সংস্কার নিয়ে তোড়জোড় চলছে। রাষ্ট্রকাঠামো, প্রশাসন, অর্থনীতি, রাজনীতি আর সমষ্টিগত নৈতিকতার সংস্কার খুবই জরুরি। আমরা সমস্যার ভেতরে ঢুকতে চাই না। ওপরে ওপরে একটু মলম লাগিয়ে ক্ষত সারানোর চেষ্টা করি। অনেক সময় অগ্রাধিকার বুঝি না। যেটা সমস্যা, তার সমাধানের দিকে না গিয়ে এমন কিছু বিষয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি, যেটা নতুন করে সমস্যা তৈরি করে। 

সংবিধানের সংস্কার নিয়ে কথা তো কম হলো না। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে একটা ধারণা দেয় যে তারাই সমাজের মূল স্টেকহোল্ডার, দেশের মালিক। ডান-বাম, আস্তিক-নাস্তিক, ছোট-বড়নির্বিশেষে সবাই জনগণের ভাগ্য নির্ধারণ করার মিশনে নেমেছে।

হাসিনা একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘আমি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই।’ এখনো অনেকেই জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের মিশনে আছেন। নেতারা গায়ে-গতরে স্ফীত হচ্ছেন। মানুষ আছে বড় কষ্টে।

আরও পড়ুনআনুপাতিক নির্বাচন নিয়ে যেসব প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন২০ নভেম্বর ২০২৪

মানুষ কী চায়? মানুষ আশা করে না, রাজনীতিবিদেরা তাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। মানুষ নিজেই নিজের সমস্যার সমাধান করে। তারা চায় এ কাজে রাষ্ট্র সহযোগিতা করুক। যদি না-ও করে, অন্তত যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে। এটুকুই চাওয়া। রাজনীতিবিদেরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রতিশ্রুতির যে ফুলঝুরি বইয়ে দেন, মানুষ তা আগের মতো বিশ্বাস করে না। তারা তাঁদের অতীতটা দেখেছে।

শিগগিরই ভোট হবে। যাঁরা মানুষের ভাগ্য বদলানোর জন্য মাতম করছেন, তাঁরা এখন নানান ওয়াদা দিচ্ছেন। দলগুলোর মধ্যে নানা রকমের সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। কে যে কার সঙ্গে জুটি বাঁধে, তা আগাম বলা মুশকিল। ভোটের সম্ভাব্য তারিখ জানানো হলে কিংবা তফসিল ঘোষণার সময় এলে ছবিটা আরেকটু পরিষ্কার হবে। তখন ‘রতনে রতন চেনে’র খেলাটা দৃশ্যমান হবে।

দেখা যাবে, কাল যে ছিল ত্যাজ্য, আজ সে পরমাত্মীয়। কাল যে ছিল সাধু, আজ সে শয়তান। ডিগবাজি দিতে সুবিধা হয় বলে তাঁরা একটা চমৎকার শ্লোক আবিষ্কার করেছেন: রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি, গণ অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে। এ নিয়ে যদি অচলাবস্থা তৈরি হয়, তাহলে নির্বাচন যথাসময়ে না-ও হতে পারে বলে কারও কারও আশঙ্কা। বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্বাচন বিলম্বিত করার ‘ষড়যন্ত্র ও কৌশল’ হিসেবেই এসব ইস্যু তোলা হয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, ‘নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য বড় জয়’ ঠেকানোর জন্যই এই প্রস্তাব সামনে আনা হচ্ছে।

সংবিধান নামে একটা কেতাব আছে, সেটি পড়ে দেখা তো দূরের কথা, বেশির ভাগ লোক চোখেও দেখেনি। সেটির ঘষামাজা চলছে। অনেক বিষয়ে দলগুলো একমত। কিছু জায়গায় এসে তারা আটকে আছে। এ সময়ের ‘গর্ডিয়ান নট’ (জটপাকানো সমস্যা) হলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি। এই গিঁট খুলতে গিয়ে সংস্কার কমিশন গলদঘর্ম হচ্ছে।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) হচ্ছে এমন একটা পদ্ধতি, যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলেও তাতে একমত হয়নি রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি পিআর পদ্ধতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে।

আরও পড়ুনআনুপাতিক সংসদীয় আসনব্যবস্থার জন্য আমরা কি প্রস্তুত২৮ অক্টোবর ২০২৪

অন্যদিকে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি, গণ অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে। এ নিয়ে যদি অচলাবস্থা তৈরি হয়, তাহলে নির্বাচন যথাসময়ে না-ও হতে পারে বলে কারও কারও আশঙ্কা। বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্বাচন বিলম্বিত করার ‘ষড়যন্ত্র ও কৌশল’ হিসেবেই এসব ইস্যু তোলা হয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, ‘নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য বড় জয়’ ঠেকানোর জন্যই এই প্রস্তাব সামনে আনা হচ্ছে।   

