স্পিরুলিনা - Spirulina (Arthrospira platensis)—
এক ধরনের নীল-সবুজ শৈবাল (cyanobacteria) যা প্রাকৃতিকভাবে লবণাক্ত ও মিঠা পানিতে পাওয়া যায়। এটি এক ধরনের সুপারফুড, কারণ এতে শরীরের জন্য দরকারি অনেক পুষ্টি একসাথে থাকে। এতে আছে-
১. প্রোটিন ও অ্যামিনো অ্যাসিড (Protein & Amino Acids):
প্রোটিন (Protein), অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড (Essential Amino Acids), যেমন- লিউসিন (Leucine), লাইসিন (Lysine), মিথিওনিন (Methionine), ট্রিপ্টোফ্যান (Tryptophan) ইত্যাদি,
২.
৩. চর্বি / লিপিড (Fats / Lipids): মোট চর্বি (Total Fat), গামা-লিনোলেনিক অ্যাসিড (Gamma-Linolenic Acid; GLA), লিনোলিক অ্যাসিড (Linoleic Acid),
৪. ভিটামিনস (Vitamins): ভিটামিন A (Beta-Carotene), ভিটামিন B1 (Thiamine), ভিটামিন B2 (Riboflavin), ভিটামিন B3 (Niacin), ভিটামিন B5 (Pantothenic Acid), ভিটামিন B6 (Pyridoxine), ভিটামিন B7 (Biotin), ভিটামিন B9 (Folic Acid), ভিটামিন B12 (Cobalamin), ভিটামিন C (Ascorbic Acid), ভিটামিন D (Vitamin D), ভিটামিন E (Tocopherol), ভিটামিন K (Vitamin K),
৫. মিনারেলস / খনিজ (Minerals): আয়রন (Iron), ক্যালসিয়াম (Calcium), ম্যাগনেসিয়াম (Magnesium), পটাশিয়াম (Potassium), সোডিয়াম (Sodium), জিঙ্ক (Zinc), সেলেনিয়াম (Selenium), কপার (Copper), ফসফরাস (Phosphorus), ম্যাঙ্গানিজ (Manganese),
৬. পিগমেন্ট ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Pigments & Antioxidants): ক্লোরোফিল (Chlorophyll), ফাইকোসায়ানিন (Phycocyanin), ক্যারোটিনয়েড (Carotenoids), যেমন- জিয়াক্সান্থিন (Zeaxanthin), ইকিনিনন (Echinenone), ক্যানথাক্সানথিন (Canthaxanthin), পলিফেনল (Polyphenols), ফেনলিক যৌগ (Phenolic Compounds),
৭. অন্যান্য (Others): অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইম (Antioxidant Enzymes), অন্যান্য বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ (Other Bioactive Compounds).
---------------
স্পিরুলিনার প্রধান প্রধান পুষ্টিগুণ ও উপাদানসমূহের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:
১. উচ্চ প্রোটিন (Protein): শুকনো স্পিরুলিনা এর প্রায় ৬০–৭০% প্রোটিন। যা শরীরের কোষ গঠন ও মেরামতে সাহায্য করে। এটি নিরামিষভোজীদের জন্য একটা চমৎকার প্রোটিনের উৎস হতে পারে।
এতে থাকে অনেকগুলো অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড (essential amino acids), যা শরীর নিজে তৈরি করতে পারে না।
২. ভিটামিনসমূহ (Vitamins):
ভিটামিন B1 (থায়ামিন)– শক্তি উৎপাদনে সহায়ক; এটি খাবারকে শক্তিতে রুপান্তরিত করে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
ভিটামিন B2 (রিবোফ্লাভিন)– দেহের শক্তি উৎপাদন, কোষ সুরক্ষা ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এটি খাবার থেকে কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট ও প্রোটিনকে শক্তিতে রূপান্তর করে শরীরে শক্তি বৃদ্ধি করে, চোখ ও ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা করে; চোখকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। চোখের রোগ, যেমন- ছানি (cataracts) ও ম্যাকুলার ডিজেনারেশন প্রতিরোধে সহায়তা করে, ত্বকের কোষ পুনর্গঠনে সহায়তা করে। কোষের গঠন ঠিক রেখে দ্রুত ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) বৃদ্ধি করে, কিডনীর অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিতে কিছু হরমোন উৎপাদনে সহায়তা করে, শারীরিক ও মানসিক কর্মক্ষমতা বাড়াতে ও নার্ভের স্বাভাবিক কাজকর্ম বজায় রাখতে সাহায্য করে। শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেল থেকে রক্ষা করে। চুল পড়া ও ত্বকের ফাটা কমায়। প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও মাইগ্রেন-ব্যথার তীব্রতা কমাতে সহায়তা করে।
ভিটামিন B3 (নিয়াসিন)– রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক; খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে। ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়াতে সহায়তা করে ও হৃদপিন্ডকে সুরক্ষা দেয়। হৃপিন্ড, রক্তনালী ও বিপাকক্রিয়ার (metabolism) সঠিক কার্যকারিতায় সহায়তা করে; হৃপিন্ডের স্বাস্থ্য বজায় রাখে, রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা রক্ষা করে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে; হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। চর্বি, প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেটের বিপাকক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, শরীরের খাবার থেকে শক্তি তৈরিতে সহায়তা করে। ত্বক পরিষ্কার ও উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে ও ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুড়ি প্রতিরোধে সহায়তা করে। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে; মনোযোগ বৃদ্ধি করে, স্মৃতিশক্তি ও স্নায়ুর কার্যক্ষমতা বজায় রাখে। হজমশক্তি উন্নত করে; হজমজনিত সমস্যা, যেমন- বদহজম বা ডায়ারিয়া রোধে সাহায্য করে। নায়াসিনের ঘাটতিজনিত মারাত্মক রোগ পেলাগ্রা প্রতিরোধে সহায়ক।
ভিটামিন B6 (পাইরিডক্সিন হাইড্রোক্লোরাইড)– স্নায়ু ও রক্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ও মনের অবস্থার উন্নতি সেরোটোনিন ও ডোপামিন তৈরিতে সাহায্য করে, যা মুড ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মেলাটোনিন উৎপাদনে সহায়তা করে, যা ঘুমে সাহায্য করে। ডিপ্রেশন ও ইনসমনিয়া (ঘুমের সমস্যা) কমাতে সহায়ক হতে পারে। নার্ভের স্বাভাবিক কাজ বজায় রাখতে সহায়তা করে। স্নায়বিক রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) বৃদ্ধি, অ্যান্টিবডি তৈরিতে সহায়তা করে, যা ভাইরাস ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে। হোমোসিস্টেইন নামক অ্যামিনো অ্যাসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। লাল রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে, যা শরীরের কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। গর্ভকালীন অসুস্থতা; বমি ও বমিভাব কমাতে সহায়ক। পিএমএস (premenstrual syndrome) এর উপসর্গ, যেমন-মেজাজ খারাপ, মাথাব্যথা, ক্লান্তি ইত্যাদি উপশমে সাহায্য করে। বিপাকক্রিয়া (Metabolism) উন্নত করে ১০০টিরও বেশি এনজাইম প্রতিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। শরীরে চর্বি, প্রোটিন ও শর্করার বিপাকে সাহায্য করে। চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে, বয়সজনিত চোখের রোগ (macular degeneration) এর ঝুঁকি কমাতে পারে।
