আমরা কোরআন তিলাওয়াত করার সময় প্রতিটি সুরার শুরুতেই আয়াত সংখ্যার সঙ্গে ‘রুকু’ সংখ্যাও লেখা দেখি। পৃষ্ঠার মাঝেও রুকু লেখা থাকে। এই রুকু মানে কী? কী কাজ এই রুকুর?
এই প্রবন্ধে রুকুর ধারণা, কোরআন তিলাওয়াতের সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং কোরআনে রুকুর সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
রুকু কীরুকু আরবি শব্দ, যার অর্থ ‘নমন’ বা ‘বাঁকানো’। নামাজে রুকু বলতে কোমর ঝুঁকিয়ে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অঙ্গভঙ্গিকে বোঝায়।
তবে কোরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে রুকু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকলনকে বোঝায়, যা তিলাওয়াতকে সংগঠিত ও সহজতর করে। এটি বিশেষ করে হাফেজদের (যাঁরা কোরআন মুখস্থ করেন) জন্য সুবিধাজনক।
ইমাম সারাখসি (মৃ.৪৮৩ হি.) রুকুকে রাকাতের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বলেছেন, এক রাকাতে তিলাওয়াতের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকেত হিসেবে রুকু ব্যবহৃত হতো।কোরআন তিলাওয়াতে রুকুর ভূমিকা
রুকু নির্ধারণের উদ্দেশ্য ছিল তিলাওয়াতের সময় আয়াতের বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং বিরতি নেওয়ার সুবিধা প্রদান। ইসলামের প্রাথমিক যুগে, বিশেষ করে হাফেজরা তিলাওয়াতের পর নির্দিষ্ট আয়াতে এসে রুকুতে যেতেন, যা এই প্রথার উৎপত্তির ইঙ্গিত দেয়।
ঐতিহাসিকভাবে রুকু নির্ধারণের প্রথা মা-ওয়ারাউন্নাহার (বুখারা, সমরখন্দ) অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এটি তারাবিহ নামাজের সময় কোরআন তিলাওয়াতকে সংগঠিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
ইমাম সারাখসি (মৃ. ৪৮৩ হি.) রুকুকে রাকাতের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বলেছেন, এক রাকাতে তিলাওয়াতের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকেত হিসেবে রুকু ব্যবহৃত হতো। অন্য একটি মত অনুসারে, হাফেজরা নির্দিষ্ট পরিমাণ তিলাওয়াতের পর রুকুতে যাওয়ার কারণে এই নামকরণ হয়েছে। (আল-সারাখসি, আল-মাবসুত, বৈরুত: দার আল-মা’রিফা)
আরও পড়ুনধীরে ধীরে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণ৩০ মে ২০২৫কোরআনে রুকুর সংখ্যাকোরআনে রুকুর সংখ্যা বিভিন্ন অঞ্চলে ও ঐতিহ্য অনুসারে ভিন্নতা দেখায়। প্রধানত তিনটি ধারা প্রচলিত: ৫৫৮, ৫৪০ ও ৪৮০।
৫৫৮ রুকু: বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মুসহাফে সাধারণত ৫৫৮টি রুকু ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি সুরায় রুকুর সংখ্যা উল্লেখ থাকে এবং আরবি অক্ষর ‘আইন’ দিয়ে রুকু চিহ্নিত করা হয়। এই চিহ্নে তিনটি সংখ্যা থাকে:
১. ওপরের সংখ্যা: সুরার মধ্যে রুকুর ক্রম।
২. মাঝের সংখ্যা: রুকুর আয়াতসংখ্যা।
৩. নিচের সংখ্যা: পারার (জুজ) মধ্যে রুকুর ক্রম।
এই পদ্ধতি তিলাওয়াতকে সুসংগঠিত করে এবং হাফেজদের জন্য সুবিধাজনক। (সিদ্দিকি, এ, ২০১৭, কোরআনিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস অ্যান্ড দেয়ার ডিভিশনস, জার্নাল অব ইসলামিক স্টাডিজ, ২৮(২), (১৪৫-১৬৭)
