সকাল ৬টা। চর বাটিকামারীর ১০ বছরের আসিয়া নৌকায় চড়ে স্কুলের পথে রওনা দেয়। সঙ্গে তার ছোট ভাই মিলনও। বইখাতা বাঁশের তৈরি ছোট ব্যাগে গুঁজে নেওয়া। মায়ের মুখে একটাই কথা—‘পড়তে গেলে অনেক কষ্ট করতেই হয় মা।’
গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র বিধৌত চর বাটিকামারি যেন এক স্বপ্ন ও সংগ্রামের আখড়া। এখানে শিক্ষার মানে শুধু ক্লাসে যাওয়া নয়, প্রতিদিন জল-জোয়ার, কাঁদা, বালু ও ভয়কে অতিক্রম করে টিকে থাকার লড়াই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরের জীবন যেমন হুমকির মুখে, তেমনি হুমকির মুখে এখানকার শিশুদের ভবিষ্যৎ।

নদীভাঙন ও বন্যার করাল থাবা: ব্রহ্মপুত্রের পাড়ঘেঁষা এই চরে নদীভাঙন নতুন কিছু নয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ ভাঙন হয়েছে আরও হঠাৎ ও ভয়াবহ। সম্প্রতি চর বাটিকামারির একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পূর্ণ ভেঙে নদীগর্ভে চলে গেছে। এখন শিক্ষার্থীরা পড়ে অস্থায়ী টিন ও বাঁশের ঘরে, যা বর্ষাকালে টিকিয়ে রাখা কঠিন।

স্থানীয় বাসিন্দা রওশন আরা বেগম বলেন, “আগে একটা স্কুল ছিলো। এখন বাচ্চারা খোলা আকাশের নিচে পড়ে। কখনও বাঁশের চালায়, কখনও গাছের ছায়ায়। একটু বেশি বৃষ্টি হলে স্কুল বন্ধ।”

যাতায়াতই বড় চ্যালেঞ্জ: চরের ভেতরে নেই পাকা রাস্তা। বর্ষাকালে প্রায় পুরো এলাকা পানির নিচে চলে যায়। তখন একমাত্র ভরসা নৌকা। কিন্তু নৌকা চালানো সহজ নয়। ছোট ছোট শিশুদের দুই থেকে তিন ঘণ্টা নৌকা করে স্কুলে যেতে হয়।
ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী রাব্বি বলে, “সকালে নৌকা না পেলে স্কুল মিস হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে পানি এত বেশি হয়, নৌকা উল্টে যাওয়ার ভয় থাকে। তবু যাই, না গেলে তো পরীক্ষা দেওয়া যাবে না।”

ফ্রেন্ডশিপ নামের এনজিওর এক্সিকিউটিভ ফিল্ড অপারেশন (গাইবান্ধা) মো.

মোসাদ্দিকুর রহমান বলেন, “চরের শিক্ষার্থীরা অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও শেখার আগ্রহ ধরে রেখেছে। আমাদের স্কুল প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে।”

পরীক্ষা দিতে গিয়ে বিপদ : এসএসসি পরীক্ষার্থী রুনার গল্পটা হৃদয়বিদারক। গত বছর বন্যার সময় সে পরীক্ষা দিতে গাইবান্ধা শহরের একটি কেন্দ্রে যাওয়ার পথে হঠাৎ ঝড় ওঠে। নৌকা উল্টে যায়। কোনোরকমে তীরে উঠতে পারলেও সে দিনের পরীক্ষা দিতে পারেনি। “আম্মু কান্না করছিল, আমি খালি বলছিলাম—‘পরীক্ষা না দিলে এবার আর পড়ালেখা করতে পারবো না’।”
এমন হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা চরের অনেক শিক্ষার্থীর। প্রতিটি পরীক্ষা যেন তাদের কাছে একেকটা যুদ্ধ।

শিক্ষকদের সীমাবদ্ধতা ও মানবিকতা: স্থানীয় এক শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা নিজেরাও চরবাসী। আমরাও কষ্ট করে আসি, কিন্তু ক্লাস চালিয়ে যাই। কারণ আমরা জানি, এই শিক্ষাই ওদের একমাত্র আশার আলো।”

