লিভার ট্রান্সপ্লান্ট: বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে
Published: 26th, August 2025 GMT
লিভার আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। লিভার সিরোসিস, হেপাটাইটিস বি ও সি, লিভার ক্যান্সার বা জন্মগত ত্রুটির মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হলে অনেক সময় Transplant ছাড়া রোগীর বাঁচার অন্য কোনো বিকল্প থাকে না। এখনো লিভার ট্রান্সপ্লান্ট শুধুমাত্র বিদেশে গিয়েই করা সম্ভব, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
অত্যন্ত আনন্দের বিষয় সময়ের পরিবর্তনে বাংলাদেশ এখন এই জীবনরক্ষাকারী অস্ত্রোপচারটি দেশের ভেতরেই সফলভাবে করার দিকে এগিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের যাত্রা শুরু হয়েছিল কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়ে। ২০১০ সালে বারডেম হাসপাতালে প্রথম লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করা হলেও তা স্থায়ী সাফল্য পায়নি। তবে ২০১৯-২০২০ সালের দিকে ঘটনা প্রবাহ দ্রুত বদলায়। দেশের শীর্ষস্থানীয় সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো, যেমন জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট, বিএমইউ, বারডেম, ইউনাইটেড হাসপাতাল, কেপিজে হাসপাতালে দক্ষ হেপাটোবিলিয়ারি সার্জন, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলিজিস্ট, হেপাটোলজিস্ট, এনেস্থেশিওলজিস্ট এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (ICU) নিয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ দল গড়ে তোলায় মনোযোগী হয়। এই উদ্দেশ্যে তারা দেশের বাইরে বিশেষ করে ইণ্ডিয়া, কোরিয়া, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিত ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে।
২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (BMDC) সরকারিভাবে দুটি হাসপাতালকে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করার অনুমোদন দেয়। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
প্রতিবছর বাংলাদেশে ৫০০০-৬০০০ জন রোগীর লিভার ট্রান্সপ্লান্ট প্রয়োজন। এরমধ্যে মাত্র ১৭০-১৮০ জন বিদেশে গিয়ে এই সেবা নিতে সক্ষম হন। বাকি রোগীগুলো বিনাচিকিৎসায় ধুকতে ধুকতে মারা যান, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
বর্তমানে বাংলাদেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক দেখা যাচ্ছে।
সফল হেপাটোবিলিয়ারি অস্ত্রোপচার যেমন লিভার রিসেকসশনসহ অন্যান্য সার্জারীর সংখ্যা বাড়ছে সংখ্যা। দেশেই ট্রান্সপ্লান্ট করার উপযোগী দক্ষ মেডিকেল টিম এবং হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ছে। দেশের মেধাবী ডাক্তাররা এখন লিভার ট্রান্সপ্লান্টের জন্য প্রশিক্ষিত। অনেকেই ভারত, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের নামকরা প্রতিষ্ঠানে থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরেছেন।
বিদেশে, বিশেষ করে ভারত, সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে গেলে খরচ পড়ে ৩৫ লাখ থেকে ১ কোটিরও বেশি টাকা। বাংলাদেশে এই খরচ এখন ২০-৩০ লাখ টাকার মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব। এছাড়াও দেশে চিকিৎসা করালে পরিবারের সদস্যদের পাশে থাকা, পরিচিত পরিবেশ এবং ভাষাগত সমস্যা না থাকা একটি বড় সুবিধা। যেসকল রোগীরা সামর্থ্যবান নন তাদের জীবন বাঁচাতে সামর্থ্যবানদের এগিয়ে আসতে হবে।
তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। আমাদের রয়েছে সামাজিক সচেতনতার অভাব। লিভিং ডোনর (জীবিত দাতা) হিসেবে সাধারণত পরিবারের সদস্যরাই এগিয়ে আসেন। কিন্তু লিভার দান করা নিরাপদ কিনা, এর পর কী জটিলতা হতে পারে—এ বিষয়ে এখনও সবাই পুরোপুরি অবগত নন। জেনে রাখা জরুরী, লিভার দিলে ডোনারের সামান্য একটা অপারেশন ব্যতীত অন্যকোনো সমস্যা হয় না। তিন-চার মাসের মধ্যে লিভার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়।
ডিসিসড ডোনার বা ব্রেইনডেথ রোগীদের অরগান নেয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট জটিলতা আছে। সামাজিক এবং ধর্মীয় ভাবেও আমরা এই বিষয়ে সচেতন বা অবগত নই। মরোনোত্তর চক্ষুদান যেমন একটা অত্যন্ত চমৎকার কাজ, এক্সিডেন্ট বা অন্যান্য অসুখের কারণে অনেক হাসপাতালে অনেক ব্রেইনডেথের রোগী থাকে, তাদের আত্মীয়স্বজনেরা চাইলেই লিভার/কিডনি দান করে আরেকজন মরণোন্মুখ রোগীকে নতুন জীবন দিতে পারেন। এই বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী।
ট্রান্সপ্লান্টের পর রোগীকে আজীবন বিশেষ ওষুধ (Immunosuppressants) খেতে হয় এবং নিয়মিত follow-up করতে হয়। এই ওষুধগুলো বেশ দামি। সরকারি সহায়তা বা বীমার আওতা বাড়লে রোগীর উপর এই চাপ কমবে।
সবাই আন্তরিক হলে বাংলাদেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট অত্যন্ত কম খরচেই করা সম্ভব এমনকি বিদেশ থেকেও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করার জন্য বাংলাদেশে রোগীরা আসবে।
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সকল ধরনের সহযোগিতা এবং সমর্থন পেলে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট এদেশেই অত্যন্ত সফলভাবে করা সম্ভব।
লেখক: কনসালটেন্ট, ট্রান্সপ্লান্ট, সার্জিক্যাল আইসিইউ, এক্সিডেন্ট এণ্ড ইমার্জেন্সি কেয়ার সেন্টার,।
United Healthcare Services Ltd.
