হাসপাতাল থেকে তিন সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে যান গোয়েন্দারা
Published: 26th, July 2025 GMT
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়কের চিকিৎসা চলছিল রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে। তাঁদের একজন নাহিদ ইসলাম (এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক), অন্যজন আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা)। হাসপাতালে আসিফের দেখভাল করছিলেন আরেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার (এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক)।
এই তিন সমন্বয়কের ওপর নজর রাখছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। ২৬ জুলাই (২০২৪ সাল) বেলা সাড়ে তিনটার দিকে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তিনজনকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তুলে নিতে যাওয়া ব্যক্তিদের কেউ কেউ নিজেদের গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), আবার কেউ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন।
সেদিন রাত ১১টার পর তিন সমন্বয়ককে হেফাজতে নেওয়ার কথা স্বীকার করে ডিবি। এর পরের দুই দিনে আরও তিনজন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম ও নুসরাত তাবাসসুমকেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি। তিনজনই এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ডিবির পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সমন্বয়কদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
সমন্বয়কদের তুলে নেওয়ার পাশাপাশি সারা দেশে এলাকা ভাগ করে তখন চলছিল ‘ব্লক রেইড’। ঢালাও মামলার পাশাপাশি চলছিল গণগ্রেপ্তার। ২৬ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে মামলা হয়েছিল অন্তত ৫৫৫টি। গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ৬ হাজার ২৬৪ জনকে। তখন পর্যন্ত মুঠোফোনের ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল।
২৬ জুলাই সকালে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে সমাবেশ হয়। এই সমাবেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা বক্তব্য দেন। সমাবেশে ছাত্র–জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হয়।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু নামে একটি বই লিখেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। গত মার্চ মাসে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হওয়া ওই বইয়ে ২৬ জুলাইয়ের ঘটনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা আমাদের প্রায় গৃহবন্দী করে রাখে। আমরা যাতে ইন্টারনেটে যুক্ত হতে না পারি, সে জন্য তারা রাউটার খুলে ওয়াই–ফাই বন্ধ করে দেয়। সব ধরনের যোগাযোগ থেকে তারা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে।’
একই হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও নাহিদ ইসলামকে তাঁদের কেবিনে আসতে দেওয়া হয়নি বলেও স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন আসিফ মাহমুদ।
২৬ জুলাই হাসপাতাল থেকে তুলে নেওয়া তিন সমন্বয়কের একজন আবু বাকের মজুমদার। তিনি গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা বলেছিল নিরাপত্তার জন্য আমাদের তেজগাঁওয়ের ইমপালস হাসপাতালে শিফট (স্থানান্তর) করা হবে। কিন্তু ডিবি, ডিজিএফআই, সিটিটিসি, এনএসআই মিলে আমাদের ডিবি হেফাজতে নিয়ে যায়। ডিবি কার্যালয়ের একটি কক্ষে আমাদের বসিয়ে সামনে পিস্তল রেখে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হয়। শারীরিক–মানসিক নির্যাতন করা হয়। শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিয়ে একটা বিবৃতি দেওয়ার জন্য আমাদের ওপর নানাভাবে জোর করা হয়। এমনকি ডিবি কার্যালয় থেকে আমাদেরকে শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেছিল। এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আমরা আমরণ অনশন শুরু করেছিলাম। অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তারা আমাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।’
ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার আগে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নানাভাবে ভয় দেখাচ্ছিলেন, হুমকি দিচ্ছিলেন বলে উল্লেখ করেন আবু বাকের মজুমদার। তিনি বলেন, ‘আমরাও পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেছিলাম, বেশি চাপাচাপি করলে এখানে ১০ হাজার মানুষ ডেকে নিয়ে আসব। বাগ্বিতণ্ডার এক পর্যায়ে তারা (গোয়েন্দারা) জোর করে আমাদের মুঠোফোন নিয়ে যায়, সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। একই হাসপাতালের পৃথক ফ্লোরে থাকলেও তুলে নেওয়ার আগের রাত থেকেই নাহিদ ইসলামের সঙ্গে আমার ও আসিফ ভাইয়ের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সে জন্য তুলে নেওয়ার সময় আমরা বলছিলাম যে নাহিদ ভাইকে দেখতে চাই। আমাদের জোরাজুরিতে তারা নাহিদ ভাইকে আমাদের সামনে আনতে বাধ্য হয় এবং আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে ডিবি কার্যালয়ে নেয়।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত ন সমন বয়ক গণস ব স থ য রক ষ ক র ২৬ জ ল ই আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ
চলতি অক্টোবর মাসে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশ এবং কারা হেফাজতে মৃত্যু সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। এ তথ্য তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির অক্টোবর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এমএসএফ বলেছে, এসব ঘটনায় জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ দুই ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।
এমএসএফ প্রতি মাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। আজ শুক্রবার অক্টোবর মাসের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে।
বেড়েছে অজ্ঞাতনামা লাশএমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মোট ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়; বরং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) এর সংখ্যা ছিল ৫২। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দী ও রক্তাক্ত বা শরীরে আঘাতের চিহ্নসংবলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং তা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১টি শিশু, ১ কিশোর, ১১ জন নারী ও ৫৩ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ বছর বয়সী শিশু; ১৫ বছর বয়সী কিশোর; ২০ থেকে ৩০ বয়সী ১৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী; ৩১ থেকে ৪০ বয়সী ১৯ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী; ৪১ থেকে ৫০ বয়সী ১ নারী ও ৫ জন পুরুষ এবং ৫০ বছর বয়সের বেশি ১১ জন পুরুষ ও ১ নারী রয়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বয়স শনাক্ত করা যায়নি।
এমএসএফ বলেছে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
কারা হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছেইএমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে কারা হেফাজতে মোট ১৩ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল মোট ৮। এ মাসে ছয়জন কয়েদি ও সাতজন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন কয়েদি ও দুজন হাজতি, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন কয়েদি ও শেরপুর জেলা কারাগারে একজন কয়েদি মারা যান। এ ছাড়া খুলনা জেলা কারাগারে, টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন করে হাজতি বন্দী মারা যান। সব বন্দীর মৃত্যু হয় কারাগারের বাইরে হাসপাতালে।
এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যু এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বৃদ্ধি মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা এবং সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ। কিন্তু একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো কাজ নেই।
সাইদুর রহমান বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধি জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
গণপিটুনিতে হত্যা চলছেই, বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতাঅক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ২ জন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী–সমর্থক। সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনা ঘটেছিল।
সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকাণ্ড এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। আগের মাসে এ ঘটনা ঘটেছিল ৪৩টি। এ মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।