ভিটামিন B12 (সায়ানোকোরালামিন)– স্নায়ু ও রক্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খাবারকে শক্তিতে রূপান্তর করে শক্তি উৎপাদন ও বাড়াতে সহায়তা করে; দুর্বলতা ও ক্লান্তি কমাতে সাহায্য করে। সুস্থ লাল রক্তকণিকা তৈরিতে সহায়তা করে, যা দেহে অক্সিজেন পরিবহণে সাহায্য করে। মেগালোব্লাস্টিক অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সহায়ক। স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য উন্নত করে; স্মৃতি, মনোযোগ এবং বোধশক্তি উন্নত করে। স্নায়ুর ক্ষতি ও ঝিমঝিম ভাব প্রতিরোধে সহায়ক। হাড়ের স্বাস্থ্য; হাড়ের ঘনত্ব (bone density) রক্ষা করে, অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে সহায়ক। মুড নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক স্বাস্থ্য; মস্তিষ্কে সেরোটোনিন উৎপাদনে সাহায্য করে, বিষণ্ণতা (depression) হ্রাস করে। ত্বক, চুল ও নখের জন্য উপকারী; কোষের গঠন ও মেরামতে সহায়তা করে, সুস্থ ও উজ্জ্বল ত্বক, মজবুত চুল ও নখ গঠনে সহায়ক। ভ্রূণের সঠিক বৃদ্ধি ও জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ; গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্ক ও নার্ভ সিস্টেম বিকাশে ও জন্মগত ত্রুটি (birth defects) প্রতিরোধে সহায়তা করে।
ভিটামিন A (বেটা-ক্যারোটিন আকারে)–
আগে জেনে নিই বেটা-ক্যারোটিন কী? বেটা-ক্যারোটিন হল একটি প্রোভিটামিন যা দেহে গিয়ে ভিটামিন এ -তে রূপান্তরিত হয় । এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। এটি চোখের স্বাস্থ্য উন্নত করে; চোখের রাত্রিকালীন দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে, চোখের শুষ্কতা ও অন্ধত্ব প্রতিরোধে সহায়ক, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন ও ছানি পড়া প্রতিরোধে সহায়তা করে। ত্বকের কোষ পুনর্গঠনে সহায়তা করে; ব্রণ, শুষ্কতা ও ত্বকের অকাল বার্ধক্য প্রতিরোধে সহায়তা করে; ত্বককে মসৃণ, উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান রাখে। ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) বৃদ্ধি; সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করে, শরীরকে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। কোষের বৃদ্ধি ও মেরামতে সাহায্য করে, শরীরের টিস্যু ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক গঠন ও বৃদ্ধিতে সহায়ক। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের সঠিক বৃদ্ধিতে ও মায়ের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে।
ভিটামিন E (D-alpha-tocopherol)– শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কোষ রক্ষা করে; কোষের গঠন ঠিক রাখে এবং কোষের ক্ষয় প্রতিরোধ করে, ত্বককে রক্ষা করে ক্ষতিকর রোদ ও ফ্রি র্যাডিক্যালস (ক্ষতিকর অণু) থেকে। ত্বকের প্রদাহ,শুষ্কতা ও বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে। চুল পড়া ও মাথার ত্বকের রুক্ষতা কমাতে সহায়তা করে। চোখের কোষগুলোকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে। বয়সজনিত চোখের রোগ, যেমন- ম্যাকুলার ডিজেনারেশন ধীর (slow) করে দিতে পারে। ফ্যাটি লিভার রোগে ভিটামিন ই সাপ্লিমেন্ট লিভারের এনজাইম কমাতে সহায়তা করতে পারে। এটি বার্ধক্য, ক্যান্সার, এবং হৃদরোগের মতো অসুখ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। হৃদরোগে বিশেষ করে যারা nitrates (যেমন- glyceryl trinitrate) সেবন করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই ওষুধের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। আলঝেইমারস্ রোগ (Alzheimer’s Disease); মস্তিষ্কের কোষকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাসের গতি কমাতে সাহায্য করতে পারে। শুক্রাণুর গুণমান ও গতিশীলতা বাড়াতে সহায়তা করে। মাসিক শুরুর আগে যেসব নারীরা ক্লান্তি, মুড সুইং বা ব্যথায় ভোগেন, তাদের জন্য ভিটামিন ই উপকারী হতে পারে। মাসিকের সময় অতিরিক্ত ব্যথা কমাতে পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে (immune system) শক্তিশালী করতে সহায়তা করে, বিশেষ করে বয়ষ্কদের।
৩. খনিজ উপাদান (Minerals):
স্পিরুলিনা মিনারেলে ভরপুর, যেমন-
লোহা (Iron): রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়ক। রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন করে রক্তস্বল্পতা দূর করে।
ক্যালসিয়াম (Calcium): হাড় ও দাঁতের জন্য অপরিহার্য। হাড় ও দাঁতকে মজবুত করে। বয়স্কদের অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধে সহায়তা করে। নিয়মিত হৃদস্পন্দন বজায় রাখতে ও পেশি সংকোচন নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। স্নায়ুর কার্যক্রমে সহায়তা করে। রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
ম্যাগনেশিয়াম (Magnesium): স্নায়ু ও পেশির স্বাভাবিক কাজের জন্য দরকারি; হাত-পায়ে টান ধরা বা খিঁচুনি হ্রাসে সহায়তা করে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে। এটি ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করে। এটি হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে, অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধে কার্যকর। এটি শরীরের শক্তি তৈরিতে সহায়তা করে শরীরের ক্লান্তি ও দুর্বলতা কমাতে সাহায্য করে। ঘুমের মান উন্নত করে ও ঘুমের সমস্যা কমাতে পারে; গভীর ও শান্ত ঘুমে সহায়তা করে। ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি অনেক সময় উদ্বেগ, বিষণ্ণতা বা মাথাব্যথা তৈরি করতে পারে। এটি GABA (Gamma-Aminobutyric Acid) নামক নিউরোট্রান্সমিটারকে সক্রিয় করে, যা মনকে শান্ত করে।
