নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন নিশ্চিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) পাঁচ ধরনের পরীক্ষা করার সুপারিশ করে। তবে বাংলাদেশসহ নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ২৪ শতাংশ রক্ত পরিসঞ্চালনে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। এতে উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে রক্তগ্রহীতার জীবন। এমন পরিস্থিতি উত্তরণে রক্তদানে গুণগত মান নিশ্চিতে জাতীয় কর্মসূচি নেওয়া জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। 
এমন প্রেক্ষাপটে আজ শনিবার বিশ্ব রক্তদাতা দিবস পালিত হচ্ছে। ডব্লিউএইচওর নীতিনির্ধারণী ফোরাম ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেমব্লি ২০০৫ সালে ১৪ জুনকে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি 
দেয়। এর পর থেকে দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য– ‘রক্ত দিন, আশার আলো দিন, এক সাথে আমরা  জীবন বাঁচাই’।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্ত পরীক্ষায় মান নিয়ন্ত্রণ, প্রশিক্ষিত জনবল এবং উন্নত যন্ত্রপাতির অভাবে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্রগুলোতে নেই পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা বা সঠিকভাবে মানসম্মত পরীক্ষা করার সুযোগ।
ডব্লিউএইচওর ২০২২ সালের জুনে প্রকাশিত গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট ও ব্লাড সেফটি অ্যান্ড অ্যাভেইলেবিলিটি শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝুঁকি এড়াতে রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে গ্রুপ নির্ণয়, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভি ও সিফিলিসের ভাইরাস পরীক্ষা করতে হয়। সরকারিভাবে এ পরীক্ষায় বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ৭৬ দশমিক ২ শতাংশ রক্তদানের সময় পরীক্ষা করা হয়। বাকি ২৩ দশমিক ৮০ শতাংশ রক্ত পরিসঞ্চালনে মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা.

আসাদুল ইসলাম বলেন, জাতীয় কর্মসূচির মাধ্যমে নজরদারি বাড়িয়ে রক্ত নেওয়ার আগে আইন করে পাঁচ ধরনের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। দেশব্যাপী ব্লাড ব্যাগ, কিটস এবং রি-এজেন্ট সরকারি ব্যবস্থাপনায় দিতে হবে। তা না হলে নিরাপদ রক্তদান বাড়ানো যাবে না। এ ছাড়া বিদেশের মতো কেন্দ্রীয়ভাবে রক্ত সংগ্রহ করে ব্লাড ব্যাংকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বে সব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন একটি অত্যাবশ্যকীয়  সেবা। নিরাপদ রক্তের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হলে প্রতিটি দেশকে অবশ্যই স্বেচ্ছায় নিয়মিত রক্তদানের একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। দেশগুলোতে সন্তান ধারণের উপযুক্ত বয়সী নারী ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরাই সবচেয়ে বেশি রক্ত গ্রহণ করে। সরকার এবং  স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে স্বেচ্ছাসেবী,  রক্তদাতার সংখ্যা বাড়ানো এবং সবার জন্য নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড থ্যালাসেমিয়া ম্যানেজমেন্ট শাখার তথ্যমতে, দেশে অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসায় প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ব্যাগ রক্ত লাগে। এ রক্ত আমরা দু’ভাবে পেয়ে থাকি। আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ৬৬ শতাংশ। স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতার মাধ্যমে ৩৪ শতাংশ। রক্তদাতাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৬ শতাংশ নারী। সারাদেশে সরকারিভাবে ২২৩টি ব্লাড ব্যাংক বা রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র রয়েছে। এর বাইরে নিবন্ধন ছাড়া অনেক ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের তদারকির দায়িত্বে রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে জনবল সংকটে তাদের দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ব্লাড ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশরাফুল হক বলেন, রক্তদানের আগে যেসব ডিভাইস দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া রক্তদানের আগে পাঁচ পরীক্ষা করা জরুরি। অনেক সরকারি হাসপাতালে এটি হচ্ছে। এর পরও রক্তগ্রহীতাদের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যেমন, নিয়মিত ডায়ালাইসি করে এমন রোগীর ছয় মাস পর হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ, রক্ত নেওয়ার আগে স্ক্রিনিংয়ে মান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জিল্লুর রহমান বলেন, সংরক্ষিত রক্ত মানুষ নিতে চায় না। ৯০ শতাংশের বেশি রোগী যে কোনোভাবে রক্তদাতা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। রক্তের চাহিদার বেশির ভাগই পূরণ হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবীর মাধ্যমে।

বরাদ্দের তথ্য দিতে না পারলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড থ্যালাসেমিয়া ম্যানেজমেন্ট শাখার ডেপুটি 
প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আতাউল করিম বলেন, প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতে বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এতে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন অনেকটা নিশ্চিত করা যাবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড থ্যালাসেমিয়া ম্যানেজমেন্ট কর্মসূচি রয়েছে। রক্তদানের আগে পাঁচ পরীক্ষা করতে সরকারি হাসপাতালে নির্দেশনা দেওয়া হবে।

রক্তের চাহিদা বাড়ছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, দিনে দিনে রক্তের চাহিদা যে হারে বাড়ছে, সে হারে পেশাদার বা স্বেচ্ছা রক্তদাতার সংখ্যা বাড়ছে না। স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের যে সংখ্যা, তা চাহিদার তুলনায় কম। ফলে রক্তের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এ জন্য স্বেচ্ছায় রক্তদানে আরও বেশি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের সবচেয়ে পুরোনো স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠন সন্ধানী। তাদের হিসাবে, দেশে বছরে ৬ লাখ ব্যাগের মতো রক্তের চাহিদা রয়েছে। যার মধ্যে ১২ শতাংশ পূরণ করছেন বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা। প্রায় ৬০ শতাংশের মতো আসে পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে। বাকিটা স্বজন, বন্ধু ও পরিচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেওয়া হয়। রক্তদাতাদের বেশির ভাগ তরুণ ও শিক্ষার্থী।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: রক ত র চ হ দ ন শ চ ত কর হ প ট ইট স ব যবস থ ন র আগ শ রক ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বিদেশে গিয়েও সুদিন ফেরেনি, কলা চাষে এল সাফল্য

