ক্রিকেটকে নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে রাখতে মার্শালের ইন্টিগ্রিটি ইউনিট
Published: 19th, August 2025 GMT
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) দায়িত্ব ছাড়ার সময়ই অ্যালেক্স মার্শাল আগাম বলেছিলেন, ‘‘কম বাজেট ও পেশাদারিত্বের ঘাটতি আছে এমন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে জুয়াড়িদের নজর থাকে বেশি। প্রক্রিয়ার ভেতরেই দুর্বলতা খুঁজে নেয় তারা।’’
মার্শাল তখন আইসিসির অ্যান্টি করাপশন ইউনিটের জেনারেল ম্যানেজার। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সঙ্গে তার সম্পর্কটা গাঢ়। আইসিসিতেই তাদের পরিচয়। কেমন সেটা টের পাওয়া গেল মঙ্গলবার। যখন হোটেল সোনারগাঁওয়ে আমিনুলকে দেখে তিনি বললেন, ‘‘তুমি তাদের (গণমাধ্যম) কাছে খুব জনপ্রিয়। তোমার ডাকে সাড়া দেওয়ার পেছনে এটাও আমার বড় কারণ ছিল।’’
বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘হুমকি’তে ভরা। জুয়ারিদের নজর তো আছেই। সঙ্গে রয়েছে ফিক্সারদের থাবা। অতীতে তা প্রমাণও মিলেছে। গত দুয়েক বছর ধরে সেসব যেন চোখের সামনেই হচ্ছে। এজন্য স্বাধীন কমিটি গঠন করে তদন্ত করেছে বোর্ড। সপ্তাহখানেকের ভেতরেই সেই রিপোর্ট হাতে পাবেন আমিনুল, ‘‘আমাদের কাছে এখনও প্রতিবেদন আসেনি। আসার কথা আছে সামনের সপ্তাহে। আসার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’’
আরো পড়ুন:
বাংলাদেশের ক্রিকেট ‘পরিস্কার’ করতে অ্যালেক্স মার্শাল ঢাকায়
‘প্রো ভ্যালোসিটি’ ব্যাট ও ৪-৬ মিটারের দূরত্ব ঘুচানোর মিশন
সেই রিপোর্ট কী আসতে পারে তা আগাম ধারনা করতে পেরে অবসরে যাওয়া মার্শালকে বাংলাদেশ ক্রিকেটে যুক্ত করেছেন আমিনুল। যিনি বিসিবির অ্যান্টি করাপশন ইউনিট (আকু) পরামর্শক হিসেবে এক বছর কাজ করবেন।
কী কাজ করবেন সেটা নিয়ে পরিস্কার ধারণা দিলেন বাংলাদেশে পৌঁছার একদিনের ভেতরেই, ‘‘আমি এখানে আসার কারণ হলো সভাপতি এবং বোর্ডের সাথে কাজ করে একটি ইন্টিগ্রিটি ইউনিট তৈরি করা যা খেলাটিকে বিভিন্ন হুমকি থেকে রক্ষা করবে। বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন প্রায় এক-চতুর্থাংশ শতাব্দী ধরে ক্রিকেটের শীর্ষস্থানে রয়েছে এবং এটি নিশ্চিত করার সঠিক সময় যে মাঠে নারী ও পুরুষ ক্রিকেটাররা যেভাবে খেলছে বাইরের সমস্ত হুমকি থেকে সঠিকভাবে সুরক্ষিত এবং ভক্তরা সেই বিশ্বাস থেকেই খেলাটি মাঠে বসে দেখছে।’’
‘‘আমরা নিশ্চিত করব যে, বাংলাদেশের খেলোয়াড়, দেশের জন্য খেলা নারী এবং পুরুষরা সঠিকভাবে সুরক্ষিত। আমি আজ সভাপতি এবং সিইও এবং বোর্ডের কিছু সদস্যের সাথে দেখা করেছি। খেলাটি সুরক্ষিত রয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য অবিশ্বাস্যভাবে তারা সমর্থন করছে।’’
‘‘এজন্য আমরা একটি ইন্টিগ্রিটি ইউনিট তৈরি করব। এবং এর লক্ষ্য হল সবাইকে নিশ্চিত করা যেন তারা বুঝতে পারে হুমকি কেমন, তাদের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করা, তাদের নজর বাড়ানো এবং তাদের ও দলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমরা চাই, সেসব দুর্নীতিবাজরা যেন বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। ইন্টিগ্রিটি ইউনিট একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠাবে যে বাংলাদেশে এই খেলাটি পরিষ্কার থাকবে এবং বোর্ড এবং সভাপতি সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করছেন।’’
