সিলেটে অবৈধ পাথরের ব্যবসা ঠেকাতে চলছে ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ
Published: 17th, June 2025 GMT
সিলেটে অবৈধ পাথরের ব্যবসা ঠেকাতে এবার ক্রাশার মেশিনের (পাথর ভাঙার কল) বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এ ছাড়া জেলায় কতগুলো ক্রাশার মেশিন রয়েছে, এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজও চলছে। আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে এ তালিকা জেলা প্রশাসনে জমা দিতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, জেলায় অন্তত এক হাজার ক্রাশার মেশিন আছে। তবে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে ইউএনওদের সংশ্লিষ্ট উপজেলার ক্রাশার মেশিন কতগুলো আছে, এর তালিকা করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ তালিকা ধরে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্নের কাজ চলবে। তবে এরই মধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে।
এর আগে গত শনিবার সকালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) জাফলং পরিদর্শনে যান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। গত ৫ আগস্টের পর জাফলং থেকে বিপুল পরিমাণ পাথর লুটপাট হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দুই উপদেষ্টা ওই এলাকায় গিয়েছিলেন।
জাফলং পরিদর্শন শেষে দুই উপদেষ্টা গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে জাফলংসহ সিলেটের কোনো পাথর কোয়ারি ভবিষ্যতে ইজারা দেওয়া হবে না বলে জানান। অন্যদিকে অবৈধ পাথরের ব্যবসা ঠেকাতে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান দ্রুততার সঙ্গে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে থাকা ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দুই উপদেষ্টার নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই প্রশাসন জেলায় কতগুলো বৈধ ও অবৈধ ক্রাশার মেশিন রয়েছে, এর তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। আগামী বৃহস্পতিবার এ তালিকা তৈরির কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তালিকা ধরে ধরে সব কটি ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। অবশ্য গতকাল সোমবার থেকে মেশিনের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ শুরু হয়েছে।
গতকাল সিলেট সদর উপজেলা ও জৈন্তাপুর উপজেলায় পাথর ভাঙার ক্রাশার মিলে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেট সদর উপজেলার সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের ধোপাগুল এলাকায় দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত টাস্ক ফোর্সের অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান পরিচালনা করেন জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মেরিনা দেবনাথ।
অভিযান-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যৌথ বাহিনীর উপস্থিতিতে ৩০টি ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুনসিলেটে অবৈধ বালু ও পাথর পরিবহনে ব্যবহৃত ৪ নৌকা আটক করলেন স্থানীয়রা১৫ জুন ২০২৫এদিকে জৈন্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার। এ সময় পাঁচটি অবৈধ স্থাপনার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি বালু ধৌতকরণ ও পাথর ভাঙার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিও জব্দ করা হয়।
অভিযান-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার লক্ষ্মীপুর প্রথম খ এলাকায় একটি ভাইব্রেটর মেশিন (বালু ওয়াশিং), আসামপাড়া এলাকায় আম্মাজান স্টোন ক্রাশার, মুনতাহা স্টোন ক্রাশার, ৪ নম্বর বাংলাবাজার এলাকায় জালালী স্টোন ক্রাশারসহ ৫টি প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এ সময় ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় এক ট্রাকচালককে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
অভিযান শেষে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, পরিবেশবিধ্বংসী কাজে ব্যবহৃত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চলমান থাকবে। কোনোভাবেই আইন অমান্যকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না।
আরও পড়ুনসিলেটে দুই উপদেষ্টার গাড়িবহর আটকে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, পাথর কোয়ারি চালুর দাবি১৪ জুন ২০২৫এদিকে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোয়ারি থেকে পাথর ও বালু উত্তোলন বন্ধে নির্দেশনা দেয় সরকার। এর পর থেকে রাতের আঁধারে স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন চলত। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় হাজারো পাথরশ্রমিক প্রকাশ্যে পাথর উত্তোলন শুরু করেন। এসব পাথর বারকি ও স্টিল নৌকায় করে ক্রাশার মেশিনের মালিকদের কাছে বিক্রি করা হয়। পরে সেসব পাথর মেশিনে ভেঙে ছোট করে ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। ওই ব্যবসায়ীরা ট্রাক ও পিকআপে পাথর দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম শ ন র ব দ য ৎ স য গ ব চ ছ ন ন কর ব দ য ৎ স য গ ব চ ছ ন ন কর র দ ই উপদ ষ ট উপজ ল র র উপজ ল এল ক য় ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে
অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।
১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’
এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।
পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)