পটাশিয়াম (Potassium): রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি পেশির সংকোচন ও বিশ্রাম নিয়ন্ত্রণ করে। এটির ঘাটতি হলে পেশিতে টান ধরা, দুর্বলতা বা খিঁচুনি হতে পারে। পটাশিয়াম স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্ক ও শরীরের অন্যান্য অংশে নিউরোসিগনাল পাঠাতে সাহায্য করে। হৃদযন্ত্র ঠিকভাবে কাজ করতে এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বজায় রাখতে সহায়তা করে। পটাশিয়ামের ঘাটতি হলে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হতে পারে। পটাশিয়াম কোষের ভিতরের ও বাইরের জলীয় উপাদান নিয়ন্ত্রণ করে, যা ডিহাইড্রেশন বা ফোলাভাব প্রতিরোধে সাহায্য করে।
জিঙ্ক (Zinc): রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও ত্বকের জন্য জরুরি। ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে জিঙ্ক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য প্যাথোজেন থেকে শরীরকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। ঠান্ডা লাগা, সর্দি-কাশি কমাতে জিঙ্ক সহায়তা করে। জীবাণু নিরোধ, কোষ পুনর্গঠন ও ক্ষত সারাতে সহায়তা করে। এটি টেস্টোস্টেরন হরমোন উৎপাদনে ভূমিকা রাখে এবং শুক্রাণুর গুণমান উন্নত করে। জিঙ্ক জিভের স্বাদগ্রাহী কোষ ঠিক রাখে। এটির ঘাটতিতে রুচি কমে যেতে পারে। বয়সজনিত রোগ (যেমন- বয়সজনিত দৃষ্টি হ্রাস, সংক্রমণ) প্রতিরোধে সাহায্য করে।
সেলেনিয়াম (Selenium): শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, শরীরের কোষগুলোকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস (ফ্রি র্যাডিকেল এর ক্ষতি) থেকে রক্ষা করে। এটি বয়সজনিত রোগ, ক্যান্সার ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে, থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন তৈরিতে ও নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে। ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে সহায়তা করে। শরীরের কোষে DNA -এর ক্ষতি প্রতিরোধে সাহায্য করে- যার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ায়; শুক্রাণুর গুণগত মান ও গতিশীলতা উন্নত করে।
৪. অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস্ (Antioxidants):
স্পিরুলিনায় থাকে বেশ কিছু কার্যকর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যেমন-
ফাইকোসায়ানিন (Phycocyanin): আগে জেনে নিই ফাইকোসায়ানিন কী? এটি হল একটি প্রাকৃতিক নীল রঙের প্রোটিন যা সায়ানোব্যাকটেরিয়াতে (যেমন- স্পিরুলিনা) পাওয়া যায়। এটি একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি যৌগ হিসেবেও কাজ করে। স্পিরুলিনায় থাকা “ফাইকোসায়ানিন” নামক পিগমেন্ট এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ফ্রি র্যাডিক্যাল কমিয়ে বার্ধক্য রোধে সহায়তা করে ও কোষ-ক্ষয় কমাতে সহায়তা করে; অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্ষমতা ফ্রি র্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে কোষকে সুরক্ষা দেয়। ক্যান্সার, বার্ধক্যজনিত রোগ ও কোষ ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়ক। শরীরের প্রদাহ (inflammation) কমাতে সাহায্য করে। নিউরনের ক্ষয় রোধ করতে সহায়তা করে। আলঝেইমারস্ রোগ ও পার্কিসনস্ রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। যকৃতের উপর টক্সিনের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে সহায়তা করে। ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে প্রাকৃতিক কিলার সেল ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধকারী কোষকে সক্রিয় করে। সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়ক।
বেটা-ক্যারোটিন (Beta-Carotene): আগে জেনে নিই বেটা-ক্যারোটিন কী? বেটা-ক্যারোটিন হলো একটি প্রাকৃতিক পিগমেন্ট (রঞ্জক), যা অনেক ফল ও সবজিকে কমলা, হলুদ বা লালচে রঙ দেয়। এটি একটি প্রোভিটামিন A অর্থাৎ, শরীরে প্রবেশ করার পর এটি ভিটামিন A-তে রূপান্তরিত হয়। এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করে। এটির উপকারিতা ভিটামিন এ-তে করা হয়েছে।
টোকোফেরল (Vitamin E): আগে জেনে নিই টোকোফেরল কী? টোকোফেরল (Tocopherol) হলো ভিটামিন ই -এর একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক রূপ। এর সবচেয়ে কার্যকর রূপ হলো D-alpha-tocopherol; এটির উপকারিতা উপরের অংশে ভিটামিন ই –তে আলোচনা করা হয়েছে।
এই উপাদানগুলো একসাথে কাজ করে বয়সের ছাপ কমাতে, রোগ প্রতিরোধে ও কোষের ক্ষয় রোধে সাহায্য করে।
৫. প্রাকৃতিক পিগমেন্ট ও ফ্যাটি অ্যাসিড:
গামা-লিনোলেনিক অ্যাসিড (GLA - Gamma-Linolenic Acid): এটি হলো একটি ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা শরীরে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি (প্রদাহনাশক) হিসেবে কাজ করে। এটি সাধারণত গুড ফ্যাট (ভালো চর্বি) হিসেবে বিবেচিত হয়। GLA শরীরে প্রস্টাগ্ল্যান্ডিন (Prostaglandin E1) তৈরি করে, যা প্রদাহ কমায়। আর্থ্রাইটিস (গাঁটে ব্যথা), ত্বকের প্রদাহ, নার্ভ ব্যথা ইত্যাদিতে উপকারী। নারীদের হরমোন ভারসাম্য রক্ষা করে; পিরিয়ডের আগে ব্যথা, মেজাজ খারাপ, বুকে টান এসব উপশমে GLA সহায়ক। মেনোপোজের সময়েও হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী; ত্বককে মসৃণ ও নমনীয় করে। একজিমা (Eczema), সোরিয়াসিস(Psoriasis) বা শুষ্ক ত্বকের সমস্যা কমায়, চুল পড়া কমাতে ও মাথার ত্বকের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করতে সহায়তা করে। স্নায়ু ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা রক্ষা করে, GLA স্নায়ুর ঝিল্লির গঠন