যাধি থেকে দলগুলোকে বের হতে হবে: আসিফ নজরুল২ ঘণ্টা আগে