তবে অবকাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষক স্বল্পতা ও উপকরণের অভাব শিক্ষকদের কাজ কঠিন করে তুলেছে। কোনো কোনো স্কুলে নেই বিজ্ঞান ল্যাব, নেই গ্রন্থাগার, এমনকি পর্যাপ্ত বেঞ্চও নেই।

প্রশ্ন সরকারি উদ্যোগ নিয়ে: চরের মানুষ বারবার প্রশ্ন করেন—সরকার কি তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে সচেষ্ট? স্থানীয় চেয়ারম্যান রেজাউল ইসলাম বলেন, “আমরা জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। স্থায়ী স্কুল ভবন, শিক্ষকের আবাসন, নৌকা বা শাটল সার্ভিসের আবেদন করেছি। এখনো সাড়া মেলেনি।”

তবু সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে আসিয়া, রাব্বি, রুনারা স্বপ্ন দেখে। কেউ শিক্ষক হতে চায়, কেউ ডাক্তার। নবম শ্রেণির তানজিনা আক্তার বলে—“আমি চাই চরেও একটা ভালো স্কুল হোক, যেন ছোট ভাই-বোনেরা আমার মতো কষ্ট না পায়।”

এই শিশুদের চোখের জল, নদীর ঢেউয়ের গর্জন আর টিনের চালের নিচে বই পড়ে যাওয়ার কষ্ট—সব মিলে বলে দেয়, চরবাসীর শিক্ষার গল্পটা শুধুই টিকে থাকার লড়াই নয়, বরং মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার এক অসাধারণ সংগ্রাম।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ যখন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে, তখন দেশের ভেতরেই লাখো শিশু লড়ছে একটাই অধিকার রক্ষায়— শিক্ষার অধিকার। এখন সময়, কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার।

ঢাকা/ইভা 

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর ক ষ

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’

এবারের বাবা দিবস আমার কাছে একটু অন্যরকম। চারপাশ যেন কিছুটা বেশি নিস্তব্ধ, হৃদয়ের ভেতর যেন একটু বেশি শূন্যতা। কারণ এবার প্রথমবারের মতো আমার আব্বাকে ছাড়াই কাটছে দিনটি। আব্বা চলে গেছেন গত জানুয়ারিতে। ফলে বাবা দিবস এখন আর কেবল উদযাপনের দিন নয়– এটি হয়ে উঠেছে স্মরণ, অনুধাবন ও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উপলক্ষ। আব্বা না থেকেও আছেন, তবে এক ভিন্ন অনুভবে– আমার নীরব নিঃশব্দ অভিভাবক হয়ে।    

আমাদের সমাজে কিংবা বলা যায় পারিবারিক সংস্কৃতির বাবারা সবসময় প্রকাশের ভাষায় ভালোবাসা বোঝান না। তাদের স্নেহ, দায়িত্ববোধ ও নিবেদন অনেক সময়েই নীরব থাকে, তবে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। আমার আব্বাও ছিলেন তেমনই একজন। আব্বা ছিলেন আমার দিকনির্দেশক, আমার রক্ষাকবচ, আমার জীবনপথের চুপচাপ ভরসা। 

আব্বার অ্যাজমা ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিতেন, আমাদের প্রতিও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। আমি কিংবা আমার মেয়ে সামান্য অসুস্থ হলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর যখন ৭৯ বছর বয়স, তখনও আমি ডাক্তারের কাছে একা যেতে গেলে বলতেন, ‘তুমি একা যাবে কেন? আমি যাচ্ছি।’ এই কথা বলার মানুষটাকে প্রতি পদে পদে আমার মনে পড়ে, যেন দূর থেকে দেখছেন সবই। আর আমিও তাঁর কনুই-আঙুল ধরে হেঁটে যাচ্ছি জীবনের পথে।    

