আন্তর্জাতিক বাজার হারাচ্ছে কাঁচাপাট
Published: 28th, August 2025 GMT
আন্তর্জাতিক বাজার হারাতে বসেছে কাঁচাপাট। এক সময় ২৯টি দেশে রপ্তানি হলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২টি দেশে। কমেছে রপ্তানির পরিমাণও।
মূলত, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশের বাজার হারাচ্ছে পাট। ফলে রপ্তানিকারকরা যেমন আর্থিকভাবে লোকসানের সম্মুখীন, তেমনই ব্যাংকের ঋণ খেলাপিও হয়েছেন। এসব কারণে দেশের অন্যতম কাঁচাপাটের মোকাম খুলনার দৌলতপুরে মন্দাভাব বিরাজ করছে।
আরো পড়ুন:
হিলি বন্দরে রপ্তানি আয় ১৮ কোটি টাকা
হিলি স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ
বাংলাদেশ জুট এ্যাসোসিয়েশন ও পাট অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইতালি, রাশিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, ইরান, নেপাল, স্পেন, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ২৯টি দেশে পাট রপ্তানি হয়েছে। অথচ, বিদায়ী অর্থবছরে ১২টি দেশে রপ্তানি হয়।
যে ১৭ দেশের বাজার হারিয়েছে কাঁচাপাট: বেলজিয়াম, কিউবা, মিশর, এল-সালভাডোর, ইথিওপিয়া, জার্মানি, হল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইতালি, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, তানজানিয়া, জায়ার, রোমানিয়া ও ফিলিপাইন।
যে ১২ দেশে রপ্তানি হচ্ছে : ভারত, পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ব্রাজিল, ইউকে, ভিয়েতনাম, তিউনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, আইভরি কোস্ট, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র।
পাট ব্যবসায়ীরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ, দফায় দফায় রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা, করোনা, ডলারের মূল্য উঠানামা বিশ্ব বাজার হারানোর অন্যতম কারণ।
কমেছে রপ্তানি:
২০১০-২০১১ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২১ লাখ ১২ হাজার ৪০০ বেল পাট রপ্তানি হয়। যা থেকে আয় ছিল ১ হাজার ৯০৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। গেল ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ১ হাজার ৯৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা মূল্যের ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৫৬৯ বেল পাট রপ্তানি হয়েছে।
পাটের বাজার হারানোর বিষয়ে গাজী জুট ইন্টারন্যাশনালের রপ্তানিকারক গাজী শরিফুল ইসলাম বলেন, “উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মানসম্মত পাট আমাদের দেশে হয়। এই পাট রপ্তানিতে বিভিন্ন সময়ে বাঁধা আসে। ২০০৯-২০১০ সালের পর দুই-তিন দফায় পাট রপ্তানি বন্ধ হয়। যেসব দেশ বাংলাদেশের পাটে নির্ভরশীল, রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় সেসব দেশের মিলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে পাটের বাজার কমেছে।”
তিনি আরো বলেন, “আগে সড়কপথে ভারতে পাট যেত। বর্তমানে জলপথে জাহাজের মাধ্যমে যায়। ফলে পাট পাঠাতে সময় ও ব্যয় বেড়েছে। অবশ্য এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভারতের ব্যবসায়ীরা। কয়েকগুণ খরচ বেড়েছে তাদের।”
দৌলতপুর সারতাজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের রপ্তানিকারক বদরুল আলম মার্কিন বলেন, “বাজারে চাহিদা কমেছে। বিভিন্ন দেশের মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রপ্তানির কমছে। ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে পাট রপ্তানি করি। বর্তমানে এই তিনটি দেশ পাটের সবচেয়ে বড় বাজার।”
বাংলাদেশ জুট এ্যাসোসিয়েনের (বিজেএ) চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ আকন্দ বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের শুরু থেকে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়। রপ্তানির শুরুর পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে রপ্তানি বন্ধের সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাহিরের দেশের মিলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য বাজার কিছুটা হারিয়েছি এবং রপ্তানিও কমেছে। তবে বাজার সৃষ্টি করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।”
ভারতের নিষেধাজ্ঞা:
গত ২৭ জুন ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এক প্রজ্ঞাপনে ভারতের সমস্ত স্থলবন্দরে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় কাঁচাপাট, পাটের রোল, পাটের সুতা, বোনা কাপড়, সুতার পণ্যসহ ৯ ধরনের পাটপণ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে এ-ও উল্লেখ আছে যে, সব স্থলবন্দর বন্ধ করা হলেও মহারাষ্ট্রের নহাভা শেভা সমুদ্রবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য ভারতে আমদানি করা যাবে। এছাড়াও ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে যাওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না। তবে, এই পণ্যগুলো নেপাল বা ভুটান থেকে পুনরায় ভারতে রপ্তানি করা যাবে না। তাদের এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের কৃষক, কাঁচাপাট রপ্তানিকারক ও ভারতের কলকাতার ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১২টি দেশে কাঁচাপাট রপ্তানি হয়েছিল।এর মধ্যে ভারতেই সবচেয়ে বেশি পাট রপ্তানি হয়েছে। এরপর নেপাল, পাকিস্তান, আইভরি কোস্ট, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি হয়েছে। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ ও খুলনার প্রায় ২৫ জন ব্যবসায়ী কাঁচাপাট রপ্তানির সঙ্গে জড়িত।
