বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর হতে চলেছে। গত এক বছরে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে শক্ত কথা বলার সময় এসেছে বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান।

জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘মিষ্টি কথা, ভালো কথা, ভালো উদ্যোগ ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু হয়েছে। আমরাও অনেক ধরনের আশাপ্রদ, অনেক কিছু দেখেছি। আজকের ফ্রেমিং আমার দৃষ্টিতে হতে হবে, পাওনার হিসাব এবং উত্তরণের পথরেখা। আজকে পাওনার হিসাবটা খুবই জরুরি। বিচার, সংস্কার, নির্বাচন—এই বিষয়গুলোতে এক বছরে কী কী হলো, সেই পাওনার হিসাবটা আজকে মূল কথা হতে হবে।’

আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে হোসেন জিল্লুর রহমান এসব কথা বলেন। ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এই গোলটেবিলের আয়োজক প্রথম আলো। গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় শোক জানানো হয়। সবাই এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন।

গোলটেবিল বৈঠকে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করণীয়র কথা যদি বলি, মানুষকে গণনার বাইরে ফেলে দিয়েছে, মানুষ যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে; এখন দর্শক, এত বিশাল একটা পরিবর্তনে অংশগ্রহণকারী নয়—মূল কাজ হতে হবে এই মানুষকে কীভাবে দর্শক থেকে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীর পর্যায়ে আবার নিয়ে আসা যায়। সেটার একটা মাধ্যম অবশ্যই নির্বাচন। কিন্তু এর পাশাপাশি আরও অনেকভাবে চিন্তা করতে হবে। এ ছাড়া সক্ষমতায় যে ধস নেমেছে, এ ব্যাপারে আমাদের একটা চিৎকার দিতে হবে। প্রয়োজন হলে এটার বিদায় দিতে হবে। যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁদের এটা শুনতে হবে। তাঁদের শুনতে হবে, সক্ষমতার এই ধস পাল্টাতে হবে। মানুষকে গণনার বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কাগুজে প্রক্রিয়ায় আমাদের মেধা ও মনোযোগ সবকিছু আটকে রেখে জাতীয় ঐক্যকে পশ্চাতে ফেলে দেওয়া যাবে না।

আরও পড়ুনঅন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরেও আরেকটা সরকার আছে: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য২ ঘণ্টা আগে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার চার দলের শীর্ষ নেতাদের হওয়ার বৈঠকের প্রতি ইঙ্গিত করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এখানে খুবই পরিষ্কার, জনগণ আর কোনো বিষয় নয়। দেশ কোন দিকে যাবে, কীভাবে পরিচালনা হবে, জনগণ কোনো বিষয় নয়। জনগণের নামেই সবকিছু হচ্ছে, তাদের কথা বলেই সবকিছু হচ্ছে, কিন্তু জনগণকে আমরা গণনার বাইরে ফেলে দিয়েছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমি দেখতে পাচ্ছি একধরনের বাংকার মেন্টালিটি আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। বাংকার মেন্টালিটি হয় তখন, যখন সবকিছু একটা নির্দিষ্ট লেন্স দিয়ে শুধু দেখা হয়, মানুষকে সহযোগী হিসেবে না দেখে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিগুলোকে নিয়েই চেষ্টা করা হয়। এখানে একই সঙ্গে এটাও বলা দরকার, পতিত সরকারের অনুশোচনাহীন সমর্থকগোষ্ঠীর দেশকে অস্থিতিশীল করার নানামুখী প্রচেষ্টা একটা বিরাট বিপদ হিসেবে সমাজের মধ্যে আছে বটে। কিন্তু বাংকার মেন্টালিটি দিয়ে এটা কোনো দিনও সমাধান করা যাবে না।’

কাগুজে ঐকমত্যের প্রক্রিয়া সরাসরি জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য ও কাগুজে ঐকমত্য প্রক্রিয়া মুখোমুখি অবস্থানে আছে। জাতীয় ঐক্য আসলে পেছনে পড়ে গেছে। জাতীয় ঐক্যের প্রতি মনোযোগ নেই। এই কাগুজে ঐকমত্যের প্রক্রিয়াটা জুলাই-আগস্টের জাতীয় ঐক্যের শক্তিটাকে আমরা পেছনে ফেলে দিয়েছি। কেতাবি যোগ্যতার একটা প্রচণ্ড সমাহার হয়েছে এবং একই সময়ে সক্ষমতার বিশাল ধস নেমেছে। কেতাবি যোগ্যতার সমাহার, একটা নির্দিষ্ট ধরনের আচরণ আর প্রকৃত সক্ষমতার ধস—এখানে আমরা একটা বড় ধরনের বৈপরীত্য দেখতে পাচ্ছি। মন্ত্রণালয়, নীতিনির্ধারণ, নেগোসিয়েশন—প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমরা সক্ষমতার ধস দেখছি। কিন্তু ওই কেতাবি যোগ্যতার খুবই সরব ও খুবই প্রবল উপস্থিতি আছে। সেই অর্থে জনগণ গণনার বাইরে চলে গেছে। নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।

আরও পড়ুনকী বললে কী ট্যাগিং খাব, এসব হওয়ায় কথা ছিল না : মাহা মির্জা৫২ মিনিট আগে

`প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি পূর্ণোদ্যমে ফিরেছে'