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মুসহাফে সাধারণত ৫৫৮টি রুকু ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি সুরায় রুকুর সংখ্যা উল্লেখ থাকে এবং আরবি অক্ষর ‘আইন’ দিয়ে রুকু চিহ্নিত করা হয়।৫৪০ রুকু: বুখারায় প্রথম রুকু নির্ধারণের সময় এর সংখ্যা ছিল ৫৪০। বুখারার মাশায়েখরা রমজানে তারাবিহ নামাজে প্রতি রাকাতে ১০টি আয়াত তিলাওয়াতের প্রথা অনুসরণ করতেন। এভাবে ৩০ দিনে কোরআনের প্রায় ৬ হাজার আয়াত তিলাওয়াত হতো। তবে দশ আয়াতের ভিত্তিতে তিলাওয়াত করলে বিষয়বস্তুর মাঝখানে বিরতি পড়ত, তাই তারা বিষয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য রুকু নির্ধারণ করেন। (রহিম বখশ, আল-খাত্ত আল-উসমানি ফি রাসমিল কোরআন, লাহোর: মাকতাবা কুদ্দুসিয়া, ১৯৮২)
৪৮০ রুকু: সিন্ধুর হাশিম থাট্টুভি কোরআনের রুকুসংখ্যা ৪৮০ নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি সুরাভিত্তিক নয়, বরং পারাভিত্তিক রুকু নির্ধারণ করেন। প্রতি পারায় ১৬টি রুকু ধরে ৩০ পারায় মোট ৪৮০ রুকু হয়।
তিনি ‘রুকু’ শব্দের পরিবর্তে ‘মাকরা’ বা ‘মাকারি’ শব্দ প্রস্তাব করেন, যা ‘কিরআত’ (পাঠ্যাংশ) থেকে উদ্ভূত। (আজমি, এম এম, ২০০৩, দ্য হিস্ট্রি অব দ্য কোরআনিক টেক্সট: ফ্রম রেভল্যুশন টু কম্পাইলেশন, যুক্তরাজ্য: আল-কোরআন সোসাইটি)
আরও পড়ুনসহজে কোরআন বোঝার পাঁচটি কৌশল০৩ মে ২০২৫রুকুর প্রচলনহিজাজ, আন্দালুসিয়া, মিসর, আফ্রিকা ও সিরিয়ায় রুকুর প্রচলন তেমন ছিল না। রুকুর প্রচলন মূলত মা-ওয়ারাউন্নাহার (বুখারা, সমরখন্দ), ভারতবর্ষ ও তুরস্কে ব্যাপক ছিল। ওসমানি খেলাফতের পর তুরস্কে এটা বিলুপ্ত হয়ে, তবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এখনো রুকুর প্রচলন আছে।
বুখারার মাশায়েখরা রমজানে তারাবিহ নামাজে প্রতি রাকাতে ১০টি আয়াত তিলাওয়াতের প্রথা অনুসরণ করতেন। তবে এভাবে তিলাওয়াত করলে বিষয়বস্তুর মাঝখানে বিরতি পড়ত, তাই তারা বিষয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য রুকু নির্ধারণ করেন।ইমাম দানি (মৃ. ৪৪৪ হি.) তাঁর গ্রন্থ আল-বায়ান ফি আদ্দি আয়িল কোরআন-এ কোরআনের বিভিন্ন ভাগ নিয়ে আলোচনা করলেও রুকু নিয়ে বিস্তারিত বলেননি। তবে ইমাম সারাখসি এবং রহিম বখশ তাঁদের লেখায় রুকুর ঐতিহাসিক বিবরণ দিয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে সাহাবিরা ১০টি আয়াত করে মুখস্থ করতেন এবং এর ব্যাখ্যা বুঝে পরবর্তী আয়াত শিখতেন, যা রুকু নির্ধারণের প্রাথমিক ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। (আল-দানি, আল-বায়ান ফি আদ্দি আয়িল কুরআন, কায়রো: দার আল-মা’আরিফ)
সারকথা, রুকু কোরআন তিলাওয়াতকে সহজ ও সংগঠিত করে, বিশেষ করে হাফেজদের জন্য। এটি ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে প্রচলিত একটি পদ্ধতি, যা বুখারা, সমরখন্দ ও ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে। ৫৫৮, ৫৪০ ও ৪৮০ রুকুর ধারা বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত হলেও বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে ৫৫৮ রুকুই বেশি ব্যবহৃত হয়।
লেখক: খণ্ডকালীন শিক্ষক, আরবি বিভাগ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুনযে ঘটনায় কোরআনে পূর্ণ দুটি রুকু নাজিল হয়১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র দ ষ ট পর ম ণ ল ক রআন ব যবহ ত র প রচল প রচল ত আয় ত র র জন য হ ত হয় র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
‘মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তির সাধক ছিলেন লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী’