আনুপাতিক পদ্ধতির যৌক্তিকতা কোথায়, তা নিয়ে আলোচনা করা যাক। ধরুন, একটা আসনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ভোট পেলেন। তিনি নির্বাচিত বলে ঘোষিত হবেন। তিনি হয়তো ভোট পেয়েছেন ৩৫ শতাংশ। বাকি ৬৫ শতাংশ ভোট ভাগাভাগি করে নিয়েছেন অন্যান্য ১০ প্রার্থী। তাঁদের কেউ হয়তো পেয়েছেন ৩২ শতাংশ, কেউ ২৫ শতাংশ, কেউ কেউ ১ শতাংশের কম। সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ব্যক্তিটি যদি ৫১ শতাংশ ভোট পেতেন, তাহলে তাঁর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু তিনি ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জনপ্রতিনিধিত্বের যে দাবি করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬৫ শতাংশ ভোটারের ইচ্ছার প্রতিফলন কোথায়? ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে দুটি বড় দলের মধ্যে ভোটের ব্যবধান ছিল নগণ্য। কিন্তু সংসদে প্রতিনিধির সংখ্যায় ছিল বিরাট পার্থক্য।

আরও পড়ুনএমপিদের ‘জমিদারি’ ঠেকানোর উপায় আনুপাতিক নির্বাচন২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

তা সত্ত্বেও এ নিয়ে দাবি কিংবা বিরোধিতা হচ্ছে কেন? এই ইস্যুকে ঘিরে যে বিতর্ক হচ্ছে, তার মূল্য উদ্দেশ্য দলীয় স্বার্থ ও ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্ন। দলগুলো নিজ নিজ স্বার্থ অনুযায়ী অবস্থান নিয়েছে। আসনভিত্তিক সর্বোচ্চ ভোট পাবেন বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরা এর বিরোধিতা করছেন। আনুপাতিক ভোট হলে যাঁরা প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবেন, তাঁরা এই পদ্ধতির পক্ষে। পক্ষ-বিপক্ষ সবাই যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে যুক্তি তুলে ধরছেন।

‘অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাড়ে বন্দুক রেখে যারা নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চায়, তারাই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে বাধা সৃষ্টি করছে’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

২১ জুলাই ঢাকায় বিএনপি–সমর্থিত পেশাজীবী পরিষদের এক সমাবেশে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেছেন, ‘বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নিজেদের খবরদারি বহাল রাখতে চায় কিংবা প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্নভাবে ফায়দা হাসিল বা নিজেদের আখের গোছাতে চায়, তাদেরকেই আমরা দেখছি, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানকে সুকৌশলে বাধা সৃষ্টি করছে।’ এটা তো গুরুতর অভিযোগ। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি বিএনপির এই অবস্থানের কড়া সমালোচনা করেছে।

এ ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব নিয়েও টানাপোড়েন আছে। একটা ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্রে সচরাচর এই ব্যবস্থা দেখা যায়। আমাদের তো এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। এখানে ‘উচ্চকক্ষের’ যৌক্তিকতা কী? যৌক্তিকতা হলো ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’। এখন প্রশ্ন হলো, উচ্চকক্ষে কারা যাবেন? প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে নিম্নকক্ষ আর উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে কোনো গুণগত পরিবর্তন হবে না। তাহলে আলাদা একটা কক্ষ বানিয়ে তাতে শ দুয়েক লোককে এনে পাবলিকের টাকায় বেতন-ভাতা আর গাড়ি–বাড়ি দিয়ে পোষার কী যুক্তি থাকতে পারে? 

উচ্চকক্ষ সমর্থন করা যায়, যদি রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ হয়। সে ক্ষেত্রে একটা মিশ্র প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা যায়। দেশ কয়েকটা প্রদেশে ভাগ হলে প্রদেশের প্রতিনিধিরা উচ্চকক্ষে আসবেন। সেখানে পেশাজীবীদের প্রতিনিধিরা থাকবেন। আর থাকবেন নিম্নকক্ষে আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে নির্ধারিত প্রতিনিধিরা। একই সঙ্গে সেখানে নারী এবং সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ থাকা দরকার। সে ক্ষেত্রে দলগুলোকে আগেভাগেই প্রার্থীতালিকা প্রকাশ করতে হবে। ভাবতে অবাক লাগে, সংখ্যালঘুদের নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।

এখন যে সংসদ, সেখানে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করা হবে বলে জানা গেছে। আমি এই কোটাপ্রথা নীতিগতভাবে সমর্থন করি না। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নারী গুনতে হয় অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে, নির্বাচন কমিশন আইন করেও দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে নারীর সংখ্যা বাড়াতে পারেনি, তাই আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সংরক্ষিত নারী আসন থাকা দরকার। কিন্তু তাঁদের নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। শুধু নারী নয়, নারী–পুরুষনির্বিশেষে সবার ভোটেই তাঁদের নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে, যেমনটি হয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে। সে জন্য আগেভাগেই তাঁদের নির্বাচনী এলাকা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। 

এখন যে ব্যবস্থা, সেখানে নির্বাচিত ৩০০ সদস্য তাঁদের মনোনয়ন দেন। সেখানে অবশ্য আনুপাতিক ব্যবস্থা চালু আছে। অর্থাৎ দলগুলো সংসদে তাদের আসন অনুপাতে নারী সদস্যদের নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে। সেটি আরেক দিন আলোচনা করা যাবে।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস ত ব ব যবস থ ব এনপ র র জন য প আর প দলগ ল সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান সিপিজের

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্ত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।

মঙ্গলবার সিপিজের এক টুইটে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা ১৭ জুলাই একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