আধুনিক সমাজে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দূষণ আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থাকে অশান্ত ও ভঙ্গুর করার চেষ্টা করছে। এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অভিভাবকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

ইসলামি শিক্ষা ও সিরাতুন্নবী (সা.)-এর আলোকে শিশুদের নিরাপদে বেড়ে ওঠার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিচে তুলে ধরা হলো।

নিরাপত্তার প্রাথমিক পদক্ষেপ

শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অভিভাবকদের নিচের বিষয়গুলোয় মনোযোগী হতে হবে:

পারিবারিক সময়: মা-বাবার সঙ্গে নিয়মিত সময় কাটানো শিশুদের আবেগগত নিরাপত্তা প্রদান করে। খোলামেলা আলোচনা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া শিশুদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

অনলাইন নিরাপত্তা: শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারে বয়স উপযোগী কনটেন্ট নিশ্চিত করতে হবে। ইসলামি নৈতিকতার আলোকে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও সীমাবদ্ধতা শেখানো জরুরি।

ব্যক্তিগত সীমারেখা: শিশুদের শরীরের ব্যক্তিগত অঙ্গ সম্পর্কে সচেতনতা এবং ‘না’ বলার অধিকার শেখানো অপরিহার্য।

মোটকথা, পরিবারের ভেতরে ও বাইরে শিশুদের নৈতিক ও সামাজিক আত্মরক্ষার জন্য ইসলামি আদব ও ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয় প্রয়োজন।

শিশুদের প্রশিক্ষণে ইসলামি পদ্ধতি

শিশুদের সুচিন্তিত প্রশিক্ষণের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ:

ইসলামি মূল্যবোধ: আল্লাহভীতি, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও সত্যবাদিতা শেখানো।

ইতিবাচক পরামর্শ: বকাঝকার পরিবর্তে যুক্তি ও ভালোবাসার মাধ্যমে বোঝানো এবং ভালো কাজের প্রশংসা করা।

শৃঙ্খলা ও সহানুভূতি: শৃঙ্খলা শেখানোর ক্ষেত্রে কঠোরতার বদলে সহানুভূতি ও যুক্তি ব্যবহার করা।

দোয়া ও আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক: শিশুদের জন্য নিয়মিত দোয়া করা এবং তাদের আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা।

যে দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হবে না।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৯৯৭আরও পড়ুনমুসলিম পরিবারে শিশুর ৫ দায়িত্ব০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ছেলে ও মেয়ে সন্তানের জন্য পৃথক বিবেচনা

ইসলামি শিক্ষার আলোকে ছেলে ও মেয়েসন্তানের জন্য কিছু পৃথক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন:

ছেলেসন্তানের জন্য

পরিবারের রক্ষক ও দায়িত্বশীল হিসেবে গড়ে তোলা।

নারীদের প্রতি সম্মান ও তাদের হক আদায়ের শিক্ষা দেওয়া।

গৃহস্থালি কাজের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতিশীল মনোভাব গড়ে তোলা।

সাহস, নম্রতা ও বিনয়ী আচরণে অভ্যস্ত করা।

ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, নামাজ, সময়ানুবর্তিতা ও পরিশ্রমের অভ্যাস গড়ে তোলা।

মেয়েসন্তানের জন্য

আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা।

পর্দা, শালীনতা ও নিরাপত্তার শিক্ষা ভালোবাসার মাধ্যমে দেওয়া।

ইসলামে নারীর হক, শিক্ষা ও মতামতের গুরুত্ব শেখানো।

গৃহস্থালি ও পেশাগত দক্ষতার ভারসাম্য গড়ে তোলা।

সিরাত থেকে শিক্ষা

নবীজির জীবন ছিল শিশুদের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতির অপূর্ব দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবন থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা আমাদের শিশুদের নিরাপত্তা ও লালন-পালনের পথ দেখাতে পারে:

শিশুর প্রতি ভালোবাসা: একবার এক বেদুইন নবী (সা.

)-এর কাছে এসে বললেন, ‘আমার সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা আমার নেই।’ নবী (সা.) তখন তাঁর নাতি হাসান (রা.)-কে কোলে তুলে চুমু খেলেন।

বেদুইন অবাক হয়ে বললেন, ‘আমার দশ সন্তান, কিন্তু আমি কখনো কাউকে চুমু খাইনি।’ নবীজি (সা.) বললেন: ‘যে দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হবে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৯৯৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৩১৮)

এই হাদিস শিশুদের প্রতি স্নেহ ও কোমল আচরণের গুরুত্ব তুলে ধরে।

আরও পড়ুনশিশুর খাদ্যনিরাপত্তায় ইসলামের নির্দেশনা২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শিশুর মানসিক নিরাপত্তা: একবার নবীজি (সা.) নামাজে থাকাকালে তাঁর নাতি হাসান (রা.) তাঁর পিঠে উঠে গেলেন। নবীজি (সা.) তাকে বিরক্ত না করে দীর্ঘ সময় সিজদায় থাকলেন। নামাজ শেষে তিনি বললেন, ‘আমার নাতি আমার পিঠে উঠেছিল, আমি চাইনি তাকে তাড়াতাড়ি নামিয়ে দিয়ে বিরক্ত করি।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ১১৪১)

এ ঘটনা শিশুদের মানসিক নিরাপত্তা ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণের গুরুত্ব শেখায়।

নামাজ ও ইবাদতের শিক্ষা: নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও এবং ১০ বছর বয়সে এর জন্য তাদের শাসন করো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯৫)

এই হাদিস শিশুদের ছোটবেলা থেকে নামাজ ও ইবাদতের প্রতি আগ্রহী করে তোলার নির্দেশ দেয়।

তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও এবং ১০ বছর বয়সে এর জন্য তাদের শাসন করো।সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯৫আধুনিক প্রেক্ষাপটে শিশুনিরাপত্তা

বর্তমান যুগে প্রযুক্তির অপব্যবহার শিশুদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিভাবকদের নিম্নলিখিত বিষয়ে সচেতন হতে হবে:

প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার: শিশুদের ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারে সীমারেখা শেখানো। কোন কনটেন্ট গ্রহণযোগ্য এবং কার সঙ্গে যোগাযোগ করা নিরাপদ, তা বোঝানো।

শালীনতা ও পর্দা: ঘরে ইসলামি শিষ্টাচার ও পর্দার চর্চা করা। উদাহরণস্বরূপ, আয়েশা (রা.) সাহাবিদের সঙ্গে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতেন, যা শিশুদের জন্য শালীনতার শিক্ষা। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৮০)

পারিবারিক পরিবেশ: অভিভাবকদের আচরণ, পোশাক ও কথাবার্তা শিশুদের জন্য শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। ঘরে শালীনতা ও সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।

শিশুরা আল্লাহর দেওয়া অমূল্য নিয়ামত। তাদের সঠিক লালন-পালন মুসলিম পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সিরাতুন্নবীর আলোকে শিশুদের তাওহিদ, আখলাক, নামাজ ও শালীনতার শিক্ষা দেওয়া এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখানো তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

নবীজি (সা.)-এর জীবন থেকে শিশুদের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি ও শৃঙ্খলার শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে পারি, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবে এবং সমাজে ইতিবাচক অবদান রাখবে।

[email protected]

মারদিয়া মমতাজ: শিক্ষক, গবেষক, প্রকৌশলী

আরও পড়ুনইসলাম অনুসারে সন্তানের আধুনিক নাম৩০ জুলাই ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ শ দ র জন য ও সহ ন ভ ত ন শ চ ত কর ব যবহ র র আল ক র সন ত পর ব র শ ল নত ইসল ম বলল ন

এছাড়াও পড়ুন:

মোহাম্মদপুরে বাসে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীকে হেনস্তার ভিডিও ভাইরাল, হেনস্তাকারী গ্রেপ্তার

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাসে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীর পোশাক নিয়ে কটূক্তি ও হেনস্তার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার তিন দিন পর হেনস্তাকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। গ্রেপ্তার নাজিম উদ্দিন (৪৫) ওই বাসের কন্ডাক্টর ও চালকের সহকারী বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি বাসে এক তরুণী তাঁর পোশাক নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদ করছেন। বাসে ওঠার পর সামনের আসনে বসা ওই ব্যক্তি তাঁর পোশাক নিয়ে অশোভন মন্তব্য করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তরুণী প্রতিবাদ জানাতে সামনে এগিয়ে যান এবং প্রশ্ন করেন, ‘আমার পোশাক নিয়ে আপনার সমস্যা কী?’ পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে ওই ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে তরুণীকে চড় মারেন। মুহূর্তেই তরুণী জুতা খুলে পাল্টা আঘাত করেন। ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে দুজনই বাসের সামনের দিকে পড়ে যান। তরুণী নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও প্রতিরোধ করেন।

ঘটনার ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই তরুণীর সাহসী অবস্থানের প্রশংসা করেছেন, অন্যদিকে কেউ কেউ ঘটনাটিতে উভয় পক্ষের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

নাজিম উদ্দিনকে আটক করার সঙ্গে যুক্ত র‍্যাব-৪–এর মেজর আবরার ফয়সাল সাদী প্রথম আলোকে বলেন, তরুণীকে কটূক্তি ও হেনস্তা করার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর হেনস্তকারী ব্যক্তিকে আটক করতে র‍্যাব-৪–এর একটি দল অভিযান শুরু করে। গতকাল সন্ধ্যায় নাজিম উদ্দিনকে শনাক্ত করে আটক করা হয়। পরে তাঁকে মোহাম্মদপুর থানায় সোপর্দ করা হয়।

যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী রফিক প্রথম আলোকে বলেন, হেনস্তার শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে আজ শুক্রবার সকালে নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ওই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। নাজিম উদ্দিন ধানমন্ডি ১৫ থকে মোহাম্মদপুরের বছিলায় চলাচলরত রমজান পরিবহনের কন্ডাক্টর। ভাড়া নিয়ে কথা–কাটাকাটির জের ধরে তাঁদের দুজনের মধ্যে মারামারি হয়। ছাত্রীটি মোহাম্মদপুরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।

আজ সন্ধ্যায় পাঠানো র‍্যাব-৪–এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রমজান পরিবহনের একটি বাস ধানমন্ডি ১৫ থেকে মোহাম্মদপুরের বছিলায় যাচ্ছিল। বাসটি বছিলার মেট্রো হাউজিংয়ের সামনে পৌঁছালে চালকের সহকারী মো. নিজাম উদ্দিন বাসটির যাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীর দিকে তাকিয়ে তাঁর পোশাক নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। এতে ওই তরুণী প্রতিবাদ করায় নাজিম উদ্দিন তাঁর সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন এবং তাঁকে চড় মারেন। একপর্যায়ে তরুণীও আত্মরক্ষার্থে নিজের পায়ের জুতা খুলে অভিযুক্ত নাজিম উদ্দিনকে আঘাত করেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কেউ কটুক্তি করলে কী করবেন?
  • বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ‌্যে ‘ভুয়া-ভুয়া’ স্লোগান পছন্দ হয়নি স‌্যামির
  • মোহাম্মদপুরে বাসে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীকে হেনস্তার ভিডিও ভাইরাল, হেনস্তাকারী গ্রেপ্তার