লেখক, প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ মোতাহের হোসেন চৌধুরী সারা জীবন মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার চর্চা করে গেছেন। প্রকৃত মানবতাবাদী দার্শনিক ছিলেন তিনি। এ কারণে তাঁর লেখা, সৃষ্টিকর্ম ও চিন্তা এখনকার মানুষের জন্যও সমান প্রাসঙ্গিক।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ৬৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণসভায় বক্তারা এ কথা বলেন। লেখকের নিজ জেলা লক্ষ্মীপুরে তাঁকে নিয়ে প্রথম স্মরণসভা ছিল এটি।
রামগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত এ স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন রামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম রবিন শীষ। প্রধান অতিথি ছিলেন লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার। বক্তব্য দেন প্রবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক ড. কুদরত-ই-হুদা, যুগান্তরের সাহিত্য সম্পাদক কবি জুননু রাইন, লেখকপুত্র ক্যাপ্টেন সৈয়দ জাহিদ হোসাইন, লক্ষ্মীপুর সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক গাজী গিয়াস উদ্দিন।
জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার তাঁর বক্তব্যে বলেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী ছিলেন বাংলার একজন উজ্জ্বল প্রাবন্ধিক, মুক্তচিন্তার আলোকবর্তিকা। তাঁর লেখায় যেমন মানবতার বোধ রয়েছে, তেমনি যুক্তি ও প্রগতিশীল চিন্তার শক্ত ভিত্তি রয়েছে। তরুণ প্রজন্মকে তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
বাবার স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ক্যাপ্টেন সৈয়দ জাহিদ হোসাইন বলেন, ‘আমরা লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। অথচ দুঃখজনক হলো, এত দিন বাবাকে নিয়ে এ জেলায় আলোচনা বা স্মরণসভা হয়নি। তাঁর মতো মহান প্রাবন্ধিকের জীবন ও দর্শন নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা জরুরি।’
জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের গবেষক ড. কুদরত-ই-হুদা বলেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী ছিলেন চিন্তার দিক থেকে ব্যতিক্রমধর্মী এক ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধির সাধক, মানবতাবাদী দার্শনিক ও সাহিত্যপ্রেমী। তাঁর প্রবন্ধ আজও পাঠককে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা দেয়।
সাহিত্য, দর্শন ও সমাজচিন্তায় মোতাহের হোসেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন বলে জানান কবি জুননু রাইন। তিনি বলেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর লেখনী আজও প্রজন্মকে চিন্তার খোরাক জোগান।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী ১ এপ্রিল ১৯০৩ সালে তৎকালীন নোয়াখালী জেলা এবং বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানার কাঞ্চনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদিরের সঙ্গে যৌথভাবে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। বের করেন ‘শিখা’ নামের পত্রিকা। তাঁর রচিত প্রবন্ধ সংকলন ‘সংস্কৃতি কথা’ পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। ১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।