ঢাকা/লিপি
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
ঐকমত্য কমিশনের কাজ সফলভাবে শেষ হওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার অভিনন্দন
সাফল্যের সঙ্গে সব সক্রিয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লাগাতার বৈঠকের মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি ও বাস্তবায়নের রূপরেখা নির্ধারণ করায় জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বাসস লিখেছে, বাংলাদেশে একটি স্থায়ী জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে ঐকমত্য কমিশনের যাত্রা শুরু হয় চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি, যার মেয়াদ শেষ হয় ৩১ অক্টোবর।
আরো পড়ুন:
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ, নির্বাচনি প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা
সমবায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়া সম্ভব
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ আমাদের ঐতিহাসিক অর্জন। এই সনদ আমাদের জাতির এক মূল্যবান দলিল, যা আমাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনের পথকে কেবল সুগমই করবে না, জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে এবং আমাদের গণতন্ত্রকে সুসংহত করবে।”
প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, “জনগণ প্রত্যাশায় আছে জাতীয় জীবনে এমন কিছু পরিবর্তন দেখার জন্য, যা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাবে; এমন কিছু পরিবর্তন যা এদেশে আর কখনো কোনো স্বৈরাচারের আগমন ঘটতে দেবে না, এমন কিছু পরিবর্তন যা আমাদের জাতীয় জীবনে সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটাবে, সবার নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করবে।”
“সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, আমরা নিজেরাই এই সংস্কার প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে কাজ করেছি, একমত হয়েছি। বাইরের কেউ আমাদের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি,” বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
‘অতীতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে যে সমস্ত রাজনৈতিক সংলাপ হয়েছে, তাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আমরা বিদেশিদের আসতে দেখেছি’ জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “বন্ধু রাষ্ট্রসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে আনার চেষ্টা করেছেন। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে যে, আমাদের নিজেদের সংকট নিজেদেরই সমাধান করতে হবে।”
“এই কারণেই সকল রাজনৈতিক দল এক কাতারে এসেছে, রাজনৈতিক বিতর্কে অংশ নিয়েছে এবং আমাদেরকে সমাধানের পথ দেখিয়েছে। বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আমন্ত্রণ জানানোর পরিবর্তে আমরা নিজেরাই বিশ্ববাসীর দরবারে আমাদের জাতীয় ঐক্যকে তুলে ধরেছি,” বলেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলকে এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “রাজনৈতিক দলের নেতারা যারা এই সনদ তৈরিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তাদের সকলকে আমি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।”
এই জুলাই সনদ সারা বিশ্বের জন্যই একটি অনন্য দৃষ্টান্ত বলে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “পৃথিবীর আর কোথাও এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ঘটনা হয়ে থাকবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশও সংকটকালীন সময়ে দেশগঠনের পদক্ষেপ হিসেবে ‘ঐকমত্য কমিশন’ গঠনের কথা বিবেচনা করবে।”
প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক ও ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া এবং বিশেষ সহকারী মনির হায়দারকে ধন্যবাদ জানান। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ যারা মাসের পর মাস এই দীর্ঘ আলোচনার সঙ্গে থেকেছেন, ঐকমত্য কমিশনের সকল কার্যকলাপ মানুষের কাছে সহজ ভাষায় পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে, যে অভূতপূর্ব ঐক্য আমাদের মাঝে রয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারে এই জাতীয় ঐক্য আমাদের ধরে রাখতেই হবে। কারণ ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী এ জাতিকে বিভক্ত করতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছে। গত ১৫ মাস আমরা তাদের নানা ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করেছি। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করতে হলে, এই দেশকে বাঁচাতে হলে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই।”
‘দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ আছে’ বলে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কোনো একক ব্যক্তি, একক সংগঠন, একক সংস্থা অথবা একক সরকার দিয়ে সম্ভব হবে না; এজন্য সকল রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মধ্যে একতা থাকতে হবে, যত প্রতিকূলতাই আসুক না কেন ঐক্য ধরে রাখতে হবে।”
ঢাকা/রাসেল