বজায় রাখতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিসজনিত নার্ভ সমস্যাতে উপকারী। হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, রক্তচাপ, হরমোন ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ক্লোরোফিল (Chlorophyll): রক্ত বিশুদ্ধ করতে ও ডিটক্সিফিকেশনে সাহায্য করে, ক্লোরোফিল শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান (toxins) অপসারণে সাহায্য করে। এটি লিভার ও রক্তের কাজকে সহায়তা করে; ফলে রক্ত বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ হয়। ক্লোরোফিল হেভি-মেটাল, রাসায়নিক বর্জ্য ও ফ্রি র্যাডিক্যালস শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে। নিয়মিত গ্রহণে লিভার, কিডনি ও অন্ত্র পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করে। কোষকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে; ত্বক, যকৃত ও অন্ত্রের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। মুখের দুর্গন্ধ ও শরীরের ঘামের গন্ধ কমাতে সহায়তা করতে পারে, তাই কিছু মাউথওয়াশ বা ডিওডোরান্টে ক্লোরোফিল থাকে। ওজন নিয়ন্ত্রণে ও হজমে সহায়তা করে, ক্ষুধা কমায়; ফলে ওজন কমানোর ডায়েটে ক্লোরোফিল যুক্ত খাবার উপকারী।
## পুষ্টিমান (প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনো স্পিরুলিনায় আছে):
উপাদান পরিমাণ (প্রায়)
ক্যালরি (Calories) 290 kcal
প্রোটিন (Protein) 57–65 g
ফ্যাট (Fat) 6–8 g
কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrates) 23–25 g
আয়রন (Iron) 28–58 mg (খুব উচ্চ)
ক্যালসিয়াম (Calcium) 120 mg
ম্যাগনেশিয়াম (Magnesium) 190–195 mg
পটাশিয়াম (Potassium) 1360 mg
ভিটামিন B12 (Vitamin B12) 0.02–0.04 µg (তবে এটি মূলত "pseudovitamin B12", যা মানুষের জন্য কম কার্যকর)
বেটা-ক্যারোটিন(Beta-Carotene) 3,000–3,400 µg (microgram)
# ( তবে ভিটামিন B12 মূলত "pseudovitamin B12", যা মানুষের জন্য কম কার্যকর)
(উৎস: USDA FoodData Central, WHO, FAO, PubMed রিভিউ এবং অন্যান্য রিভিউ পেপার অনুযায়ী) এবং Spirulina এখনো গবেষণাধীন।
মনে রাখার জন্য সংক্ষেপে স্পিরুলিনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (Importance & Need):
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি : ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। সাদা রক্তকণিকা ও অ্যান্টিবডি উৎপাদন বাড়ায়, প্রদাহের প্রতিক্রিয়া কমাতে সাহায্য করে।
হৃদরোগ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ: LDL (খারাপ কোলেস্টেরল), ট্রাইগ্লিসারাইড কমায়, HDL (ভাল কোলেস্টেরল) বাড়াতে পারে। রক্তচাপ কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে।
ওজন ও শর্করার নিয়ন্ত্রণ: ইন্সুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ায়, রক্তে শর্করার ওঠানামা কম হতে পারে। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ওজন কমার অভিমুখে কাজ করতে সহায়তা করে।
রক্তে আয়রনের ঘাটতি পূরণে সহায়ক: অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।
ত্বক, চুল ও নখের উন্নতি ঘটায়: প্রাকৃতিক ভিটামিন ও মিনারেলসের কারণে।
ডিটক্সিফাই করে: শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান বের করতে সাহায্য করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে: ক্ষুধা কিছুটা কমিয়ে দেয়, ফলে খাদ্যগ্রহণ কম হয়।
অসুবিধা ও সতর্কতা (Side effects / Precautions):
যদিও স্পিরুলিনা সাধারণত নিরাপদ, তবে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা দরকার;
অ্যালার্জি ও পেটের সমস্যা : অতিরিক্ত সেবন করলে অ্যালার্জি সমস্যা ও র্যাশ, হজমে সমস্যা, বমিভাব, গ্যাস বা পেট ব্যথা হতে পারে।
গর্ভাবস্থা বা স্তন্যদানকারী মা: ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া না নেওয়াই ভালো। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনক্রমেই খাওয়া যাবে না।
অটোইমিউন রোগে আক্রান্তরা: যেসব রোগে ইমিউন সিস্টেম বেশি সক্রিয় থাকে (যেমন- লুপাস, ম্যানগ্রিক রোগ ইত্যাদি), সেসব ক্ষেত্রে স্পিরুলিনা গ্রহণ করলে ইমিউন সিস্টেমকে অতিরিক্ত উত্তেজনা ও সক্রিয় করতে পারে, যার ফলে সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।
নকল বা নিম্নমানের স্পিরুলিনা: ভারী ধাতু (heavy metal) থাকতে পারে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
নিয়মিত ব্যবহার করার ক্ষেত্রে গুণগত মান (purity) এবং উৎস (source) গুরুত্বপূর্ণ। ত্রুটিপূর্ণ বা দূষিত পণ্য হলে শরীরের জন্য বিপদ হতে পারে।
পরামর্শ (Tips):
বর্তমানে বাজারে ক্যাপসুল ও ট্যাবলেট আকারে পাওয়া যায়।
ডোজ: দিনে ১ - ২ বার, প্রতি বার ১ - ২টি ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল (চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী)।
খালি পেটে নয়, খাবারের পরে খাওয়া ভালো।
প্রচুর পানি পান করা (প্রয়োজন মত)।
অন্য কোনো ওষুধ খেলে বা রোগ থাকলে , আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নিবেন।
সারমর্ম:
স্পিরুলিনা একটি প্রাকৃতিক, পুষ্টিতে ভরপুর সাপ্লিমেন্ট যা অনেক ক্ষেত্রে কাজ করছে; শক্তি বাড়ানো, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নয়ন, হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো, চর্বি ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিতে। তবে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে, ভালো উৎস থেকে পেতে হবে, ডোজ ঠিক রাখতে হবে, এবং যদি কোনো রোগ বা শরীর কোন বিশেষ অবস্থায় থাকে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরী।
----------------------------------
ডা. গাজী খায়রুজ্জামান
(হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কলামিস্ট )
0174 38 34 816
[email protected]
উৎস: Narayanganj Times
কীওয়ার্ড: ন র য়ণগঞ জ স ব স থ য রক ষ স হ য য কর হ দর গ র ও ত বক র অন য ন য প গম ন ট র প ন তর স ক রমণ র সমস য ক র যকর ও রক ত সহ য ক ক জ কর র জন য সহ য ত উপ দ ন ক য লস হরম ন উপক র গ রহণ র গঠন গঠন ও
