গণভোটে ঐকমত্য, তবে সেটা কখন তা নিয়ে বিএনপি–জামায়াতের মতভিন্নতা
Published: 5th, October 2025 GMT
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সম্মতি নিতে গণভোট করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। রোববার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে একমত হয়।
তবে যেসব সংস্কার প্রস্তাবে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে, সেগুলোর কী হবে; গণভোট কি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে হবে, নাকি তার আগে হবে; গণভোটের আগে জুলাই সনদ নিয়ে সংবিধান আদেশ জারি করা হবে কি না, এসব বিষয়ে এখনো রাজনৈতিক মতভিন্নতা রয়ে গেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, আগামী বুধবার দুপুরে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। কমিশন আশা করে, সেদিন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
রোববারের আলোচনায় বিএনপি বলেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে কি না, এই প্রশ্নে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট হতে পারে। গণভোটে এটি পাস হলে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবে। তবে যারা জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হবে, তারা তাদের নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমত অনুসারে সনদ বাস্তবায়ন করবে। গণভোটের জন্য সংবিধান আদেশ জারি বা সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার প্রয়োজন হবে না।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও তাদের সম্মতির জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে।অধ্যাপক আলী রীয়াজ সহসভাপতি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনঅন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বলেছে, যেহেতু সব বিষয়ে সবাই একমত হতে পারছেন না, তাই গণভোট হতে পারে। তবে তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চায়। কোনো কোনো দলের ভিন্নমত ‘বাইন্ডিং’ (মানার বাধ্যবাধকতা) নয় বলে মনে করে দলটি।
আর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট হতে পারে। তবে তার আগে অবশ্যই জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে একটি সংবিধান আদেশ জারি করতে হবে।
৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর খসড়া চূড়ান্ত হলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। এ কারণে আটকে আছে জুলাই সনদ।
বাস্তবায়নের উপায় ঠিক করতে এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে কমিশন। রোববার ছিল দলগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে চতুর্থ দিনের আলোচনা।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ২৮টি দলের সঙ্গে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আলোচনা শুরু হয়। এক ঘণ্টার মধ্যাহ্নবিরতি দিয়ে আলোচনা চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপআলোচনা শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও তাঁদের সম্মতির জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে।
এটি একটি বড় অর্জন। এটি সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, তাঁরা অত্যন্ত আশাবাদী অন্য বিষয়গুলোতেও দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারবেন। আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে আইনসভা তৈরি হবে, সেই আইনসভা যেন মৌলিক সাংবিধানিক সংস্কারগুলো করতে পারে এবং তাকে টেকসই করতে পারে; সে জন্য এই আইনসভাকে এমনভাবে চিহ্নিত করা দরকার বা আলাদা বৈশিষ্ট্য দেওয়া দরকার। যাতে জুলাই সনদের ভিত্তিতে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্ধন, পরিমার্জনগুলো টেকসই হয়। এ ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যত একটি ঐকমত্য হয়েছে।
দলগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমি মনে করি যে তাদের এই প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আমরা খুব শিগগির সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুপারিশ তৈরি করে সরকারের কাছে দিতে পারব।’
এদিন দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার আগে কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, প্রধান উপদেষ্টাকে সামগ্রিক অগ্রগতি অবহিত করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা তাগিদ দিয়েছেন, যেন দ্রুততার সঙ্গে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সুপারিশ সরকারকে দেওয়া হয়। তাঁরা বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর যে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে কমিশন আশা করছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সেই জায়গাটায় পৌঁছানো যাবে।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমরা সুস্পষ্টভাবে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি যে ১৫ অক্টোবরের পর কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হচ্ছে না।’
দলগুলো যা বলেছেরোববার ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, যদি জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করা হয়, তাহলে সংবিধান আদেশ বা সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। কারণ জনগণ হচ্ছে সুপ্রিম।
