একটা সময় বাংলা গান ছিল সমৃদ্ধ। ছিল কথা, সুর আর সংগীতের এক অলঙ্ঘনীয় মেলবন্ধন। গান শুনলে মনে হতো নিজের আত্মার সঙ্গে কথোপকথন। কথা থাকত প্রাণে, সুর থাকত কানে, সংগীত ঢেউ তুলত অনুভবে। সেই সব গানে প্রেম মানে অনুভব, বিরহ মানে বেদনার নান্দনিক প্রকাশ—সেখানে আজ শুধু অর্থহীনতা, এবং জাঁকজমকের আড়ালে প্রাণহীন আওয়াজ। বেশির ভাগ গান শব্দের প্যাকেজ মাত্র—না আছে ভাব, না ভঙ্গি, না গভীরতা।
শব্দের জোড়াতালি দিতে ব্যস্ত গীতিকার! কেন? অনুভবের সংকীর্ণতা? ভাষার প্রতি দায়িত্ববোধের ঘাটতি? নাকি শিল্পকে স্রেফ পণ্যে পরিণত করে ফেলার লোভাতুর তাড়না?
একঘেয়ে, পুনরাবৃত্ত, আবেগ-নকল করা ছাঁচে তৈরি হচ্ছে গান। যাঁরা লিখছেন, তাঁরা একটাই আবেগ, একটাই অভিজ্ঞতা ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি ভালোবাসা, বিচ্ছেদ কিংবা আত্মসংঘাতের মতো চিরন্তন বিষয়ের মধ্যেও নতুন কিছু চোখে পড়ে না—না ভাষায়, না ভাবনায়। একই অভিজ্ঞতা, একই ভাষা, একঘেয়ে রূপ—এভাবেই সংকুচিত হচ্ছে গানের সম্ভাবনা।
একই অভিজ্ঞতা, একই ভাষা, একঘেয়ে রূপ—এভাবেই সংকুচিত হচ্ছে গানের সম্ভাবনা। এর পেছনে একটা বড় কারণ হলো হালের গীতিকারদের পঠনপাঠনের অভাব। অনেকেই নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে কিছু জানেন না, জানতেও চান না।এর পেছনে একটা বড় কারণ হলো হালের গীতিকারদের পঠনপাঠনের অভাব। অনেকেই নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে কিছু জানেন না, জানতেও চান না। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস কিংবা মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলে অনুভবের পরিধি বাড়ে না, সে সত্যটা তাঁরা হয় জানেন না, না–হয় জেনেও অবহেলা করেন। আরেকটা কারণ, জীবনের বিচিত্র অনুভূতির প্রতি কৌতূহলের ঘাটতি। নিজের গভীরে প্রবিষ্ট না হওয়ার দীনতা। এখন গান কেবল প্রেম-বিচ্ছেদে সীমাবদ্ধ। আরও গভীর অনুভব আছে যা ছুঁতে হলে হৃদয়কে খোলা রাখতে হয়, জীবনকে গভীরভাবে দেখতে–জানতে হয়। এই কৌতূহলের অভাবেই আমাদের গানের ভেতরটা ফাঁপা হচ্ছে ক্রমাগত।
অনেক গান আছে, যার কথা ভীষণ শক্তিশালী, অর্থপূর্ণ, আবেগঘন। কিন্তু সেই কথাগুলোকে বহন করার মতো সুর আর সংগীত অনুপস্থিত। ফলে সেই মূল্যবান কথাগুলো শ্রোতার কাছে পৌঁছাতে পারে না, হারিয়ে যায় শব্দের কোলাহলে। আবার কিছু গান আছে, যেগুলোর সুর হৃদয়গ্রাহী, সংগীত নিখুঁত। কিন্তু ঠুনকো কথার কারণে সেই অসাধারণ সুর বাতাসে মিলিয়ে যায়।
গান তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন কথা, সুর ও সংগীত—এই তিন উপাদান একে অপরের সংলগ্ন থাকে, পরস্পরের পরিপূরক হয়। এর একটিও দুর্বল হলে গানের সম্পূর্ণ রূপ ভেঙে পড়ে। আর যদি তিনটিই ভারসাম্য বজায় রেখে একসঙ্গে চলে, তখনই সৃষ্টি হয় সেই গান, যা সময় পেরিয়ে থেকেও যায়, বেঁচেও থাকে।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতা আর প্ল্যাটফর্মের বৈচিত্র্যের কারণে এখন প্রতিদিনই অনেক গান উৎপাদন হচ্ছে। সেখান থেকে হাতে গোনা দু–একটা গান শ্রোতার হৃদয় জয় করতে পারছে। এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে গানের সৌন্দর্য নয়, ‘ভাইরালিটি’ই হয়ে উঠেছে সফলতার মাপকাঠি। অথচ গান তো কেবল বিনোদন নয়—এটা সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় আর সময়ের দলিল।
বর্তমান গানের বাজারে সমস্যা তৈরি করেছে ‘হঠাৎ জনপ্রিয়তা’র কদর। এই তথাকথিত জনপ্রিয়তা একধরনের চতুর ফাঁদ। প্রথমে সেটি আমাদের বাহবা দেয়, হাততালি দেয়, জীবনের ওপর আচমকা আলো ছোড়ে। প্রকৃত প্রতিভাবানেরাও এই জনপ্রিয়তার হাতছানিতে পড়ে এমন অনেক কাজ করেন, যেগুলোর সঙ্গে তাদের স্বাতন্ত্র্য, মৌলিকতা কিংবা চিন্তার কোনো সম্পর্ক থাকে না। এই ফাঁদে পড়ে একজন শিল্পী হয়ে ওঠেন কনটেন্ট প্রডিউসার। একজন লেখক হয়ে পড়েন ক্লিকবেইটের দাস।
ফিউশনের নামেও যা খুশি, তা–ই হচ্ছে। ফিউশন বা রিমিক্স করাটা যেন ট্রেন্ড হয়ে গেছে। যেকোনো গান ফিউশন করার আগে সেই গানের ভাব, ভঙ্গি, ওজন ও মহিমা জানা জরুরি। অনেকেই আছেন, প্রচুর টাকা আছে বা একটা বিগ বাজেটের গান করার বিনিয়োগ ব্যবস্থা আছে, হয়তো আসল জিনিসটা নাই। সেই আসল জিনিসটার নাম কাণ্ডজ্ঞান। যে কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে আপনি গানটাকে বহন করবেন। এই কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই একজন শিল্পী নির্ধারণ করেন, কোনো গানের ভেতর তিনি কী যোগ করবেন, কী বাদ দেবেন। গান মানে শুধু সুর না, সে এক ঐতিহ্য, এক অনুভব। কেউ টাকা খরচ করতে পারলেই ধরে নিচ্ছে, সে গানের ‘নতুন জন্ম’ দিতে পারে।