আইসিসি ছাড়ার সময় মার্শাল যেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, বাংলাদেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ বিপিএল যেন সেই প্রতিচ্ছবি। কম বাজেটের টুর্নামেন্ট। যেখানে মাঠের থেকে মাঠের বাইরের ইস্যুই বেশি আলোচনায় থাকে। সঙ্গে পেশাদারিত্বের প্রবল ঘাটতি। স্থায়ী কোনো রূপ, বড় দৈর্ঘর পরিকল্পনা এখনও হয়নি। সেসব জেনেই বাংলাদেশে এসেছেন মার্শাল।
সরাসরি না বললেও বিপিএল নিয়ে তার মূল্যায়ন এমনই, ‘‘ক্রিকেটে সবসময়ই বিশ্বের যে কোনো জায়গায় সবচেয়ে বড় হুমকি হলো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। তাই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে বিপিএল যেন দুর্বল লিগের মতো না দেখায়। তাই ইভেন্টটি যেভাবে পরিচালিত হয়, তাদের আর্থিক অবস্থা কীভাবে কাজ করে, দলের মালিকানা কীভাবে নির্ধারণ করা হয়, এই সমস্ত বিষয় উচ্চ-স্তরের এবং পেশাদার হতে হবে এবং সুরক্ষিত রাখতে হবে। বিশ্বের যেকোনো জায়গায়, যদি কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে পেশাদারিত্ব না থাকে, তাহলে এটি এটি দুর্নীতিবাজদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তা একসময় দুর্নীতিবাজদের দ্বারা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে যারা তাদের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।’’
‘‘এটা অনেক দেশেই ঘটেছে এবং বিপিএলের মধ্যে অবশ্যই কিছু সমস্যা ঘটেছে এবং আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে একটি নতুন ইন্টিগ্রিটি ইউনিট সেই সুরক্ষা প্রদান করে।’’ - যোগ করেন মার্শাল।
গতকাল ঢাকায় এসে আজ নিজের কাজের একটি প্রেজেন্টেশন বোর্ডকে দেখিয়েছেন মার্শাল। পরিচালক ও কর্মকর্তারা তাকে কিছু বিষয়ও জানিয়েছেন। সেসব নিয়ে আগামী তিন-চার সপ্তাহ কাজ করবেন। এছাড়া নিজের বিভাগ নিয়েও আলাদা করে বসে বেশ কিছু বিষয় জেনেছেন। আগামীকালই তার ফেরার কথা রয়েছে। চার সপ্তাহ পর ফের বাংলাদেশে এসে নিজের ডিজাইন অনুযায়ী কাজ শুরু করবেন।
ক্রিকেটকে নিরাপদ রাখতে মার্শাল দীর্ঘ মেয়াদী কাজ করার ওপর জোর দিয়েছেন। এজন্য শিক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বারবার বলেছেন। নিয়ম লঙ্ঘন করলে যেমন শাস্তির বিষয়টি তার কথায় উঠে এসেছে। ঠিক তেমননি ভালো কাজের পুরস্কারের ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন।
আগামী বিপিএল নিয়ে নিজের ভাবনাও খোলাসা করেছেন মার্শাল, ‘‘বিশ্বজুড়ে যেকোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হল যখন এটি দুর্বল বলে মনে হয়। সেই জন্যই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে বিপিএল যেন সেই ধারণা তৈরি না করে। টুর্নামেন্টটি যেভাবে পরিচালিত হয়, কীভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনা করা হয় এবং দলের মালিকানা কীভাবে গঠন করা হয় - এই সবকিছুই উচ্চ, পেশাদার মানদণ্ডে এবং সঠিকভাবে সুরক্ষিতভাবে পরিচালনা করা উচিত।’’
ঢাকা/ইয়াসিন/আমিনুল
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ফ র য ঞ চ ইজ ন শ চ ত কর ইন ট গ র ট স রক ষ ত পর চ ল আম দ র আম ন ল ক জ কর ব প এল আইস স ইউন ট করব ন
এছাড়াও পড়ুন:
পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে
অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।
১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’
এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।
পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)