আব্বা ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ধার্মিক মানুষ। শৈশব থেকে নামাজের গুরুত্ব তিনি আমার মধ্যে গভীরভাবে বপন করার চেষ্টা করে গেছেন। কখনও নরম সুরে, আবার কখনও খুব জোর গলায়। তখন মনে হতো তিনি চাপ দিচ্ছেন; কিন্তু এখন তাঁর অনুপস্থিতির নিস্তব্ধতায় আমি সেই কণ্ঠস্বরের জন্য আকুল হই।

অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে কিংবা আত্মীয়ের বা বন্ধুর বাসায় গেলে বাবার ফোন আসত, ‘কোথায়? কখন ফিরবি?’ সেসব ফোন একসময় মনে হতো আব্বার বাড়াবাড়ি। এখন মনে হয়, একটাবার হলেও যদি ফোনে তাঁর নামটা দেখতাম! ছোট ছোট এসব প্রশ্ন– এই উদ্বেগই তো ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসা। এগুলোই ছিল বাবার নিজের মতো করে যত্ন নেওয়ার ভাষা। সেই ভাষাটাই আজ আর শোনা যায় না। আব্বা নেই, এখন জীবনযাপনে এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে।

আব্বা ছিলেন একজন ব্যাংকার। হয়তো চেয়েছিলেন আমি তাঁর পেশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখি। কিন্তু কোনোদিন চাপ দেননি। বরং নিজের ইচ্ছেমতো পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। আব্বাই আমাকে নিজের ওপর আস্থা রাখতে শিখিয়েছেন। বিয়ে করেছি, বাবা হয়েছি, নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়েছি– তবুও বাবার সেই গাইডেন্স কখনও ফুরায়নি। আব্বা কখনও অর্থ বা অন্য কোনো সহায়তার কথা বলেননি; বরং সবসময় নিজে থেকেই পাশে থেকেছেন। মনে পড়ে, একবার মেয়ের অসুস্থতার সময় আমি অর্থকষ্টে ছিলাম, কিছু বলিনি তাঁকে। কিন্তু তিনি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন, পাশে থেকেছেন।

এখন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে হয়, ‘বাবা হলে কী করতেন?’ তাঁর শিক্ষা, অভ্যাস, স্নেহ– সবকিছু এখন আমার আচরণে, আমার সিদ্ধান্তে, আমার ভালোবাসায় প্রতিফলিত হয়। তাঁকে ছুঁতে না পারলেও আমি প্রতিদিন তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি– স্মৃতিতে, নৈঃশব্দ্যে, নানা রকম ছোট ছোট মুহূর্তে।

এই বাবা দিবসে আব্বার কোনো ফোন আসবে না, থাকবে না কোনো উপহার বা আলিঙ্গনের মুহূর্ত; যা আছে সেটি হলো আব্বার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর অপার ভালোবাসা। যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সন্তানদের শুধু দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু চাননি কখনোই। তাঁর জীবনদর্শন আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি– এগুলোই নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, হয়তো পুরোপুরি পারছি না; কিন্তু আমার মনে হয় এ চেষ্টাটাই আমার জীবনে শৃঙ্খলা এনেছে।

বাবাকে হারানোর শোক যেমন গভীর, তেমনি গভীর তাঁর রেখে যাওয়া ভালোবাসা। নিজের অনুভবকে চাপা না দিয়ে, বরং বাবাকে নিজের ভেতরে জায়গা দিন। বাবার কথা বলুন, তাঁর শেখানো পথে হাঁটুন। কারণ প্রিয় মানুষরা চলে যান বটে, কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা থেকে যায় সবসময়।

লেখক: কমিউনিকেশনস প্রফেশনাল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছোট্ট মেয়েকে কেন নিয়মিত ই মেইল পাঠাচ্ছেন আলিয়া
  • মেয়েকে কেন ই মেইল পাঠাচ্ছেন আলিয়া
  • ‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’
  • বর্ষার শুরুতেই সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টির বার্তা
  • টানা সাত দিন সারাদেশে বৃষ্টি ঝরবে