জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে আবার আলোচনা
Published: 4th, August 2025 GMT
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনার লক্ষ্যে তৃতীয় পর্বের কাজ শুরু করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই পর্বে জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে কমিশন। পরে সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর সই নেওয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে জুলাই জাতীয় সনদ।
গতকাল রোববার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। কবে নাগাদ এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয় কমিশন। অবশ্য ইতিমধ্যে কমিশন অনানুষ্ঠানিকভাবে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গত বছরের অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো প্রতিবেদন দেয়। পরে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এরপর ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ সুপারিশ, সেগুলো বাস্তবায়নে কাজ চলছে।
অন্যটি হলো ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ। এগুলো নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে ৩৩টি দলের সঙ্গে (২০ মার্চ-১৯ মে) আলাদাভাবে আলোচনা হয়।
প্রথম পর্বে ৬৫টির বেশি বিষয়ে ঐকমত্য হয়। ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। এ পর্বে ১৯টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত বা ঐকমত্য হয় ৯টি বিষয়ে। আর ১০টি বিষয়ের ক্ষেত্রে এক বা একাধিক দলের ভিন্নমত আছে।
সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে জুলাই জাতীয় সনদের খসড়ায় বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পরবর্তী দুই বছরে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার করবে দলগুলো। বিএনপি বিষয়টি মেনে নিলেও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশ কিছু দলের আপত্তি আছে। তারা এই সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার দাবি জানিয়েছে।
প্রথম পর্বে ৬৫টির বেশি বিষয়ে ঐকমত্য হয়। ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। এ পর্বে ১৯টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত বা ঐকমত্য হয় ৯টি বিষয়ে। আর ১০টি বিষয়ের ক্ষেত্রে এক বা একাধিক দলের ভিন্নমত আছে।ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, তৃতীয় পর্বের আলোচনার শুরুতে থাকবে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ। এর আগে দুই পর্বে একমত হওয়া বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক করা হবে। কোন কোন প্রস্তাব বা সুপারিশ অধ্যাদেশ জারি করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সে বিষয়ে আইনি বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হবে। বিশেষজ্ঞরা এটি যাচাই–বাছাই করবেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় নিয়েও আলোচনা হবে।
আর যেসব প্রস্তাবের বাস্তবায়ন সংবিধান সংশোধন ছাড়া সম্ভব নয়, সেগুলোর বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। যেসব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) আছে, সেগুলোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়া হবে। ভিন্নমত কমিয়ে আনার চেষ্টাও করা হবে এ আলোচনায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঐকমত্য কমিশন মনে করছে, সংস্কার বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের ঐকমত্য বা বোঝাপড়া না হলে অনেক দল জুলাই সনদে সই করবে না বলে শঙ্কা আছে। এ বিষয়ে দলগুলো যাতে একটি যৌক্তিক অবস্থানে আসতে পারে, সে জন্য কমিশন সব ধরনের চেষ্টা চালাবে। জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বা আইনি ভিত্তি দেওয়ার কাজটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কমিশন এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকবে। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করবে কমিশন।
মনির হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ ও সনদে দলগুলোর স্বাক্ষর নেওয়ার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে তৃতীয় ধাপের কাজ শুরু হবে। এ পর্বে আইনজ্ঞ, সংবিধানবিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কমিশন ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করবে।গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে কমিশনের কার্যালয়ের বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। বৈঠক শেষে কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঐকমত্য হওয়া প্রস্তাব বা সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কমিশন পর্যায়ক্রমে বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে কথা বলবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো.