ঢাকা/মাসুদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবস য় র
এছাড়াও পড়ুন:
শেষে এসে ‘বিপদে’ ওয়াসা
একের পর এক জটিলতায় পড়ছে চট্টগ্রাম ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পটি। অর্থ বরাদ্দের সংকট, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বকেয়া নিয়ে বিরোধ, কাজের ধীরগতি—সব মিলিয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজ বর্ধিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
প্রায় ৫ হাজার ২০৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ২২টি ওয়ার্ডের ২০ লাখ মানুষের জন্য আধুনিক পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা রয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৭০ শতাংশ। এই সময়ে এসে নানা জটিলতায় ‘বিপদে’ পড়েছে ওয়াসা।
‘চট্টগ্রাম মহানগরের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এরপর প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। মেয়াদ বেড়েছে তিন দফা। ২০২৩ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি।
বর্তমানে অর্থ বরাদ্দের সংকট নিয়ে বিপাকে আছে ওয়াসা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংস্থাটি চেয়েছিল ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে ৭৪৪ কোটি। চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) দরকার ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৬৭৬ কোটি টাকা। প্রকল্পে খরচ হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছিল। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত করা কাজের টাকা আমরা পাইনি। আগেও একই কারণে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল, পরে আশ্বাস পেয়ে শুরু করেছিলাম। এবারও সেই পরিস্থিতি।প্রকল্প পরিচালক, এসএ ইঞ্জিনিয়ারিংসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই নির্বাচনী মৌসুমে প্রকল্প বরাদ্দে আরও অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। অর্থ না এলে প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়বে। ২০২৭ সালের শুরুতে এ প্রকল্পের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। কাজ শেষ না হলে এই পরিকল্পনা পিছিয়ে যাবে।
জানতে চাইলে ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, গত বছরই অর্থ বরাদ্দের অভাবে অনেক কাজ আটকে ছিল। এ বছরও চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না পেলে সময়সীমা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের বিষয়ে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
বর্তমানে অর্থ বরাদ্দের সংকট নিয়ে বিপাকে আছে ওয়াসা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংস্থাটি চেয়েছিল ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে ৭৪৪ কোটি। চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) দরকার ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৬৭৬ কোটি টাকা।প্রকল্পের নথিতে বলা হয়, দৈনিক ১০ কোটি লিটার পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পয়োশোধনাগার, দৈনিক ৩০০ ঘনমিটার পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সেপটিক ট্যাংকের বর্জ্য শোধনাগার, ২০০ কিলোমিটার পয়োনালা নির্মাণ করা হবে। এতে চট্টগ্রাম নগরের ২২টি ওয়ার্ডের ৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্রকল্পের আওতায় আসবে। আর উন্নত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার সুফল পাবেন ২০ লাখ মানুষ।
এখনো কাজ বন্ধ, অর্থের টানাপোড়েন
প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাইপলাইন স্থাপনের কাজ ১৫ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাইয়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড উপঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধ না করায় সাতটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান কাজ বন্ধ রেখেছে।
হালিশহর এলাকায় পাইপ বসানোর কাজ করছে মেসার্স নূর এন্টারপ্রাইজ, এসএ ইঞ্জিনিয়ারিং, জাহান এন্টারপ্রাইজ, দেশ কন্ট্রাক্টরস অ্যান্ড ডেভেলপার লিমিটেড, ইনাস এন্টারপ্রাইজ, পোর্ট হারবার ইন্টারন্যাশনাল ও পাওয়ার বাংলা করপোরেশন। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, তাদের প্রায় ৪৬ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার তাইয়ং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় উপঠিকাদাররা দুটি শর্তে কাজ শুরুতে রাজি হয়েছেন—আগামী সোমবারের মধ্যে ৫০ শতাংশ বকেয়া পরিশোধ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি অর্থ নিষ্পত্তি।
জানতে চাইলে এসএ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রকল্প পরিচালক আহাদুজ্জামান বাতেন বলেন, ‘চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছিল। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত করা কাজের টাকা আমরা পাইনি। আগেও একই কারণে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল, পরে আশ্বাস পেয়ে শুরু করেছিলাম। এবারও সেই পরিস্থিতি।’
আহাদুজ্জামান জানান, ‘মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনায় আমরা দুটি শর্ত দিয়েছি—সোমবারের মধ্যে ৫০ শতাংশ বিল পরিশোধ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি অর্থ নিষ্পত্তি। এ দুই শর্তে কাজ আবার শুরু করছি।’