এছাড়াও পড়ুন:
স্পিরুলিনার যতগুণ
স্পিরুলিনা - Spirulina (Arthrospira platensis)—
এক ধরনের নীল-সবুজ শৈবাল (cyanobacteria) যা প্রাকৃতিকভাবে লবণাক্ত ও মিঠা পানিতে পাওয়া যায়। এটি এক ধরনের সুপারফুড, কারণ এতে শরীরের জন্য দরকারি অনেক পুষ্টি একসাথে থাকে। এতে আছে-
১. প্রোটিন ও অ্যামিনো অ্যাসিড (Protein & Amino Acids):
প্রোটিন (Protein), অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড (Essential Amino Acids), যেমন- লিউসিন (Leucine), লাইসিন (Lysine), মিথিওনিন (Methionine), ট্রিপ্টোফ্যান (Tryptophan) ইত্যাদি,
২. কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrates): শর্করা (Sugars), ফাইবার (Fiber),
৩. চর্বি / লিপিড (Fats / Lipids): মোট চর্বি (Total Fat), গামা-লিনোলেনিক অ্যাসিড (Gamma-Linolenic Acid; GLA), লিনোলিক অ্যাসিড (Linoleic Acid),
৪. ভিটামিনস (Vitamins): ভিটামিন A (Beta-Carotene), ভিটামিন B1 (Thiamine), ভিটামিন B2 (Riboflavin), ভিটামিন B3 (Niacin), ভিটামিন B5 (Pantothenic Acid), ভিটামিন B6 (Pyridoxine), ভিটামিন B7 (Biotin), ভিটামিন B9 (Folic Acid), ভিটামিন B12 (Cobalamin), ভিটামিন C (Ascorbic Acid), ভিটামিন D (Vitamin D), ভিটামিন E (Tocopherol), ভিটামিন K (Vitamin K),
৫. মিনারেলস / খনিজ (Minerals): আয়রন (Iron), ক্যালসিয়াম (Calcium), ম্যাগনেসিয়াম (Magnesium), পটাশিয়াম (Potassium), সোডিয়াম (Sodium), জিঙ্ক (Zinc), সেলেনিয়াম (Selenium), কপার (Copper), ফসফরাস (Phosphorus), ম্যাঙ্গানিজ (Manganese),
৬. পিগমেন্ট ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Pigments & Antioxidants): ক্লোরোফিল (Chlorophyll), ফাইকোসায়ানিন (Phycocyanin), ক্যারোটিনয়েড (Carotenoids), যেমন- জিয়াক্সান্থিন (Zeaxanthin), ইকিনিনন (Echinenone), ক্যানথাক্সানথিন (Canthaxanthin), পলিফেনল (Polyphenols), ফেনলিক যৌগ (Phenolic Compounds),
৭. অন্যান্য (Others): অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইম (Antioxidant Enzymes), অন্যান্য বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ (Other Bioactive Compounds).
---------------
স্পিরুলিনার প্রধান প্রধান পুষ্টিগুণ ও উপাদানসমূহের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:
১. উচ্চ প্রোটিন (Protein): শুকনো স্পিরুলিনা এর প্রায় ৬০–৭০% প্রোটিন। যা শরীরের কোষ গঠন ও মেরামতে সাহায্য করে। এটি নিরামিষভোজীদের জন্য একটা চমৎকার প্রোটিনের উৎস হতে পারে।
এতে থাকে অনেকগুলো অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড (essential amino acids), যা শরীর নিজে তৈরি করতে পারে না।
২. ভিটামিনসমূহ (Vitamins):
ভিটামিন B1 (থায়ামিন)– শক্তি উৎপাদনে সহায়ক; এটি খাবারকে শক্তিতে রুপান্তরিত করে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
ভিটামিন B2 (রিবোফ্লাভিন)– দেহের শক্তি উৎপাদন, কোষ সুরক্ষা ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এটি খাবার থেকে কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট ও প্রোটিনকে শক্তিতে রূপান্তর করে শরীরে শক্তি বৃদ্ধি করে, চোখ ও ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা করে; চোখকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। চোখের রোগ, যেমন- ছানি (cataracts) ও ম্যাকুলার ডিজেনারেশন প্রতিরোধে সহায়তা করে, ত্বকের কোষ পুনর্গঠনে সহায়তা করে। কোষের গঠন ঠিক রেখে দ্রুত ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) বৃদ্ধি করে, কিডনীর অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিতে কিছু হরমোন উৎপাদনে সহায়তা করে, শারীরিক ও মানসিক কর্মক্ষমতা বাড়াতে ও নার্ভের স্বাভাবিক কাজকর্ম বজায় রাখতে সাহায্য করে। শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেল থেকে রক্ষা করে। চুল পড়া ও ত্বকের ফাটা কমায়। প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও মাইগ্রেন-ব্যথার তীব্রতা কমাতে সহায়তা করে।
ভিটামিন B3 (নিয়াসিন)– রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক; খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে। ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়াতে সহায়তা করে ও হৃদপিন্ডকে সুরক্ষা দেয়। হৃপিন্ড, রক্তনালী ও বিপাকক্রিয়ার (metabolism) সঠিক কার্যকারিতায় সহায়তা করে; হৃপিন্ডের স্বাস্থ্য বজায় রাখে, রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা রক্ষা করে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে; হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। চর্বি, প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেটের বিপাকক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, শরীরের খাবার থেকে শক্তি তৈরিতে সহায়তা করে। ত্বক পরিষ্কার ও উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে ও ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুড়ি প্রতিরোধে সহায়তা করে। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে; মনোযোগ বৃদ্ধি করে, স্মৃতিশক্তি ও স্নায়ুর কার্যক্ষমতা বজায় রাখে। হজমশক্তি উন্নত করে; হজমজনিত সমস্যা, যেমন- বদহজম বা ডায়ারিয়া রোধে সাহায্য করে। নায়াসিনের ঘাটতিজনিত মারাত্মক রোগ পেলাগ্রা প্রতিরোধে সহায়ক।