সংবিধান আদেশ জারি করার এখতিয়ার এই সরকারের নেই। সেটা থাকলে তারা আলোচনা ছাড়াই সংবিধান সংশোধন করতে পারত। তিনি বলেন, গণভোটের জন্য শুধু জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনকে গণভোট আয়োজনের ক্ষমতা দেওয়া যায়।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যাতে ম্যান্ডেটের অভাব না হয়, জনগণ এটা সমর্থন করে কি না, সে অনুমতির জন্য গণভোট হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন আলাদা একটা ব্যালটে জনগণের মত নেওয়া যায়। তাতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা বাধ্যতামূলক হবে এবং সার্বভৌম ক্ষমতার একটা রায় সেখানে প্রতিফলিত হবে। তখন বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে আর কেউ সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হলে আরেকটি সুবিধা হবে, জাতীয় নির্বাচনের মতো আরেকটি বিশাল নির্বাচন করতে হবে না।
গণভোটের প্রশ্ন কী হবে, সে প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে জনগণ ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলবে। তিনি আশা করেন, জনগণ ‘হ্যাঁ’ বলবে।
এর আগে আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, যেহেতু সবাই সব বিষয়ে একমত হতে পারছেন না, তাই এগুলো গণভোটে দেওয়া যায়। জনগণ যে রায় দেবে, সেটা তাঁরা মানবেন। তিনি বলেন, সংবিধান আদেশের মাধ্যমে গণভোট করা হলে সেটা শক্তিশালী হবে। গণভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে আরও আলোচনা হতে পারে।
হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, গণভোটের বিষয়ে একধরনের ঐকমত্য হয়েছে। এটা করা গেলে ভালো। আরপিও সংশোধন নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদের প্রস্তাবের সঙ্গে তিনি একমত। জামায়াতের এই নেতা বলেন, সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সনদের ভেতরই থাকবে। জুলাই সনদ জনগণ অনুমোদন করে কি না, এটা নিয়ে হবে গণভোট। এটা হলে জুলাই সনদের শক্তিশালী আইনি ভিত্তি হবে। আগে গণভোট হয়ে যাক।
দুপুরে মধ্যাহ্নবিরতিতে সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হামিদুর রহমান আযাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জনগণ গণভোটে অভ্যস্ত না। আমরা মনে করি, এটা জাতীয় নির্বাচনকে কোনো ধরনের সমস্যা করা ছাড়াই নভেম্বর অথবা ডিসেম্বর করতে পারে। তফসিলের আগেও করতে পারে। গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো ধরনের বাধা নাই। জনগণকে একটা জটিল অবস্থায় ফেলে না দিয়ে, মহাপরীক্ষায় না ফেলে সহজভাবে এগোলে আমরাও বাঁচি, জাতিও বাঁচে।’
আলোচনায় এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, গণভোটের আগে অবশ্যই জুলাই সনদকে একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের (এলএফও) মধ্যে আনতে হবে। সুনির্দিষ্ট করা লাগবে কত দিনের মধ্যে কী হবে। আগামী নির্বাচন অন্যান্য জাতীয় নির্বাচনের মতো হবে না। এটা হবে আলাদা। তাদের মৌলিক কাজ হবে মৌলিক পরিবর্তন আনা। প্রথমে সংবিধান আদেশ বা এলএফও—যে নামেই হোক ঘোষণা দিতে হবে। সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিরা দ্বৈত ভূমিকা পালন করবেন। সংবিধান সংস্কার তাঁদের এখতিয়ার থাকবে।
ভিন্নমতের কী হবেজুলাই জাতীয় সনদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপিসহ কিছু দলের ভিন্নমত আছে। এগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, তা এখনো সুস্পষ্ট নয়।
রোববারের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি আইনজীবী শিশির মনির বলেন, সোজাসাপ্টা পথ হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করা। সেখানে ভিন্নমতের বিষয়টি আসতে পারে। ভিন্নমত ‘বাইন্ডিং’ (মানার বাধ্যবাধকতা) নয়।
শিশির মনির তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানে চারজন বিচাপতির সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল। তিনজন পক্ষে ছিলেন। তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ অনুমোদনের জন্য গণভোট হতে পারে।
এই বক্তব্যের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ আলোচনায় বলেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রত্যেক বিচারকের মতামত দেওয়ার সমান অধিকার আছে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় দলের সংখ্যার ভিত্তিতে কোনো রায় হবে না। এটা হচ্ছে রাজনৈতিক চুক্তি (পলিটিক্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট)। এটার সঙ্গে আদালতের রায়ের তুলনা করা ঠিক হবে না।
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আরেকটা বিষয় এসেছে, নোট অব ডিসেন্টের ক্ষেত্রে মেজরিটির মতামতের ভিত্তিতে নোট অব ডিসেন্টটাকে আমরা ওভাররুলড (বাতিল) করতে পারি কি না? না। এটা হচ্ছে একটা পলিটিক্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট। যারা ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হবে, তারা তাদের নোট অব ডিসেন্ট অনুসারে যাবে। সেটা অঙ্গীকারনামায় সংযুক্ত করার জন্য আমি মাননীয় সভাপতিকে অনুরোধ করেছিলাম। হয়তোবা সেটা অঙ্গীকারনামায় আসতে পারে। তো সে জন্য নোট অব ডিসেন্ট মেজরিটির ভিত্তিতে কখনো ওভাররুলড করা যাবে না।’
ঐকমত্য না হলে একাধিক প্রস্তাব
সকালে আলোচনার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হলে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে একাধিক পদ্ধতি সুপারিশ করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
আলোচনায় কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ল হউদ দ ন আহমদ ন ট অব ড স ন ট র য় জ বল ন র প রস ত ব প রক র য় ভ ন নমত র সদস য র মত মত গণভ ট ক গণভ ট র জনগণ র দ বল ন র বব র র জন য ন র জন সনদ র সরক র ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে একমত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং গণভোটের বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে চতুর্থ দিনের আলোচনা শেষে তিনি বলেন, জনগণের অংশগ্রহণের জন্য গণভোট অনুষ্ঠান একটি বড় পদক্ষেপ।