চা-বাগানের এক শ্রমিকের বাড়িতে পানি চাইতে গিয়ে চমকে যান তিনজন ভ্রমণকারী। ঘরের মেঝেতে মাটির গর্তে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এক শিশুকে, আর তার মা খাওয়াচ্ছিলেন।

ঘটনাটি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের ভারত সীমান্তঘেঁষা মুরইছড়া চা-বাগানের। পরে জানা গেল, শিশুটি ‘সেরেব্রাল পালসি’ রোগে আক্রান্ত। এ কারণে স্বাভাবিকভাবে সে দাঁড়াতে পারে না। অর্থের অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছে না পরিবার।

সম্প্রতি ঈদের ছুটিতে মুরইছড়া বাজারে ঘুরতে গিয়ে স্থানীয় শিক্ষক ও কবি সঞ্জয় দেবনাথ, তাঁর বোন আইনজীবী মূর্ছনা দেবী এবং তাঁদের বন্ধু কালিটি চা-বাগানের শ্রমিক দয়াল অলমিক এই দৃশ্য দেখতে পান।

আজ রোববার সকালে সঞ্জয় দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শিশুটির বিষয়ে আগে কিছুই জানতাম না। মুরইছড়া বাজারে একটি মিষ্টির দোকানে গিয়ে মিষ্টি খাচ্ছিলাম। দয়াল পানি নিয়ে ফিরে এসে ঘটনাটি খুলে বলেন। দুই-তিন ঘণ্টা সেখানে থেকে শিশুটির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি।’ পরে তিনি ফেসবুকে ছবিসহ একটি মানবিক পোস্ট দেন।

শিশুটির নাম গোপাল সাঁওতাল। বয়স সাড়ে তিন বছর। মা সনছড়ি সাঁওতাল, বাবা অনিল সাঁওতাল মুরইছড়া চা-বাগানের শ্রমিক। তাঁরা বাগানের স্কুলটিলা এলাকায় বসবাস করেন।

সঞ্জয় বলেন, শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হওয়ার পর মা–বাবা বুঝতে পারেন, সে দাঁড়াতে পারে না, কথাও ঠিকমতো বলতে পারে না। পরে তাঁরা তাকে সিলেটের একটি পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যান। চিকিৎসকেরা জানান, নিয়মিত ফিজিওথেরাপিই একমাত্র চিকিৎসা। কিন্তু অর্থাভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেননি অনিল সাঁওতাল।

সঞ্জয় বলেন, শিশুটি স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াতে পারে না। কোমরের নিচের অংশে শক্তি নেই। এমনকি এ বয়সে একটি শিশু যেভাবে কথাবার্তা বলে, সেটিও পারে না। তিনি জানান, শিশুটি খিদে পেলে কাঁদে। কিন্তু মা সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। কোলে বেশি সময় নিতে পারেন না। বাবা সকালেই কাজে চলে যান। এই অবস্থায় মা ঘরের মেঝেতে ছোট একটি গর্ত করে সেখানে দাঁড় করিয়ে খাওয়ান। খাওয়ানো শেষে কোলে তুলে ঘুম পাড়িয়ে দেন। ঘুমানোর সময়ও শিশুটি সোজা হয়ে ঘুমাতে পারে না, ভাঁজ হয়ে থাকে। অনেক সময় গর্তে দাঁড়িয়ে খেলাধুলা করে।

শিশুটির বাবা অনিল সাঁওতাল দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। এই আয়ে সংসার চালানোই কষ্টসাধ্য, চিকিৎসা করানো আরও কঠিন। সঞ্জয় বলেন, ‘শিশু গোপাল একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, হাঁটতে পারবে, অন্য শিশুদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে—এটাই স্বপ্ন দেখেন তার মা–বাবা।’

সঞ্জয়ের ফেসবুক পোস্টের পর কয়েকজন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তবে শিশুটির পরিবারের কোনো মুঠোফোন নেই। সঞ্জয় বলেন, তাঁদের একটি মুঠোফোন কিনে দেওয়া হবে। বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলা হলে সহায়তাও সহজ হবে।

এ বিষয়ে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, ফেসবুকে ছবিগুলো দেখে তাঁর মনে হয়েছে, শিশুটি ‘সেরেব্রাল পালসি’তে আক্রান্ত। জন্মের সময় মাথায় আঘাত লাগলে এমনটা হতে পারে। নিয়মিত ফিজিওথেরাপিই চিকিৎসাপদ্ধতি। তিনি বলেন, ‘শিশুটির অভিভাবকেরা যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন, তাহলে চিকিৎসাসেবাসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া যেত।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো.