ভিটামিন B6 (পাইরিডক্সিন হাইড্রোক্লোরাইড)– স্নায়ু ও রক্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ও মনের অবস্থার উন্নতি সেরোটোনিন ও ডোপামিন তৈরিতে সাহায্য করে, যা মুড ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মেলাটোনিন উৎপাদনে সহায়তা করে, যা ঘুমে সাহায্য করে। ডিপ্রেশন ও ইনসমনিয়া (ঘুমের সমস্যা) কমাতে সহায়ক হতে পারে। নার্ভের স্বাভাবিক কাজ বজায় রাখতে সহায়তা করে। স্নায়বিক রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) বৃদ্ধি, অ্যান্টিবডি তৈরিতে সহায়তা করে, যা ভাইরাস ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে। হোমোসিস্টেইন নামক অ্যামিনো অ্যাসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। লাল রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে, যা শরীরের কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। গর্ভকালীন অসুস্থতা; বমি ও বমিভাব কমাতে সহায়ক। পিএমএস (premenstrual syndrome) এর উপসর্গ, যেমন-মেজাজ খারাপ, মাথাব্যথা, ক্লান্তি ইত্যাদি উপশমে সাহায্য করে। বিপাকক্রিয়া (Metabolism) উন্নত করে ১০০টিরও বেশি এনজাইম প্রতিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। শরীরে চর্বি, প্রোটিন ও শর্করার বিপাকে সাহায্য করে। চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে, বয়সজনিত চোখের রোগ (macular degeneration) এর ঝুঁকি কমাতে পারে।
ভিটামিন B12 (সায়ানোকোরালামিন)– স্নায়ু ও রক্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খাবারকে শক্তিতে রূপান্তর করে শক্তি উৎপাদন ও বাড়াতে সহায়তা করে; দুর্বলতা ও ক্লান্তি কমাতে সাহায্য করে। সুস্থ লাল রক্তকণিকা তৈরিতে সহায়তা করে, যা দেহে অক্সিজেন পরিবহণে সাহায্য করে। মেগালোব্লাস্টিক অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সহায়ক। স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য উন্নত করে; স্মৃতি, মনোযোগ এবং বোধশক্তি উন্নত করে। স্নায়ুর ক্ষতি ও ঝিমঝিম ভাব প্রতিরোধে সহায়ক। হাড়ের স্বাস্থ্য; হাড়ের ঘনত্ব (bone density) রক্ষা করে, অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে সহায়ক। মুড নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক স্বাস্থ্য; মস্তিষ্কে সেরোটোনিন উৎপাদনে সাহায্য করে, বিষণ্ণতা (depression) হ্রাস করে। ত্বক, চুল ও নখের জন্য উপকারী; কোষের গঠন ও মেরামতে সহায়তা করে, সুস্থ ও উজ্জ্বল ত্বক, মজবুত চুল ও নখ গঠনে সহায়ক। ভ্রূণের সঠিক বৃদ্ধি ও জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ; গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্ক ও নার্ভ সিস্টেম বিকাশে ও জন্মগত ত্রুটি (birth defects) প্রতিরোধে সহায়তা করে।
ভিটামিন A (বেটা-ক্যারোটিন আকারে)–
আগে জেনে নিই বেটা-ক্যারোটিন কী? বেটা-ক্যারোটিন হল একটি প্রোভিটামিন যা দেহে গিয়ে ভিটামিন এ -তে রূপান্তরিত হয় । এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। এটি চোখের স্বাস্থ্য উন্নত করে; চোখের রাত্রিকালীন দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে, চোখের শুষ্কতা ও অন্ধত্ব প্রতিরোধে সহায়ক, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন ও ছানি পড়া প্রতিরোধে সহায়তা করে। ত্বকের কোষ পুনর্গঠনে সহায়তা করে; ব্রণ, শুষ্কতা ও ত্বকের অকাল বার্ধক্য প্রতিরোধে সহায়তা করে; ত্বককে মসৃণ, উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান রাখে। ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) বৃদ্ধি; সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করে, শরীরকে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। কোষের বৃদ্ধি ও মেরামতে সাহায্য করে, শরীরের টিস্যু ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক গঠন ও বৃদ্ধিতে সহায়ক। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের সঠিক বৃদ্ধিতে ও মায়ের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে।
ভিটামিন E (D-alpha-tocopherol)– শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কোষ রক্ষা করে; কোষের গঠন ঠিক রাখে এবং কোষের ক্ষয় প্রতিরোধ করে, ত্বককে রক্ষা করে ক্ষতিকর রোদ ও ফ্রি র্যাডিক্যালস (ক্ষতিকর অণু) থেকে। ত্বকের প্রদাহ,শুষ্কতা ও বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে। চুল পড়া ও মাথার ত্বকের রুক্ষতা কমাতে সহায়তা করে। চোখের কোষগুলোকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে। বয়সজনিত চোখের রোগ, যেমন- ম্যাকুলার ডিজেনারেশন ধীর (slow) করে দিতে পারে। ফ্যাটি লিভার রোগে ভিটামিন ই সাপ্লিমেন্ট লিভারের এনজাইম কমাতে সহায়তা করতে পারে। এটি বার্ধক্য, ক্যান্সার, এবং হৃদরোগের মতো অসুখ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। হৃদরোগে বিশেষ করে যারা nitrates (যেমন- glyceryl trinitrate) সেবন করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই ওষুধের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। আলঝেইমারস্ রোগ (Alzheimer’s Disease); মস্তিষ্কের কোষকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাসের গতি কমাতে সাহায্য করতে পারে। শুক্রাণুর গুণমান ও গতিশীলতা বাড়াতে সহায়তা করে। মাসিক শুরুর আগে যেসব নারীরা ক্লান্তি, মুড সুইং বা ব্যথায় ভোগেন, তাদের জন্য ভিটামিন ই উপকারী হতে পারে। মাসিকের সময় অতিরিক্ত ব্যথা কমাতে পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে (immune system) শক্তিশালী করতে সহায়তা করে, বিশেষ করে বয়ষ্কদের।
৩. খনিজ উপাদান (Minerals):
স্পিরুলিনা মিনারেলে ভরপুর, যেমন-
লোহা (Iron): রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়ক। রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন করে রক্তস্বল্পতা দূর করে।
ক্যালসিয়াম (Calcium): হাড় ও দাঁতের জন্য অপরিহার্য। হাড় ও দাঁতকে মজবুত করে। বয়স্কদের অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধে সহায়তা করে। নিয়মিত হৃদস্পন্দন বজায় রাখতে ও পেশি সংকোচন নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। স্নায়ুর কার্যক্রমে সহায়তা করে। রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
