ইসলামি সভ্যতা এক সময় জ্ঞান–বিজ্ঞানে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে, কিন্তু উনিশ শতক থেকে মুসলিম উম্মাহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয় শক্তির উত্থান, উসমানীয় খিলাফতের পতন ও বিজ্ঞানে পশ্চিমা আধিপত্য মুসলিমদের জ্ঞানচর্চাকে পিছিয়ে দিয়েছে।

ইসলামি স্বর্ণযুগে (অষ্টম-ত্রয়োদশ শতাব্দী) মুসলিম পণ্ডিতরা গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও প্রকৌশলের ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখেছিলেন। ইবনে সিনা, আল-খাওয়ারিজমী এবং আল-বিরুনির মতো পণ্ডিতেরা বিজ্ঞানকে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে এগিয়ে নিয়েছিলেন।

কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা করে এবং বুদ্ধিমানেরা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা সদ, আয়াত: ২৯)

পশ্চিমা বিজ্ঞান প্রকৃতিকে জয় করার বা শোষণের বিষয় হিসেবে দেখে, যা ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে পরিবেশদূষণ, সম্পদের অপব্যবহার ও বৈশ্বিক অসাম্য বেড়েছে।

এ আয়াত মুসলিমদের জ্ঞানের সন্ধানে উৎসাহিত করত।

পশ্চিমা রেনেসাঁ ও আলোকিত যুগের প্রভাবে বিজ্ঞানে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পায়। পশ্চিমা বিজ্ঞান প্রকৃতিকে জয় করার বা শোষণের বিষয় হিসেবে দেখে, যা অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে পরিবেশদূষণ, সম্পদের অপব্যবহার ও বৈশ্বিক অসাম্য বেড়েছে। বাংলাদেশে, নদীদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই সমস্যার স্পষ্ট উদাহরণ।

আরও পড়ুনআপনি কি জানেন, এই ১০টি উদ্ভাবন মুসলিমদের১৯ জুন ২০২৫পশ্চিমা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি

পশ্চিমা বিজ্ঞান প্রায়ই দার্শনিক ও অবিশ্বাসী দৃষ্টিভঙ্গির ওপর জোর দেয়, যা প্রকৃতিকে আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে না দেখে একটি বস্তুগত সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে। অথচ কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের হাতের কাজের কারণে স্থল ও সমুদ্রে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।’ (সুরা রুম, আয়াত: ৪১) এ বিপর্যয়ের উদাহরণ হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা, দূষণ ও সম্পদের অসম বণ্টন। শিল্পের বর্জ্যে নদীদূষণ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এই সমস্যার ফল।

ইসলামি বিজ্ঞান প্রকৃতিকে আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে দেখে, যা সম্মান ও দায়িত্বের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। নবীজি (সা.

) বলেছেন, ‘পৃথিবী থেকে ক্ষতিকর কিছু সরিয়ে ফেলা ইমানের একটি শাখা।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৫,২৩৯)

এই শিক্ষা বিজ্ঞানকে নৈতিক ও টেকসই পথে পরিচালিত করতে পারে।

বিজ্ঞানমুখী প্রজন্ম গড়ার প্রয়োজনীয়তা

মুসলিম সমাজের একটি বিরাট অংশ উপর্যুক্ত নানা কারণে ও আর্থিক দৈন্যদশার মুখে পড়ে বিজ্ঞান থেকে পিছিয়ে পড়েছে। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি, পদ্ধতি ও প্রয়োগ পুনর্বিন্যাস করে তাদের জাগিয়ে তোলা সময়ের দাবি। এর উদ্দেশ্য শুধু পশ্চিমা বিজ্ঞানকে প্রত্যাখ্যান নয়, বরং এর সঙ্গে ইসলামি মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটানো। বিজ্ঞান শিক্ষা যেহেতু ব্যাপকভাবে পশ্চিমা মডেলের ওপর নির্ভরশীল, তাই সেখানে ইসলামি দার্শনিক তত্ত্বের মাধ্যমে একটি ভারসাম্য আনাও জরুরি। এটি আমাদের পরিবেশ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার প্রতি দায়িত্বশীল করে তুলবে।

পৃথিবী থেকে ক্ষতিকর কিছু সরিয়ে ফেলা ইমানের একটি শাখা।সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৫,২৩৯

কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমরা আমাদের রাসুলদেরকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ পাঠিয়েছি এবং তাঁদের সঙ্গে কিতাব ও ন্যায়বিচারের মানদণ্ড নাযিল করেছি, যাতে মানুষ ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত: ২৫)