গোলটেবিল বৈঠকে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলমান নানা সংকটের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ও বেকারত্ব—এখানে যদি পাওনার হিসাব দেখি, এটা একটা ভয়াবহ অবস্থা। গত পরশুদিন তো ট্র্যাজেডি দেখলাম। কিন্তু সাধারণ সময়ে শিক্ষা ঘিরে যে আকাঙ্ক্ষাগুলো, সেখানে একটা ভয়াবহ বাস্তবতা আছে। সেদিন বগুড়ায় গেলাম, একটা মতবিনিময়ে একই চিত্র উঠে এল। আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে মবের কথা বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু বগুড়ায় গিয়ে অদ্ভুতভাবে শুনলাম যে, সবাই নাকি ছুরি মারছে সবাইকে! ছুরি মারাটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে।

দৈনন্দিন বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলার একটা ভয়াবহ অবনতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, পুলিশ নিষ্ক্রিয়। এমন নয় যে কাঠামো নেই। মানুষের মধ্যে অস্থিরতা প্রচণ্ড। নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, নির্যাতনকারীর অধিকাংশ হচ্ছে তরুণ। আইনশৃঙ্খলার একটা ভয়াবহ বাস্তবতা আছে। বেকারত্ব বা কর্মসংস্থানের একটা ভয়াবহ অবস্থা। ঢাকা শহরে যে প্রচণ্ড বিস্তার ঘটেছে ইজি বাইক ইত্যাদির, এরা কিন্তু নতুন পেশায় এসেছে।

হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত হয়তো একটা ধারণা ছিল যে, প্রাতিষ্ঠানিক ভিন্ন পথে আমরা এগোবার চেষ্টা করব। চেষ্টাও হয়তো ছিল। কিন্তু পরে নরমাল স্টেট ডাইনামিকস বুঝে গেছে যে বড় কিছু হবে না। ডিসেম্বরের পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি পূর্ণোদ্যমে আবার নিজেকে এসার্ট করেছে। হাসিনার পলায়ন এবং ওই সরকারের পতন, এটাতে আমাদের অবশ্যই একটা আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেটা একটা বাস্তবতা আছে বটে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রচণ্ডভাবে ফিরে এসেছে। আমলা কর্তৃত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে জেঁকে বসে আছে।

আরও পড়ুনবৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার উল্টো যাত্রা করেছে সরকার: আনু মুহাম্মদ ২ ঘণ্টা আগে

যে মানুষ পরিবর্তন এনেছিল, যাদের অংশগ্রহণে পরিবর্তন এসেছিল, তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এই গুটিয়ে নেওয়াটা একটা সিগনাল। এই গুটিয়ে নেওয়াটা সর্বকালের জন্য নয়। তারা দেখেছে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, তারা দেখছে যে, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও কথার ফুলঝুরির মারপ্যাঁচে আসলে চলছে অন্য ব্যাপার।

ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্যমাত্রায় যে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ, ইনসাফ শব্দটা এত জনপ্রিয় হলো, কিন্তু ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার পথ হিসেবে আমরা প্রতিশোধকেই মাধ্যম হিসেবে নিলাম। লক্ষ্য ও উপায়ের মধ্যে এই যে অমিল.

..প্রতিশোধ স্পৃহাকেই সমাজের মধ্যে বড় করে জাগিয়ে তুলে। আমরা কোথায় সেই ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারব?’

প্রথম আলোর এই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন, লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান, লেখক ও গবেষক মাহা মীর্জা, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের গবেষণা বিশেষজ্ঞ সহুল আহমদ প্রমুখ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ স ন জ ল ল র রহম ন ব প রক র য় সরক র র ব স তবত প রচণ ড এক বছর আম দ র সবক ছ র একট

এছাড়াও পড়ুন:

২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট সময়কালে ফ্যাসিবাদী শক্তি নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে, এসবির প্রতিবেদন

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে কর্মসূচি পালনকালে ফ্যাসিবাদী শক্তি অনলাইন-অফলাইনে প্রচারণা চালিয়ে সারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)।

গতকাল সোমবার এসবির এক প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি পুলিশের সব বিভাগকে পাঠিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে এসবি। এসবির একটি সূত্র প্রথম আলোকে এই প্রতিবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সামাজিক সংগঠনগুলো ১ জুলাই থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এই ধারাবাহিকতায় ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত কর্মসূচি পালনের সময়কাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে কর্মসূচি পালনকে কেন্দ্র করে বিতাড়িত ফ্যাসিবাদী শক্তি অনলাইন-অফলাইনে প্রচারণা চালিয়ে দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির কর্মসূচিতে বাধা প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টা চালাতে পারে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি ও জানমাল রক্ষায় পুলিশের বিভিন্ন বিভাগকে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে এসবি।

নির্দেশনাগুলো হলো ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা। ৮ আগস্ট পর্যন্ত নিয়মিত সন্দেহজনক ব্যক্তিসহ মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ও অন্যান্য যানবাহন তল্লাশি করা। বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন ও বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল অভিযান পরিচালনা করা। মোবাইল প্যাট্রোল জোরদার করা। গুজব রোধে সাইবার পেট্রোলিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখাসহ গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা।

এ ছাড়া কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকলে তা তাৎক্ষণিকভাবে এসবিকে অবহিত করার কথাও বলা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ২৯ জুলাই-৮ আগস্ট ‘ফ্যাসিবাদী শক্তির’ নৈরাজ্যের আশঙ্কায় এসবির সতর্কতা
  • ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট সময়কালে ফ্যাসিবাদী শক্তি নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে, এসবির প্রতিবেদন
  • নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি শুরু, দেড় লাখ পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে
  • নেত্রকোনায় এনসিপির কর্মসূচি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট, যুবলীগ নেতা আটক
  • গাজীপুরে ১০ দফা দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ, কাঁদানে গ্যাসের শেলে ছত্রভঙ্গ শ্রমিকেরা
  • মিশিগানের ওয়ালমার্টে ছুরি হামলায় আহত ১১