কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেখানে রয়েছে আসন সংকট, বই সংকট, অব্যবস্থাপনাসহ নানা সীমাবদ্ধতা। প্রায় ৬ হাজার ৮৮৮ জন শিক্ষার্থীর জন্য বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ১২০টি আসন।

ফলে প্রতিটি আসনের বিপরীতে গড়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ৫৭ জন। এ কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার অনুকূল পরিবেশ থেকে বঞ্ছিত হয়ে দিনদিন লাইব্রেরি বিমুখ হয়ে পড়ছেন।

আরো পড়ুন:

হল ছাড়ার নির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করে বাকৃবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

চবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গোবিপ্রবিতে বিক্ষোভ

লাইব্রেরি সূত্রে জানা গেছে, লাইব্রেরিতে বর্তমানে প্রায় ২৭ হাজার বই থাকলেও নিয়মিত কোর্সের সব বই পাওয়া যায় না এবং বিশেষায়িত বইয়েরও রয়েছে প্রবল সংকট। নেই কোনো আন্তর্জাতিক জার্নাল, নেই ই-বুক অ্যাপস কিংবা ডিসপ্লে সিস্টেম। শিক্ষকদের জন্য অ্যান্টি-প্ল্যাজারিজম সফটওয়্যারও চালু হয়নি এখনো।

লাইব্রেরিতে ১৬টি টেবিল ভাগ করে তৈরি করা হয়েছে ১২০টি আসন, যেখানে শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে বসতে হয়। এছাড়া, কম্পিউটার রয়েছে মাত্র ২০টি, যার মধ্যে একটি নষ্ট। নেই কোনো প্রিন্টার এবং ফটোকপি মেশিন।

শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, মাঝে মাঝে নির্দিষ্ট সেলফে প্রয়োজনীয় বই থাকে না। লাইব্রেরির মোট আসন মাত্র ১২০টি, যেখানে তাদের (শিক্ষার্থীদের) গাদাগাদি করে বসতে হয়। কম্পিউটার যা রয়েছে তা শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক কম। এর মধ্যে কয়েকটিতে পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখারও অভিযোগ রয়েছে। গ্রুপ স্টাডির রুমে নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। আবার ফ্যান থাকলেও কয়েকটি নষ্ট হয়ে আছে। ফলে গরমে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ভোগান্তি হয়।

পাশাপাশি, লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে মাত্র দুটি ওয়াশরুম, যা অপর্যাপ্ত। পানির ফিল্টারও কিছুদিন যাবৎ বিকল হয়ে আছে। অন্যদিকে, লাইব্রেরিতে আলাদা ঝাড়ুদার না থাকায় সপ্তাহে একবার ঝাড়ু দেওয়া হয়। ফলে লাইব্রেরির ভেতরে নিয়মিতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় থাকে না।

এছাড়া কর্মকর্তাদের ফোনে কথা বলা ও লাইব্রেরির অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীদের কথোপকথনের কারণে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হয় বলেও অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা গাদাগাদি করে বসে পড়াশোনা করছেন। দুই চেয়ারের মাঝে ফাঁকা জায়গা না থাকায় কেউ উঠতে গেলে পুরো রুমে শব্দ ছড়িয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত বই ও প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি, বাজেট সংকটসহ সবমিলিয়ে পড়াশোনার অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা।

কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির নানা সংকট নিয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মুশফিকা জান্নাত বলেন, “আমাদের লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় সব বই পাওয়া যায় না, যেটা বড় সমস্যা। অনেক সময় বই পাওয়া গেলেও, তা ভিন্ন লেখকের হয়। তাই আমাদের লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় সব অ্যাকাডেমিক বইয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যা আমাদের পড়াশোনায় সহযোগিতা করবে।”

বাংলা বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজা তুল তাহিরা বলেন, “লাইব্রেরি হলো জ্ঞানের ঘর। আমাদের বাংলা বিভাগের গবেষণা ক্ষেত্র লাইব্রেরির বই নিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত পরিমাণের বই নেই। বিশেষ করে, অ্যাকাডেমিক বইগুলো নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এখানে অল্প কিছু সংখ্যক বই থাকে, যার কারণে আমরা অনেক সমস্যায় পড়ছি।”

ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ইসমাইল হোসাইন বলেন, “প্রশাসনিক ভবনের পাঁচতলায় লাইব্রেরি হওয়ার কারণে সেখানে যাওয়া আসা একদিকে যেমন কষ্টসাধ্য, অন্যদিকে সময় সাপেক্ষ। ফলে লাইব্রেরির প্রতি অনেকেই অনীহা প্রকাশ করে। নতুন করে গ্রুপ ডিসকাশনের অংশ চালু হলেও তা এত শিক্ষার্থীর তুলনায় অপ্রতুল।”

লোক প্রশাসন বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান শাহিন বলেন, “প্রায় সময় দেখি আমরা লাইব্রেরি প্রবেশের পর ঝাড়ু দেওয়া হচ্ছে। এতে যাদের ধুলাবলির অ্যালার্জি, তাদের জন্য এটি বড় সমস্যা। এখানে যারা কাজ করে, তারা মোবাইলে ফোনে কথা বলে পড়ার পরিবেশ নষ্ট করে। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি হিসেবে এখানে পর্যাপ্ত বই পাওয়া যায় না এটি সত্যি দুঃখজনক।”

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান মো.

মহিউদ্দীন আলম বলেন, “আমাদের এখানে নানা সমস্যা আছে। এর যথেষ্ট কারণও আছে। বাজেট সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় সব বই নিয়ে আসতে পারছি না। এছাড়াও সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এখানে জায়গার অভাব। আমাদের যে বইগুলো আছে সেগুলোর রাখার মতো সেলফ নেই। সেলফ এনে রাখার মতো জায়গাও নেই।”

তিনি বলেন, “পানির ফিল্টারের যে সমস্যা সেটা দ্রুতই সমাধান করা হবে। আর আমাদের নিজস্ব কোনো ঝাড়ুদার না থাকায় এখানে একজন ঝাড়ু দিতে আসে সপ্তাহে একদিন। সে কারণে অনেক সময় ঝাড়ু দিতে দেরি হয়ে যায়।”

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, “এখন আমাদের সবার কাছে ডিভাইস আছে। চাইলে অনলাইনে সবকিছুর উন্নত সংস্করণের বই পাওয়া যায়। অনলাইনে সর্বশেষ সংস্করণের বই এবং লেকচার শিট পাওয়া যায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা দিয়েছে। এটি ব্যবহার করে অনলাইন মেটেরিয়াল কাজে লাগিয়ে আমাদের এই নতুন সংস্কৃতিতে ফিরতে হবে। এই উন্নত উন্মুক্ত বিষয়গুলো পড়ে নিজেকে কতটা উপরে নিয়ে যাওয়া যায় এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি আরো বলেন, “আমরা ভালো কিছু করার চেষ্টা করছি, এখানে টাকা খরচ হয় ভুল জায়গায়; যা সঠিক জায়গায় করার কথা ছিল। আমরা বিভাগকে বইয়ের তালিকা দিতে বলি, অনেকে দেয় আবার অনেকে দেয় না। শেষে ঘুরে ঘুরে পচা বইটাই নিতে হয়। আমাদের কোনো নীতিমালাও নেই যে আমরা ইউরোপ-আমেরিকা থেকে বই কিনব। আমরা অ্যান্টি-প্লেজিয়ারিজমের জন্য সফটওয়্যার কিনেছি, যার মধ্যে ১০০টি অ্যাকাউন্ট আছে। প্রতিটি বিভাগের জন্য দুইটি করে এবং ২০টি কম্পিউটারের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলেছি।”

আসন সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “লাইব্রেরিতে তেমন শিক্ষার্থী যায় না। এখন গিয়ে দেখুন লাইব্রেরিতে কয়জন আছে। এখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী লাইব্রেরিতে যায় পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় প্রস্তুতির জন্য।”

ঢাকা/মেহেদী

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর শ ক ষ বর ষ র শ ক ষ র থ পর য প ত দ র জন য পর ব শ আম দ র সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে

অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।

১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’

এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।

পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।

পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)

সম্পর্কিত নিবন্ধ