ম্যাগনেশিয়াম (Magnesium): স্নায়ু ও পেশির স্বাভাবিক কাজের জন্য দরকারি; হাত-পায়ে টান ধরা বা খিঁচুনি হ্রাসে সহায়তা করে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে। এটি ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করে। এটি হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে, অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধে কার্যকর। এটি শরীরের শক্তি তৈরিতে সহায়তা করে শরীরের ক্লান্তি ও দুর্বলতা কমাতে সাহায্য করে। ঘুমের মান উন্নত করে ও ঘুমের সমস্যা কমাতে পারে; গভীর ও শান্ত ঘুমে সহায়তা করে। ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি অনেক সময় উদ্বেগ, বিষণ্ণতা বা মাথাব্যথা তৈরি করতে পারে। এটি GABA (Gamma-Aminobutyric Acid) নামক নিউরোট্রান্সমিটারকে সক্রিয় করে, যা মনকে শান্ত করে।
পটাশিয়াম (Potassium): রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি পেশির সংকোচন ও বিশ্রাম নিয়ন্ত্রণ করে। এটির ঘাটতি হলে পেশিতে টান ধরা, দুর্বলতা বা খিঁচুনি হতে পারে। পটাশিয়াম স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্ক ও শরীরের অন্যান্য অংশে নিউরোসিগনাল পাঠাতে সাহায্য করে। হৃদযন্ত্র ঠিকভাবে কাজ করতে এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বজায় রাখতে সহায়তা করে। পটাশিয়ামের ঘাটতি হলে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হতে পারে। পটাশিয়াম কোষের ভিতরের ও বাইরের জলীয় উপাদান নিয়ন্ত্রণ করে, যা ডিহাইড্রেশন বা ফোলাভাব প্রতিরোধে সাহায্য করে।
জিঙ্ক (Zinc): রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও ত্বকের জন্য জরুরি। ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে জিঙ্ক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য প্যাথোজেন থেকে শরীরকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। ঠান্ডা লাগা, সর্দি-কাশি কমাতে জিঙ্ক সহায়তা করে। জীবাণু নিরোধ, কোষ পুনর্গঠন ও ক্ষত সারাতে সহায়তা করে। এটি টেস্টোস্টেরন হরমোন উৎপাদনে ভূমিকা রাখে এবং শুক্রাণুর গুণমান উন্নত করে। জিঙ্ক জিভের স্বাদগ্রাহী কোষ ঠিক রাখে। এটির ঘাটতিতে রুচি কমে যেতে পারে। বয়সজনিত রোগ (যেমন- বয়সজনিত দৃষ্টি হ্রাস, সংক্রমণ) প্রতিরোধে সাহায্য করে।
সেলেনিয়াম (Selenium): শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, শরীরের কোষগুলোকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস (ফ্রি র্যাডিকেল এর ক্ষতি) থেকে রক্ষা করে। এটি বয়সজনিত রোগ, ক্যান্সার ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে, থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন তৈরিতে ও নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে। ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে সহায়তা করে। শরীরের কোষে DNA -এর ক্ষতি প্রতিরোধে সাহায্য করে- যার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ায়; শুক্রাণুর গুণগত মান ও গতিশীলতা উন্নত করে।
৪. অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস্ (Antioxidants):
স্পিরুলিনায় থাকে বেশ কিছু কার্যকর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যেমন-
ফাইকোসায়ানিন (Phycocyanin): আগে জেনে নিই ফাইকোসায়ানিন কী? এটি হল একটি প্রাকৃতিক নীল রঙের প্রোটিন যা সায়ানোব্যাকটেরিয়াতে (যেমন- স্পিরুলিনা) পাওয়া যায়। এটি একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি যৌগ হিসেবেও কাজ করে। স্পিরুলিনায় থাকা “ফাইকোসায়ানিন” নামক পিগমেন্ট এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ফ্রি র্যাডিক্যাল কমিয়ে বার্ধক্য রোধে সহায়তা করে ও কোষ-ক্ষয় কমাতে সহায়তা করে; অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্ষমতা ফ্রি র্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে কোষকে সুরক্ষা দেয়। ক্যান্সার, বার্ধক্যজনিত রোগ ও কোষ ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়ক। শরীরের প্রদাহ (inflammation) কমাতে সাহায্য করে। নিউরনের ক্ষয় রোধ করতে সহায়তা করে। আলঝেইমারস্ রোগ ও পার্কিসনস্ রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। যকৃতের উপর টক্সিনের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে সহায়তা করে। ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে প্রাকৃতিক কিলার সেল ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধকারী কোষকে সক্রিয় করে। সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়ক।
বেটা-ক্যারোটিন (Beta-Carotene): আগে জেনে নিই বেটা-ক্যারোটিন কী? বেটা-ক্যারোটিন হলো একটি প্রাকৃতিক পিগমেন্ট (রঞ্জক), যা অনেক ফল ও সবজিকে কমলা, হলুদ বা লালচে রঙ দেয়। এটি একটি প্রোভিটামিন A অর্থাৎ, শরীরে প্রবেশ করার পর এটি ভিটামিন A-তে রূপান্তরিত হয়। এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করে। এটির উপকারিতা ভিটামিন এ-তে করা হয়েছে।
টোকোফেরল (Vitamin E): আগে জেনে নিই টোকোফেরল কী? টোকোফেরল (Tocopherol) হলো ভিটামিন ই -এর একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক রূপ। এর সবচেয়ে কার্যকর রূপ হলো D-alpha-tocopherol; এটির উপকারিতা উপরের অংশে ভিটামিন ই –তে আলোচনা করা হয়েছে।
এই উপাদানগুলো একসাথে কাজ করে বয়সের ছাপ কমাতে, রোগ প্রতিরোধে ও কোষের ক্ষয় রোধে সাহায্য করে।
৫. প্রাকৃতিক পিগমেন্ট ও ফ্যাটি অ্যাসিড:
গামা-লিনোলেনিক অ্যাসিড (GLA - Gamma-Linolenic Acid): এটি হলো একটি ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা শরীরে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি (প্রদাহনাশক) হিসেবে কাজ করে। এটি সাধারণত গুড ফ্যাট (ভালো চর্বি) হিসেবে বিবেচিত হয়। GLA শরীরে প্রস্টাগ্ল্যান্ডিন (Prostaglandin E1) তৈরি করে, যা প্রদাহ কমায়। আর্থ্রাইটিস (গাঁটে ব্যথা), ত্বকের প্রদাহ, নার্ভ ব্যথা ইত্যাদিতে উপকারী। নারীদের হরমোন ভারসাম্য রক্ষা করে; পিরিয়ডের আগে ব্যথা, মেজাজ খারাপ, বুকে টান এসব উপশমে GLA সহায়ক। মেনোপোজের সময়েও হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী; ত্বককে মসৃণ ও নমনীয় করে। একজিমা (Eczema), সোরিয়াসিস(Psoriasis) বা শুষ্ক ত্বকের সমস্যা কমায়, চুল পড়া কমাতে ও মাথার ত্বকের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করতে সহায়তা করে। স্নায়ু ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা রক্ষা করে, GLA স্নায়ুর ঝিল্লির গঠন বজায় রাখতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিসজনিত নার্ভ সমস্যাতে উপকারী। হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, রক্তচাপ, হরমোন ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ক্লোরোফিল (Chlorophyll): রক্ত বিশুদ্ধ করতে ও ডিটক্সিফিকেশনে সাহায্য করে, ক্লোরোফিল শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান (toxins) অপসারণে সাহায্য করে। এটি লিভার ও রক্তের কাজকে সহায়তা করে; ফলে রক্ত বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ হয়। ক্লোরোফিল হেভি-মেটাল, রাসায়নিক বর্জ্য ও ফ্রি র্যাডিক্যালস শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে। নিয়মিত গ্রহণে লিভার, কিডনি ও অন্ত্র পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করে। কোষকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে; ত্বক, যকৃত ও অন্ত্রের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। মুখের দুর্গন্ধ ও শরীরের ঘামের গন্ধ কমাতে সহায়তা করতে পারে, তাই কিছু মাউথওয়াশ বা ডিওডোরান্টে ক্লোরোফিল থাকে। ওজন নিয়ন্ত্রণে ও হজমে সহায়তা করে, ক্ষুধা কমায়; ফলে ওজন কমানোর ডায়েটে ক্লোরোফিল যুক্ত খাবার উপকারী।
## পুষ্টিমান (প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনো স্পিরুলিনায় আছে):
উপাদান পরিমাণ (প্রায়)
ক্যালরি (Calories) 290 kcal
প্রোটিন (Protein) 57–65 g
ফ্যাট (Fat) 6–8 g
কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrates) 23–25 g
আয়রন (Iron) 28–58 mg (খুব উচ্চ)
ক্যালসিয়াম (Calcium) 120 mg
ম্যাগনেশিয়াম (Magnesium) 190–195 mg
পটাশিয়াম (Potassium) 1360 mg
ভিটামিন B12 (Vitamin B12) 0.02–0.04 µg (তবে এটি মূলত "pseudovitamin B12", যা মানুষের জন্য কম কার্যকর)
বেটা-ক্যারোটিন(Beta-Carotene) 3,000–3,400 µg (microgram)
# ( তবে ভিটামিন B12 মূলত "pseudovitamin B12", যা মানুষের জন্য কম কার্যকর)
(উৎস: USDA FoodData Central, WHO, FAO, PubMed রিভিউ এবং অন্যান্য রিভিউ পেপার অনুযায়ী) এবং Spirulina এখনো গবেষণাধীন।
মনে রাখার জন্য সংক্ষেপে স্পিরুলিনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (Importance & Need):
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি : ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। সাদা রক্তকণিকা ও অ্যান্টিবডি উৎপাদন বাড়ায়, প্রদাহের প্রতিক্রিয়া কমাতে সাহায্য করে।
হৃদরোগ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ: LDL (খারাপ কোলেস্টেরল), ট্রাইগ্লিসারাইড কমায়, HDL (ভাল কোলেস্টেরল) বাড়াতে পারে। রক্তচাপ কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে।
ওজন ও শর্করার নিয়ন্ত্রণ: ইন্সুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ায়, রক্তে শর্করার ওঠানামা কম হতে পারে। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ওজন কমার অভিমুখে কাজ করতে সহায়তা করে।
রক্তে আয়রনের ঘাটতি পূরণে সহায়ক: অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।
ত্বক, চুল ও নখের উন্নতি ঘটায়: প্রাকৃতিক ভিটামিন ও মিনারেলসের কারণে।
ডিটক্সিফাই করে: শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান বের করতে সাহায্য করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে: ক্ষুধা কিছুটা কমিয়ে দেয়, ফলে খাদ্যগ্রহণ কম হয়।
অসুবিধা ও সতর্কতা (Side effects / Precautions):
যদিও স্পিরুলিনা সাধারণত নিরাপদ, তবে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা দরকার;
অ্যালার্জি ও পেটের সমস্যা : অতিরিক্ত সেবন করলে অ্যালার্জি সমস্যা ও র্যাশ, হজমে সমস্যা, বমিভাব, গ্যাস বা পেট ব্যথা হতে পারে।
গর্ভাবস্থা বা স্তন্যদানকারী মা: ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া না নেওয়াই ভালো। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনক্রমেই খাওয়া যাবে না।
অটোইমিউন রোগে আক্রান্তরা: যেসব রোগে ইমিউন সিস্টেম বেশি সক্রিয় থাকে (যেমন- লুপাস, ম্যানগ্রিক রোগ ইত্যাদি), সেসব ক্ষেত্রে স্পিরুলিনা গ্রহণ করলে ইমিউন সিস্টেমকে অতিরিক্ত উত্তেজনা ও সক্রিয় করতে পারে, যার ফলে সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।
নকল বা নিম্নমানের স্পিরুলিনা: ভারী ধাতু (heavy metal) থাকতে পারে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
নিয়মিত ব্যবহার করার ক্ষেত্রে গুণগত মান (purity) এবং উৎস (source) গুরুত্বপূর্ণ। ত্রুটিপূর্ণ বা দূষিত পণ্য হলে শরীরের জন্য বিপদ হতে পারে।
পরামর্শ (Tips):
বর্তমানে বাজারে ক্যাপসুল ও ট্যাবলেট আকারে পাওয়া যায়।
ডোজ: দিনে ১ - ২ বার, প্রতি বার ১ - ২টি ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল (চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী)।
খালি পেটে নয়, খাবারের পরে খাওয়া ভালো।
প্রচুর পানি পান করা (প্রয়োজন মত)।
অন্য কোনো ওষুধ খেলে বা রোগ থাকলে , আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নিবেন।
সারমর্ম:
স্পিরুলিনা একটি প্রাকৃতিক, পুষ্টিতে ভরপুর সাপ্লিমেন্ট যা অনেক ক্ষেত্রে কাজ করছে; শক্তি বাড়ানো, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নয়ন, হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো, চর্বি ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিতে। তবে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে, ভালো উৎস থেকে পেতে হবে, ডোজ ঠিক রাখতে হবে, এবং যদি কোনো রোগ বা শরীর কোন বিশেষ অবস্থায় থাকে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরী।
----------------------------------
ডা. গাজী খায়রুজ্জামান
(হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কলামিস্ট )
0174 38 34 816
[email protected]