মনির হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ ও সনদে দলগুলোর স্বাক্ষর নেওয়ার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে তৃতীয় ধাপের কাজ শুরু হবে। এ পর্বে আইনজ্ঞ, সংবিধানবিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কমিশন ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা হবে, যাতে সনদে সইয়ের বিষয়ে দলগুলোকে কাছাকাছি আনা যায়। যেসব বিষয়ে ভিন্নমত আছে, সেগুলো কমিয়ে আনারও চেষ্টা থাকবে এই পর্বে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ল ই জ ত য় সনদ র স দ ধ ন ত হয় ঐকমত য হয় দলগ ল র স প রস ত ব প রক র য় ত য় পর ব ভ ন নমত এ পর ব প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
ঐকমত্য কমিশনের কাজ সফলভাবে শেষ হওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার অভিনন্দন
সাফল্যের সঙ্গে সব সক্রিয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লাগাতার বৈঠকের মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি ও বাস্তবায়নের রূপরেখা নির্ধারণ করায় জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বাসস লিখেছে, বাংলাদেশে একটি স্থায়ী জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে ঐকমত্য কমিশনের যাত্রা শুরু হয় চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি, যার মেয়াদ শেষ হয় ৩১ অক্টোবর।
আরো পড়ুন:
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ, নির্বাচনি প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা
সমবায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়া সম্ভব
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ আমাদের ঐতিহাসিক অর্জন। এই সনদ আমাদের জাতির এক মূল্যবান দলিল, যা আমাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনের পথকে কেবল সুগমই করবে না, জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে এবং আমাদের গণতন্ত্রকে সুসংহত করবে।”
প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, “জনগণ প্রত্যাশায় আছে জাতীয় জীবনে এমন কিছু পরিবর্তন দেখার জন্য, যা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাবে; এমন কিছু পরিবর্তন যা এদেশে আর কখনো কোনো স্বৈরাচারের আগমন ঘটতে দেবে না, এমন কিছু পরিবর্তন যা আমাদের জাতীয় জীবনে সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটাবে, সবার নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করবে।”
“সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, আমরা নিজেরাই এই সংস্কার প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে কাজ করেছি, একমত হয়েছি। বাইরের কেউ আমাদের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি,” বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
‘অতীতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে যে সমস্ত রাজনৈতিক সংলাপ হয়েছে, তাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আমরা বিদেশিদের আসতে দেখেছি’ জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “বন্ধু রাষ্ট্রসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে আনার চেষ্টা করেছেন। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে যে, আমাদের নিজেদের সংকট নিজেদেরই সমাধান করতে হবে।”
“এই কারণেই সকল রাজনৈতিক দল এক কাতারে এসেছে, রাজনৈতিক বিতর্কে অংশ নিয়েছে এবং আমাদেরকে সমাধানের পথ দেখিয়েছে। বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আমন্ত্রণ জানানোর পরিবর্তে আমরা নিজেরাই বিশ্ববাসীর দরবারে আমাদের জাতীয় ঐক্যকে তুলে ধরেছি,” বলেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলকে এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “রাজনৈতিক দলের নেতারা যারা এই সনদ তৈরিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তাদের সকলকে আমি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।”
এই জুলাই সনদ সারা বিশ্বের জন্যই একটি অনন্য দৃষ্টান্ত বলে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “পৃথিবীর আর কোথাও এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ঘটনা হয়ে থাকবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশও সংকটকালীন সময়ে দেশগঠনের পদক্ষেপ হিসেবে ‘ঐকমত্য কমিশন’ গঠনের কথা বিবেচনা করবে।”
প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক ও ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া এবং বিশেষ সহকারী মনির হায়দারকে ধন্যবাদ জানান। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ যারা মাসের পর মাস এই দীর্ঘ আলোচনার সঙ্গে থেকেছেন, ঐকমত্য কমিশনের সকল কার্যকলাপ মানুষের কাছে সহজ ভাষায় পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে, যে অভূতপূর্ব ঐক্য আমাদের মাঝে রয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারে এই জাতীয় ঐক্য আমাদের ধরে রাখতেই হবে। কারণ ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী এ জাতিকে বিভক্ত করতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছে। গত ১৫ মাস আমরা তাদের নানা ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করেছি। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করতে হলে, এই দেশকে বাঁচাতে হলে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই।”
‘দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ আছে’ বলে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কোনো একক ব্যক্তি, একক সংগঠন, একক সংস্থা অথবা একক সরকার দিয়ে সম্ভব হবে না; এজন্য সকল রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মধ্যে একতা থাকতে হবে, যত প্রতিকূলতাই আসুক না কেন ঐক্য ধরে রাখতে হবে।”
ঢাকা/রাসেল