মহিউদ্দিন আজ রোববার বলেন, ‘সঞ্জয়ের ফেসবুক পোস্টের পর আমরা শিশুটির খোঁজ নিয়েছি। আজই তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আনা হবে। মৌলভীবাজার জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে বিনা মূল্যে ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থাও আছে। শিশুটিকে সেখানে পাঠানো হবে।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ফ সব ক

এছাড়াও পড়ুন:

বিদেশে গিয়েও সুদিন ফেরেনি, কলা চাষে এল সাফল্য

দীর্ঘদিনের পরিত্যক্ত এক একর জমি এখন সবুজে আচ্ছাদিত। সেখানে দেড় বছর আগে রোপণ করা হয় ৩২০টি কলা গাছ। সঠিক পরিচর্যা পেয়ে গাছগুলো সুস্থ ও সবল হয়ে বেড়ে উঠেছে। সারি সারি কলাগাছে ঝুলছে কলার ছড়া। মেহের সাগর জাতের এই কলা চাষে সুদিন ফিরেছে বিদেশ ফেরত আবু সিদ্দিকের।

আবু সিদ্দিক (৫৫) চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বাসিন্দা। স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। ২০১৭ সালে জীবিকার তাগিদে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। সেখানে শারীরিক অসুস্থতার কারণে অধিকাংশ সময় বেকার থেকেছেন। তাই প্রবাসে গিয়েও সচ্ছলতার মুখ দেখেননি। ২০২৪ সালে দেশে ফিরে আসেন সিদ্দিক। স্থানীয় বাজারগুলোতে সারা বছর চাহিদা থাকায় কলা চাষের উদ্যোগ নেন, তবে তাঁর নিজের কোনো জমি নেই।

লোহাগাড়া উপজেলা সদর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে আট কিলোমিটার দক্ষিণে চুনতি শাহ সাহেব গেট। সেখান থেকে চুনতি ইসহাক মিয়া সড়ক ধরে গেলে হাতের ডানে একটি মাঠের পর চুনতি সুফি নগর বাগানপাড়া এলাকায় আবু সিদ্দিকের কলাবাগানটি চোখে পড়ে।

আবু সিদ্দিক বলেন, খুঁজতে খুঁজতে বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে পরিত্যক্ত এক একর জমি চোখে পড়ে তাঁর। বছরে ছয় হাজার টাকায় ওই জমি ভাড়া নেন। কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে গত বছরের জুনে শুরু করেন কলা চাষ। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪০ টাকা দরে ৩২০টি চারা সংগ্রহ করেন তিনি। এতে তাঁর খরচ হয় ১৩ হাজার টাকা। রোপণের ১০ মাস পর কলা বিক্রির উপযোগী হয়। সাত মাস আগে থেকেই তিনি কলা বিক্রি শুরু করেছেন। শ্রমিকের মজুরি, সার, কীটনাশক ও নিয়মিত সেচ বাবদ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। প্রতিটি ছড়া গড়ে ৫০০ টাকা দরে গত ৭ মাসে আড়াই লাখ টাকার কলা বিক্রি করেছেন তিনি। এখন খরচ বাদে কলা ও গাছের চারা বিক্রি করে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পান সিদ্দিক।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, ১ একর আয়তনের জমিতে ৬ ফুট দূরত্বে রোপণ করা হয়েছে ৩২০টি মেহের সাগর জাতের কলাগাছ। একটি গাছ থেকে নতুন চারা গজিয়ে আরও চার থেকে পাঁচটি গাছ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি আট ফুট উচ্চতার প্রাপ্তবয়স্ক গাছে ঝুলছে কলার ছড়া। একেকটি ছড়ায় রয়েছে ৮০ থেকে ১৫০টি কলা। আবু সিদ্দিক সেখানে কলাগাছের আগাছা পরিষ্কার করছিলেন।

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, ১ একর আয়তনের জমিতে ৬ ফুট দূরত্বে রোপণ করা হয়েছে ৩২০টি মেহের সাগর জাতের কলাগাছ। একটি গাছ থেকে নতুন চারা গজিয়ে আরও চার থেকে পাঁচটি গাছ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি আট ফুট উচ্চতার প্রাপ্তবয়স্ক গাছে ঝুলছে কলার ছড়া। একেকটি ছড়ায় রয়েছে ৮০ থেকে ১৫০টি কলা।

কলা চাষে সফলতার মুখ দেখে উৎসাহিত হয়ে এক মাস আগে আধা কিলোমিটার দূরত্বে নতুন করে ২ বিঘা জমিতে আরও ৬০০টি কলাগাছ লাগিয়েছেন সিদ্দিক। তিনি বলেন, কলা চাষে প্রথমবার চারা কিনতে যে ব্যয় হয়েছিল, পরের বার তা ব্যয় হবে না। খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে। প্রতিবছর চারা বিক্রির টাকা দিয়ে খরচ মেটানো সম্ভব হবে। এতে এক একর এই বাগান থেকে খরচ বাদে প্রতিবছর সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় হবে তাঁর। স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ীরা বাগানে এসে কলা নিয়ে যান। তাই বাড়তি শ্রম ও পরিবহন খরচ দিয়ে বাজারে নিয়ে যেতে হয় না। জমি পেলে কলা চাষের পরিধি বাড়াবেন বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে লোহাগাড়া উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সরোয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, কঠোর পরিশ্রমের কারণে আবু সিদ্দিক সফল হয়েছেন। তাঁকে প্রণোদনা হিসেবে সার ও অর্থসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। লোহাগাড়ার আবহাওয়া ও মাটি কলা চাষের জন্য উপযোগী। তা ছাড়া এ অঞ্চলে কলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