প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের হিসাবে বিশ্বজুড়ে ২০২৪ সালে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) বাজারের মূল্য ছিল ৭১৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ২০৩২ সালে এই বাজারের আকার ৪ দশমিক শূন্য ৬ ট্রিলিয়ন (১০০ বিলিয়ন = ১ ট্রিলিয়ন) ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই বাজারকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের উদ্ভাবকেরা নানা ধরনের পণ্য উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশি উদ্ভাবক এ কে এম গনিউল জাদীদ স্মার্ট এন্টারপ্রাইজ ফ্রিজ তৈরি করেছেন।

দেশের প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যকর খাদ্যের সরবারহপ্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে এই স্মার্ট ফ্রিজ তৈরি করেছেন তিনি। শহরের মানুষের জন্য খাদ্য সরবারহ বিশেষ করে অফিসগামী মানুষের দুপুরের খাবার ও সকালের নাশতার সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ ভেন্ডিং মেশিন তৈরি শুরুর পর স্মার্ট ফ্রিজের ধারণা আসে এ কে এম গনিউল জাদীদের মাথায়। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করেন তিনি। দীর্ঘ সময় ধরে সফটওয়্যার উন্নয়নে কাজ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘শহরের মানুষের কাছে প্রাকৃতিক খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি এই স্মার্ট ফ্রিজের জন্য ধারণা ও সফটওয়্যারটি তৈরি করেছি। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানার কর্মীদের কাছে প্রাকৃতিক খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে।’

স্মার্ট এন্টারপ্রাইজের এই উদ্যোগ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল অংশীদারত্বের অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাংক-অর্থায়িত এজ প্রকল্পের অধীন পরিচালিত হচ্ছে। উদ্ভাবক গনিউল জাদীদ স্মার্ট এন্টারপ্রাইজ ফ্রিজ নিয়ে বলেন, এই অত্যাধুনিক ফ্রিজ শুধু একটি রেফ্রিজারেটর নয়, এটি একটি সম্পূর্ণ প্রযুক্তি-সমন্বিত খাদ্য সরবরাহের অবকাঠামো। এতে রয়েছে রিয়েল টাইম ইনভেন্টরি ট্র্যাকিং, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সুবিধা। এ ছাড়া সমন্বিত লেনদেনের জন্য ডেটা অ্যানালিটিকসের মতো সুবিধা। এর মাধ্যমে অফিসগামী, যেকোনো পর্যটনকেন্দ্রে দর্শনার্থী এবং কর্মজীবী পেশাদারেরা সহজেই নিরাপদ, সাশ্রয়ে ও ডিজিটালভাবে পরিচালিত স্বাস্থ্যকর খাবার পেতে পারেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্ন্যাকস, পানীয়, রেডি মিল ও হিমায়িত পণ্য পাবেন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে। দেশীয় ইলেকট্রনিকস প্রতিষ্ঠান ওয়ালটনের সহায়তায় ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।

দেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত বেয়ার সামিট ও ন্যাশনাল সেমিকন্ডাক্টর সিম্পোজিয়ামে এন্টারপ্রাইজ ফ্রিজটি দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের প্রথম এন্টারপ্রাইজ ফ্রিজ হিসেবে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে দর্শনার্থীদের আগ্রহ দেখা যায়। প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মাহদী মুকুট বলেন, ‘দেশীয় উদ্ভাবকেরা অনেক কাজ করছেন। আমাদের স্থানীয় সমস্যা আমাদের উদ্ভাবকেরা সমাধানের চেষ্টা করছেন। এন্টারপ্রাইজ ফ্রিজটি নতুন উদ্ভাবন মনে হচ্ছে। আমি নিজে সামিটে ফ্রিজটি ব্যবহার করেছি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে একটা যন্ত্র দিয়ে ফ্রিজ থেকে খাবার সংগ্রহ করা যাচ্ছে। আইওটি পণ্য হিসেবে নতুন চমক মনে হয়েছে আমার কাছে।’

মুঠোফোন দিয়ে স্ক্যান করে স্মার্ট এন্টারপ্রাইজ ফ্রিজ থেকে নানা ধরনের খাবার সংগ্রহ করা যাচ্ছে। গনিউল জাদীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এন্টারপ্রাইজ ফ্রিজ প্রকল্পের অন্য সদস্য হিসেবে আছেন ইলা শারমিন, মুক্তাদির শরীফ ও মোশাররফ হোসেন টিপু। সামিটে প্রদর্শনের মাধ্যমে আমাদের কাজটি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রযুক্তির প্রতি এরই মধ্যে দেশীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমরা দ্রুত এই আইওটি পণ্য বাজারে আনার আশা রাখছি।’

গনিউল জাদীদ রংপুর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তী সময়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে প্রথম ব্যাচে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রযুক্তিবিষয়ক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র র জন য করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে

অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।

১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’

এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।

পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।

পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)

সম্পর্কিত নিবন্ধ