মানবদেহে ওজন বহনকারী যে কটি অস্থিসন্ধি রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাঁটু। হাঁটুর ব্যথা প্রধানত বয়স্ক ব্যক্তিদের বেশি হয়ে থাকে। তবে এটি এমন এক সমস্যা, যেটা যে কারও যেকোনো সময় হতে পারে। সাধারণত পুরুষের তুলনায় নারীদের এ সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। যাঁদের ওজন বেশি, তাঁরা হাঁটুর ব্যথায় বেশি ভোগেন। তবে সঠিক চিকিৎসা ও যত্নের মাধ্যমে হাঁটুব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
হাঁটুব্যথার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বয়সজনিত অস্থিসন্ধির ক্ষয় বা অস্টিওআর্থ্রাইটিস। এ ছাড়া হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া বা আঘাত পেলে হাঁটুব্যথা হয়। খেলাধুলা বা ব্যায়াম করার সময় এটা বেশি হয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস নামের একধরনের অটোইমিউন রোগ হাঁটুর অস্থিসন্ধিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত শারীরিক ওজন ও হাঁটুর পারিপার্শ্বিক মাংসপেশির দুর্বলতা হলেও হাঁটুতে ব্যথা হয়।
চিকিৎসা ও করণীয়
হাঁটুব্যথা হঠাৎ শুরু হলে বিশ্রাম নিন। এতে হাঁটুর ওপর চাপ কমবে।
দিনে তিন–চারবার হাঁটুতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট বরফের প্যাক ব্যবহার করুন।
হাঁটুর সাপোর্ট ব্যান্ডেজ ব্যবহার করুন।
হাঁটু উঁচু করে রাখতে হবে। রাতে হাঁটুর নিচে একটা পাতলা বালিশ রাখতে পারেন। এতে রক্তসঞ্চালন বাড়ে।
হাঁটুব্যথার কারণ শনাক্ত করে এর চিকিৎসা নিতে হবে।
হাঁটুব্যথা উপশমের জন্য বিশেষ ব্যায়াম ও কিছু থেরাপি কার্যকর। এ জন্য ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নিন।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন। চর্বি ও চিনিজাতীয় খাবার কম খান।
বিশেষ ধরনের জুতা ও হাঁটুর জন্য সহায়ক ব্রেস ব্যবহার করুন। নরম ও আরামদায়ক জুতা পরিধান করুন।
পেশির শক্তি বাড়াতে ব্যায়াম ও স্ট্রেচিং গুরুত্বপূর্ণ। সাঁতার, সাইকেল চালানো বামৃদু স্ট্রেচিং ব্যায়াম ও হাঁটুর হালকা ব্যায়ামগুলো করুন।
চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করতে পারেন।
হাঁটুর ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে অবশ্যই একজন অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। পরামর্শ অনুযায়ী কিছুদিন প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন–জাতীয় ব্যথানাশক সেবন করা যেতে পারে। এ ছাড়া কার্টিলেজ রক্ষাকারী ওষুধ যেমন গ্লুকোসামিন খাওয়া যেতে পারে।
গুরুতর ক্ষেত্রে জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট বা লিগামেন্ট রিপেয়ার সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
কীভাবে প্রতিরোধ করবেন
হাঁটুর জয়েন্টগুলোতে চাপ কমাতে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বা ভারী কাজ এড়িয়ে চলুন।
প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করতে পারেন।
সঠিক ভঙ্গিতে বসা ও হাঁটার অভ্যাস করতে হবে।
পুষ্টিকর খাবার (ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি) খেতে হবে।
পান করুন পর্যাপ্ত পানি।
অধ্যাপক ডা.
এম আমজাদ হোসেন বিভাগীয় প্রধান, অর্থোপেডিক সার্জারি
ল্যাবএইড হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে
অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।
১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’
এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।
পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)