প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের অপরিহার্যতা
Published: 27th, July 2025 GMT
প্রাকৃতিক আলো-বাতাস শুধু আমাদের শরীর নয়, মননের বিকাশেও গভীর প্রভাব ফেলে। সূর্যের আলো, বিশেষ করে সকালের আলো, আমাদের দেহঘড়ি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের ঘুমচক্র ও সামগ্রিক মননের বিকাশকে প্রভাবিত করে। গবেষণা দেখায়, প্রাকৃতিক আলো শিশুদের চোখের স্বাস্থ্য ও মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। ভিটামিন ডি সংশ্লেষণে সূর্যের আলোর ভূমিকা সর্বজনবিদিত। হাড়ের স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতার জন্য জরুরি প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের গুরুত্ব অনেক। মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্মুক্ততা প্রশান্তি এনে দেয়। আলো-বাতাসের মধ্যে অবস্থান মানসিক চাপ কমায় এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে।
মুক্ত বাতাস নাতিশীতোষ্ণ দেশ হিসেবে আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। আমাদের মতো দেশে বছরজুড়ে সহনশীল উষ্ণতা বিরাজ করে। এখানে প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহ শরীরের ঘাম শুকিয়ে শরীরকে প্রাকৃতিকভাবে শীতল রাখতে সাহায্য করে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে ঘরের তাপমাত্রা ধরে রাখার জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা হয়, কিন্তু আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহই সর্বোত্তম সমাধান। বর্তমানে এসি-নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে। এতে যেমন কার্বন ফুটপ্রিন্ট বৃদ্ধি হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে আমাদের শরীরকে প্রাকৃতিক শীতলীকরণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এসির কৃত্রিম ঠান্ডা বাতাস আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। শুষ্ক পরিবেশ সৃষ্টি করে যা ত্বক ও শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
ঢাকা শহরের চ্যালেঞ্জ
ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকার জনবসতি অত্যন্ত নিবিড়। সিঙ্গাপুরের মতো শহরগুলোতে জমির স্বল্পতার কারণে উল্লম্ব উন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চ ঘনত্ব মোকাবিলা করা হয়। তবে ঢাকার শহুরে বিকাশ কিছুটা ভিন্ন। পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক কাঠামোতে ঘিঞ্জি গলি ও কাছাকাছি ভবন দেখা যায়। ব্রিটিশ আমলের বাগান আর সবুজনির্ভর দালান নির্মাণ করতে দেখা যায়। ধানমন্ডির মতো অনেক এলাকায় আধুনিক ফ্ল্যাট বাড়ি দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই আধুনিক ফ্ল্যাট নির্মাণে অনেক সময় প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। ফলে শিশুরা পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, কৃত্রিম আলো বা পর্দার নীল আলো শিশুদের ঘুমের চক্রে ব্যাঘাত ঘটায়। মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশে বাধা দেয়। প্রাকৃতিক আলোর অভাবে শিশুরা ঘরের মধ্যে বন্দী থেকে স্ক্রিন–আসক্ত হয়ে পড়ছে, যা তাদের সামাজিক ও জ্ঞানীয় বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। শহুরে পরিবেশে উন্মুক্ত খেলার জায়গার অভাবেও শিশুরা প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ভবনের পরিকাঠামো ও উচ্চতা এমনভাবে বিন্যস্ত হয় যে অনেক সময় পার্শ্ববর্তী ভবনের কারণে সূর্যের আলো ও বায়ুপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমাদের শহরে অপরিকল্পিত নির্মাণ প্রায়ই এ সমস্যার কারণ। ভবন থেকে ভবনের পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রাখতে না পারার কারণে বায়ু চলাচল ব্যাহত হয়, যা ঘরের ভেতরের পরিবেশকে উষ্ণ ও গুমোট করে তোলে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সুচিন্তিত নগর–পরিকল্পনা এবং ভবন নির্মাণ বিধিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করা অপরিহার্য।
নাহাস আহমেদ খলিল.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প র ক ত ক আল র জন য আম দ র পর ব শ
এছাড়াও পড়ুন:
পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে
অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।
১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’
এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।
পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)