দীর্ঘদিনের পরিত্যক্ত এক একর জমি এখন সবুজে আচ্ছাদিত। সেখানে দেড় বছর আগে রোপণ করা হয় ৩২০টি কলা গাছ। সঠিক পরিচর্যা পেয়ে গাছগুলো সুস্থ ও সবল হয়ে বেড়ে উঠেছে। সারি সারি কলাগাছে ঝুলছে কলার ছড়া। মেহের সাগর জাতের এই কলা চাষে সুদিন ফিরেছে বিদেশ ফেরত আবু সিদ্দিকের।

আবু সিদ্দিক (৫৫) চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বাসিন্দা। স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। ২০১৭ সালে জীবিকার তাগিদে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। সেখানে শারীরিক অসুস্থতার কারণে অধিকাংশ সময় বেকার থেকেছেন। তাই প্রবাসে গিয়েও সচ্ছলতার মুখ দেখেননি। ২০২৪ সালে দেশে ফিরে আসেন সিদ্দিক। স্থানীয় বাজারগুলোতে সারা বছর চাহিদা থাকায় কলা চাষের উদ্যোগ নেন, তবে তাঁর নিজের কোনো জমি নেই।

লোহাগাড়া উপজেলা সদর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে আট কিলোমিটার দক্ষিণে চুনতি শাহ সাহেব গেট। সেখান থেকে চুনতি ইসহাক মিয়া সড়ক ধরে গেলে হাতের ডানে একটি মাঠের পর চুনতি সুফি নগর বাগানপাড়া এলাকায় আবু সিদ্দিকের কলাবাগানটি চোখে পড়ে।

আবু সিদ্দিক বলেন, খুঁজতে খুঁজতে বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে পরিত্যক্ত এক একর জমি চোখে পড়ে তাঁর। বছরে ছয় হাজার টাকায় ওই জমি ভাড়া নেন। কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে গত বছরের জুনে শুরু করেন কলা চাষ। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪০ টাকা দরে ৩২০টি চারা সংগ্রহ করেন তিনি। এতে তাঁর খরচ হয় ১৩ হাজার টাকা। রোপণের ১০ মাস পর কলা বিক্রির উপযোগী হয়। সাত মাস আগে থেকেই তিনি কলা বিক্রি শুরু করেছেন। শ্রমিকের মজুরি, সার, কীটনাশক ও নিয়মিত সেচ বাবদ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। প্রতিটি ছড়া গড়ে ৫০০ টাকা দরে গত ৭ মাসে আড়াই লাখ টাকার কলা বিক্রি করেছেন তিনি। এখন খরচ বাদে কলা ও গাছের চারা বিক্রি করে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পান সিদ্দিক।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, ১ একর আয়তনের জমিতে ৬ ফুট দূরত্বে রোপণ করা হয়েছে ৩২০টি মেহের সাগর জাতের কলাগাছ। একটি গাছ থেকে নতুন চারা গজিয়ে আরও চার থেকে পাঁচটি গাছ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি আট ফুট উচ্চতার প্রাপ্তবয়স্ক গাছে ঝুলছে কলার ছড়া। একেকটি ছড়ায় রয়েছে ৮০ থেকে ১৫০টি কলা। আবু সিদ্দিক সেখানে কলাগাছের আগাছা পরিষ্কার করছিলেন।

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, ১ একর আয়তনের জমিতে ৬ ফুট দূরত্বে রোপণ করা হয়েছে ৩২০টি মেহের সাগর জাতের কলাগাছ। একটি গাছ থেকে নতুন চারা গজিয়ে আরও চার থেকে পাঁচটি গাছ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি আট ফুট উচ্চতার প্রাপ্তবয়স্ক গাছে ঝুলছে কলার ছড়া। একেকটি ছড়ায় রয়েছে ৮০ থেকে ১৫০টি কলা।

কলা চাষে সফলতার মুখ দেখে উৎসাহিত হয়ে এক মাস আগে আধা কিলোমিটার দূরত্বে নতুন করে ২ বিঘা জমিতে আরও ৬০০টি কলাগাছ লাগিয়েছেন সিদ্দিক। তিনি বলেন, কলা চাষে প্রথমবার চারা কিনতে যে ব্যয় হয়েছিল, পরের বার তা ব্যয় হবে না। খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে। প্রতিবছর চারা বিক্রির টাকা দিয়ে খরচ মেটানো সম্ভব হবে। এতে এক একর এই বাগান থেকে খরচ বাদে প্রতিবছর সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় হবে তাঁর। স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ীরা বাগানে এসে কলা নিয়ে যান। তাই বাড়তি শ্রম ও পরিবহন খরচ দিয়ে বাজারে নিয়ে যেতে হয় না। জমি পেলে কলা চাষের পরিধি বাড়াবেন বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে লোহাগাড়া উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সরোয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, কঠোর পরিশ্রমের কারণে আবু সিদ্দিক সফল হয়েছেন। তাঁকে প্রণোদনা হিসেবে সার ও অর্থসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। লোহাগাড়ার আবহাওয়া ও মাটি কলা চাষের জন্য উপযোগী। তা ছাড়া এ অঞ্চলে কলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