অর্থাৎ, আমাদের বিজ্ঞানচর্চা যেন ন্যায় ও কল্যাণের পথে ব্যবহার হয়, সেদিকে মনোনিবেশ করতে হবে।

আরও পড়ুনবাগদাদের জ্ঞানের বাতিঘর২৭ জুন ২০২৫ব্যবহারিক পদক্ষেপ

বিজ্ঞানের সঙ্গে ইসলামের এই সমন্বয় ঘটানোর জন্য আমরা বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। যেমন:

১. শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামি মূল্যবোধের সমন্বয়

বিজ্ঞান শিক্ষায় কোরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। পরিবেশবিজ্ঞান পড়ানোর সময় সুরা রুম (আয়াত: ৪১) বা আকাশবিজ্ঞানের সময় কোরআন কসমোলজিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছে, সেসবও আলোচনা করা যেতে পারে। এটি শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের নৈতিক দিক সম্পর্কে সচেতন করবে।

২. টেকসই গবেষণার প্রচার

জলবায়ু পরিবর্তন, নদীদূষণ এবং কৃষি–সংকটের মতো সমস্যা সমাধানে গবেষণাকে ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সংযুক্ত করা যেতে পারে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির গবেষণায় কোরআনের টেকসই উন্নয়নের শিক্ষা প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যেখানে শাস্ত্রীয় পাঠদান করা যায়, সেগুলোর সঙ্গে বিজ্ঞানের কত গভীরতম সংযোগ রয়েছে, তা শিক্ষকগণ আলোচনা করতে পারেন।

৩. মুসলিম বিজ্ঞানীদের নেটওয়ার্ক গঠন

মুসলিম বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে তারা কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিজ্ঞানের নতুন ব্যাখ্যা ও সমাধান প্রস্তাব করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ উদ্যোগ নিতে পারে।

৪. পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশ সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। মসজিদে খুতবার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা, বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম বা নদী পরিষ্কার অভিযানে সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। বিভিন্ন দাতব্য সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতায় এই কার্যক্রম জোরদার করা যায়।

৫. নৈতিক বিজ্ঞান শিক্ষা

বিজ্ঞান শিক্ষায় নৈতিকতার ওপর জোর দেওয়া উচিত। কোরআনের শিক্ষা, যেমন ‘তোমরা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করো’ (সুরা হাদিদ, আয়াত: ২৫), বিজ্ঞানীদের প্রকৃতির শোষণের পরিবর্তে এর সংরক্ষণে উৎসাহিত করবে। শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবেশ নৈতিকতার কোর্স চালু করা যেতে পারে।

৬. প্রদর্শনীর আয়োজন করা

প্রাচীন মুসলিম বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন উদ্ভাবন ও আবিষ্কার নিয়ে জনপরিসরে প্রদর্শনীর আয়োজন করা যায়। এবং বর্তমান বিজ্ঞানকে তাদের আবিষ্কার কীভাবে প্রভাবিত করেছে, তা–ও চাইলে সেখানে ব্যাখ্যা করার ব্যবস্থা রাখা যায়।

৭. শাস্ত্রীয় পাঠে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যেখানে শাস্ত্রীয় পাঠদান করা যায়, সেগুলোর সঙ্গে বিজ্ঞানের কত গভীরতম সংযোগ রয়েছে, তা শিক্ষকগণ আলোচনা করতে পারেন। প্রয়োজনে মৌলিক ব্যবহারিক বিজ্ঞান ও জনজীবনে তার প্রভাববিষয়ক সিলেবাস গঠন করা যায়।

বিজ্ঞান যে মুসলিম সমাজের ভেতরে ‘ধর্মবিরোধিতা’র কোনো অংশ নয়, বরং নৈতিক ও শাস্ত্রীয় শিক্ষার সঙ্গে বিজ্ঞানের পাঠ আমাদের আরো বেশি জীবন–সংকট দূর করবে, সেটা বোঝানো এই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হওয়া উচিত। এটাই আমাদের ঐতিহাসিক গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারে এবং আমাদের দেশ ও জাতিকেও সমৃদ্ধ করতে পারে। বিজ্ঞানভীতি দূর করতে পারলে আমাদের শিশুরাও সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।

আরও পড়ুনগণিতে ইবনে হাইমের অবদান২৩ জুলাই ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রক ত ক ব যবহ র পর ব শ আম দ র র একট ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে

অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।

১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’

এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।

পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।

পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)

সম্পর্কিত নিবন্ধ