একটা মহিরুহ গানকে যদি আপনি শুধু ট্রেন্ড ধরার লোভে, ইউটিউবের ভিউ বাড়ানোর আশায় ভেঙেচুরে ফেলেন—তাহলে সেটা আর ফিউশন নয়, বরং অপমান আর আত্মম্ভরিতার ফানুস হয়ে দাঁড়ায়। মনে রাখা দরকার, ভিউ হচ্ছে বানের পানির মতো—আজ আছে, কাল নেই। কিন্তু ভালো লিরিক হচ্ছে শান্ত নদীর মতো—নীরবে বইতে থাকে যুগের পর যুগ। আর গান কেবল বিনোদন নয়—এটি শিল্প। আর শিল্প মানেই তার কিছু দায়বদ্ধতা আছে। গীতিকারেরা যেন বিষয়টি ভুলে না যান।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ উশন
এছাড়াও পড়ুন:
পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত, সচিব কমিটি উপদেষ্টা পরিষদে পাঠাবে
পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে অধ্যাদেশের খসড়াটি সচিব কমিটির মাধ্যমে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের জন্য যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশনের কাঠামো ও কার্যক্রমের খসড়া তৈরি করেছে।
খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এই কমিশনের চেয়ারপারসন হবেন। সদস্য থাকবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ; গ্রেড-২ পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা; অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা; পুলিশ একাডেমির একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ; আইন, অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ের একজন কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক; ১৫ বছর অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন একজন মানবাধিকারকর্মী।
আরও পড়ুনপুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে স্বাধীন কমিশন অপরিহার্য৮ ঘণ্টা আগেকমিশনের চেয়ারপারসন আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমপদমর্যাদার হবেন।কমিশনের চেয়ারপারসন আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমপদমর্যাদার হবেন। সদস্যরা যোগদানের দিন থেকে চার বছর নিজ নিজ পদে থাকবেন। মেয়াদ শেষে কোনো সদস্য আবার নিয়োগের যোগ্য হবেন না।
অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, পুলিশ কমিশনের নির্দেশ বা সুপারিশ প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতার বিষয়ে বলা হয়েছে—এই কমিশন যেকোনো কর্তৃপক্ষ বা সত্তাকে কোনো নির্দেশ দিলে উক্ত কর্তৃপক্ষ বা সত্তা অনধিক তিন মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করে কমিশনকে অবহিত করতে হবে। তবে কমিশনের নির্দেশ বা সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো অসুবিধা হলে সে ক্ষেত্রে নির্দেশ বা সুপারিশ পাওয়ার অনধিক তিন মাসের মধ্যে কমিশনকে অবহিত করতে হবে। কমিশন বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে যে নির্দেশ বা সুপারিশ পাঠাবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশ বা সুপারিশ কমিশন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করে কমিশনকে জানাতে হবে।
আরও পড়ুনকোনো দল নয়, পুলিশের আনুগত্য থাকবে আইন ও দেশের প্রতি৯ ঘণ্টা আগেপুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পর জুলাই জাতীয় সনদেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।এই কমিশনের সদস্য পদে নিয়োগের সুপারিশ প্রদানের জন্য সাত সদস্যের সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। খসড়া অধ্যাদেশে প্রধান বিচারপতির মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির মনোনীত একজন সরকারদলীয় এবং একজন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যকে বাছাই কমিটিতে রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যূনতম পাঁচ সদস্যের উপস্থিতিতে বাছাই কমিটির কোরাম হওয়া ও বাছাই কমিটির বাছাই প্রক্রিয়া শুরুর ৩০ দিনের মধ্যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে খসড়া প্রস্তাবে।
আরও পড়ুন‘আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ’ তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কঠিন: সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা১৭ ঘণ্টা আগেপুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ খসড়ায় কমিশন প্রতিষ্ঠা, কার্যালয়, সদস্যদের নিয়োগ, মেয়াদ, কমিশনের সদস্য হওয়ার জন্য কারা অযোগ্য, সদস্যদের পদত্যাগ, অপসারণ, পুলিশি কার্যক্রমে দক্ষতা বৃদ্ধি, শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, নাগরিকের অভিযোগ অনুসন্ধান-নিষ্পত্তি, পুলিশ সদস্যদের সংক্ষোভ নিরসন, পুলিশপ্রধান নিয়োগ, আইন-বিধি, নীতিমালা প্রণয়ন ও গবেষণা বিষয়েও প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পর জুলাই জাতীয় সনদেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আরও পড়ুনমাঝেমধ্যে শুনতে হয়, ‘উনি কি আমাদের লোক’: আইজিপি১৭ ঘণ্টা আগে