আত্মহত্যা একটি গুরুতর সমস্যা। অন্যদের মতো মুসলিম সমাজেও আত্মহত্যার প্রকোপ যথেষ্ট। আত্মহত্যা শুধু ব্যক্তিগত সংকট নয়, একটি সামাজিক ও আধ্যাত্মিক চ্যালেঞ্জও। আত্মহত্যা মোকাবিলার জন্য সহানুভূতি, সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।

কানাডার মুসলিম পণ্ডিত শেখ আজহার নাসের বলেছেন, ‘আমাদের আত্মহত্যা বিষয়ে আলোচনার ধরন বদলাতে হবে। ইসলামে আত্মহত্যার পরিণতি সম্পর্কে স্পষ্ট শিক্ষা আছে। তবু কীভাবে মুসলিম সমাজে এই সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়, সেদিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

আল্লাহ কাউকে তাঁর সাধ্যের বাইরে বোঝা চাপান না।সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬আত্মহত্যার পরিসংখ্যান

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা মুসলিম ইয়ুথ হেল্পলাইনের একটি জরিপে (২০২১) ১,০০০-এর বেশি প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করা হয়েছে, যা মুসলিম সমাজে আত্মহত্যার প্রকোপ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করে। মূল তথ্যগুলো হলো:

 ৩২ শতাংশ আত্মহত্যার চিন্তা করেছেন।

 ৪০ শতাংশ মনে করেন তাঁদের প্রয়োজনীয় সাহায্যে অ্যাক্সেস নেই।

 ৩৭ শতাংশ (১৯-২২ বছর বয়সী) তাঁদের মানসিক সমস্যা কাউকে জানান না।

 ২৭ শতাংশ কাউকে বা কারও আত্মহত্যার কথা শুনেছেন।

 ৩ শতাংশ নিজেরা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।

এই পরিসংখ্যানগুলো ইঙ্গিত দেয় যে মুসলিম সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যার বিষয়টি একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা সমাধানের জন্য জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।

আরও পড়ুনহতাশা মানে কি ইমান দুর্বল হওয়া২৩ জুন ২০২৫আত্মহত্যা প্রতিরোধে কীভাবে সহায়তা করবেন

মুসলিম সম্প্রদায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহানুভূতিশীল ও ব্যবহারিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কিছু কার্যকর উপায় উল্লেখ করা হলো:

১.

পুণ্যের ওপর নজর দেওয়া

ইসলামে আত্মহত্যা হারাম এবং এটি কোরআনে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ: ‘তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ২৯)

আল্লাহর রহমত ও ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিন। তাঁদের উৎসাহ দিন যেন তাঁরা আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন, যেমন তাঁরা একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন।

তবে যাঁরা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের বারবার এটি মনে করিয়ে দেওয়া তাঁদের অবস্থাকে আরও খারাপ করতে পারে। এটি তাঁদের মধ্যে অপরাধবোধ বা হতাশা বাড়াতে পারে। পরিবর্তে, সহানুভূতি ও নিরপেক্ষ মনোভাবের সঙ্গে তাঁদের পাশে থাকা উচিত, তাঁর পুণ্যগুলো বেশি স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা একটি রোগ এবং এটি নিয়ে বিচার করা উচিত নয়।

২. লক্ষণ শনাক্ত করা

আমাদের কাছের মানুষদের আচরণ, কথাবার্তা, মেজাজ বা ব্যক্তিত্বে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করলে তা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। যেমন ‘তুমি কেমন আছ’র মতো একটি সাধারণ প্রশ্নও তাঁদের মন খুলে কথা বলতে উৎসাহিত করতে পারে।

অনেক মুসলিম তাঁদের মানসিক সমস্যা লুকিয়ে রাখেন, তাই এই ছোট পদক্ষেপটি তাঁদের জন্য একটি বড় পার্থক্য তৈরি করতে পারে।

৩. মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বা আত্মহত্যার লক্ষণ সব সময় স্পষ্ট হয় না। তাই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম দাতব্য সংস্থাগুলোর উচিত এ ধরনের উদ্যোগ শুরু করা। তবে যেকোনো স্বীকৃত মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ কোর্স কার্যকর হতে পারে, কারণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সব ধর্ম ও জাতির মানুষকে একইভাবে প্রভাবিত করে।

অনেকে পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলতে লজ্জা বা ভয় পান। তাই তাঁদের সংগঠনগুলোর সম্পর্কে জানানো গুরুত্বপূর্ণ।

তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।’সুরা নিসা, আয়াত: ২৯আরও পড়ুনআত্মহত্যা বিষয়ে ইসলাম কী বলে০৩ এপ্রিল ২০২৫

৪. মনোযোগ দিয়ে শোনা

তাঁদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, তাঁদের শারীরিক ভাষা পর্যবেক্ষণ করা এবং তাঁদের কথার মধ্যে বাধা না দেওয়া। কথা শেষ হলে তাঁদের কথাগুলো পুনরায় বলে তাঁদের বোঝানো উচিত যে আপনি তাঁদের কথা বুঝেছেন। এটি তাঁদের সান্ত্বনা দেয়।

প্রতিটি কথোপকথনের সমাধান দিতে হবে, তা নয়; কখনো কখনো কেবল শোনাই যথেষ্ট। বিচার না করে শোনা মানে তাঁদের কথায় নিজের অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া (যেমন ‘এটা হারাম’) প্রকাশ না করা।

৫. সাহায্যের কথা জিজ্ঞাসা করা

কথোপকথনকে প্রশ্নমুখী রাখা গুরুত্বপূর্ণ। পরামর্শ দেওয়ার পরিবর্তে, তাঁদের জিজ্ঞাসা করুন, ‘আমি কীভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি?’ এতে তাঁদের মনে হবে যে তাঁরা নিয়ন্ত্রণে আছেন এবং তাঁদের মন খুলে কথা বলতে উৎসাহিত করে। এ পদ্ধতি তাঁদের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।

৬. ধর্মীয় আশ্বাস দেওয়া

ধর্মীয় পরামর্শ দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। জাহান্নাম বা নির্দিষ্ট ধর্মীয় কাজের কথা বলা সাহায্যকারী না–ও হতে পারে। পরিবর্তে, আল্লাহর রহমত ও ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিন। তাঁদের উৎসাহ দিন যেন তাঁরা আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন, যেমন তাঁরা একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন।

পাপ বা শাস্তির ওপর জোর দেওয়ার পরিবর্তে সহানুভূতি, মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং ব্যবহারিক সহায়তার মাধ্যমে আমরা ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে পারি।

পাশাপাশি, তাঁদের পেশাদার সাহায্য নিতে উৎসাহিত করুন এবং তাঁদের পাশে থাকুন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ কাউকে তাঁর সাধ্যের বাইরে বোঝা চাপান না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)

এই আয়াত তাঁদের আশ্বাস দিতে পারে যে আল্লাহ তাঁদের অবস্থা বোঝেন।

মুসলিম সমাজে আত্মহত্যার প্রকোপ

২০২১ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার মুসলিম সম্প্রদায়ে আত্মহত্যার চেষ্টার হার অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর তুলনায় দ্বিগুণ (প্রায় ৮ শতাংশ)। এটি ইসলামোফোবিয়া, বৈষম্য এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় সীমিত প্রবেশাধিকারের কারণে হতে পারে।

এ ছাড়া মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার সাধারণত বিশ্ব গড়ের তুলনায় কম হলেও, কিছু দেশে (যেমন বাংলাদেশ, কুয়েত, সিরিয়া) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সাধারণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি, বিশেষ করে আত্মহত্যার চেষ্টার ক্ষেত্রে।

মোট কথা, আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। পাপ বা শাস্তির ওপর জোর দেওয়ার পরিবর্তে সহানুভূতি, মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং ব্যবহারিক সহায়তার মাধ্যমে আমরা ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে পারি।

 নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দয়া ঈমানের লক্ষণ, আর যাঁর মধ্যে দয়া নেই, তাঁর ঈমান নেই।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৯৩০) আমাদের সমাজ, মসজিদ ও পরিবারগুলোকে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে এবং সহায়তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আল্লাহর রহমত ও দয়ার ওপর ভরসা রেখে আমরা একটি সহানুভূতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে কেউ একা বা হতাশ বোধ করবে না।

 সূত্র: দি মুসলিম ভাইব ডটকম

আরও পড়ুনপ্রতিদিন কেন মৃত্যুকে স্মরণ করতে হবে৩১ জুলাই ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: মন য গ দ সহ ন ভ ত পদক ষ প দ র মন আল ল হ সহ য ত আম দ র র ওপর উৎস হ ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে

অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।

১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’

এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।

পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।

পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)

সম্পর্কিত নিবন্ধ