অন্তর্বর্তী সরকার ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া অনুমোদন করেছে, এটি নিঃসন্দেহে ডিজিটাল পরিসরের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এই অধ্যাদেশে ব্যক্তির উপাত্তের ওপর অধিকার প্রদান, ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা রক্ষা, সংবেদনশীল তথ্য সুরক্ষা, বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শাস্তির মতো বিধান রাখা হয়েছে। এর সব কটিই নাগরিকের ব্যক্তিগত উপাত্তের অধিকার সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে।

কিন্তু আলোচিত এই অধ্যাদেশের অনুমোদিত খসড়াতেও নির্বাহী বিভাগের অবাধ ক্ষমতা রয়ে গেছে, কিছু বিধিতে অস্পষ্টতা রয়েছে। আমরা মনে করি, এ ধরনের বিধি শেষ পর্যন্ত এই অধ্যাদেশের অপব্যবহার, রাজনৈতিক ব্যবহার ও নাগরিকের ওপর নজরদারির সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। তাতে যে উদ্দেশ্যে অধ্যাদেশটি প্রণীত হয়েছে, সেটাই ব্যাহত হতে পারে।

ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে যাবতীয় কর্মকাণ্ডে ডিজিটাল–নির্ভরতা একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। ফলে বাংলাদেশে এ–সংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। বিগত সরকারের আমলে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের একাধিক খসড়া করা হয়েছিল। কিন্তু একতরফাভাবে প্রণীত খসড়া নিয়ে দেশি-বিদেশি অংশীজনদের আপত্তি ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল।

 খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্বর্তী সরকার যখন উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া তৈরির উদ্যোগে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, সেটা সব মহলেই আশাবাদ তৈরি করেছিল। কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ব‍্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশে দুর্বলতা ও ঝুঁকি রয়েছে এবং অংশীজনের পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়েছে বলে যে অভিযোগ করেছে, তাতে এই অধ্যাদেশ নিয়ে উদ্বেগ রয়েই গেল।

উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল আইন, যেখানে নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা এবং জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার মতো বহুমাত্রিক বিষয় জড়িত, সেখানে কোনো সংশয়, উদ্বেগ ও প্রশ্ন থাকার অবকাশ আছে বলে আমরা মনে করি না। উপাত্ত সুরক্ষা আইন বিশ্বে আমরা প্রথম করছি, এমনটা নয়। ফলে এই আইন প্রণয়নের প্রতিটি ধাপে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা, সততা ও গোপনীয়তা এবং জবাবদিহির নীতি অবশ্যই অনুসরণ করা প্রয়োজন ছিল। সেটা না হওয়ায় নাগরিকের অধিকার হরণ এবং ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক তথ্যের ওপর সরকারি নজরদারির ঝুঁকি বাড়তে পারে।

অনুমোদিত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশের সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে এখানে জাতীয় উপাত্ত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেটা এককথায় অবাধ। এই কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে এবং কর্তৃপক্ষের আদেশ মানতে সবাই বাধ্য থাকবে। এ রকম অসীম ক্ষমতা নিয়ে চলা একটি সংস্থা খুব সহজেই কর্তৃত্ববাদী আচরণ করতে পারে এবং সরকার চাইলেই সেটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে পারে। ফলে ডিজিটাল পরিসরে নাগরিকের অধিকার সুরক্ষার বদলে উল্টো অধ্যাদেশটি নাগরিকের ওপর নজরদারি ও দমনের অস্ত্রও হয়ে উঠতে পারে। উপাত্ত সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বাধীন সংস্থা গঠনই হতে পারে কার্যকর সমাধান।

অধ্যাদেশটি ১৮ মাস পর কার্যকর হওয়ার কথা বলেছে সরকার। কিন্তু উপাত্ত সুরক্ষার সঙ্গে এত জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয় জড়িত যে এটা কার্যকরের ক্ষেত্রে ১৮ মাস যথেষ্ট না–ও হতে পারে। প্রথমে একটি-দুটি খাত দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করে, এরপর ধাপে ধাপে কার্যকর করাটাই বাস্তবসম্মত পথ হবে।

বর্তমান বিশ্বে উপাত্ত সুরক্ষার অধিকার নাগরিকের অন্যতম অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। ফলে এ–সংক্রান্ত আইনে এমন কোনো বিধি রাখা যাবে না, যার অপপ্রয়োগে নাগরিক অধিকার হরণ হতে পারে। ক্ষমতার নয়; বরং নাগরিকের উপাত্তের সুরক্ষা দিতে পারে, এমন আইনই আমাদের প্রয়োজন। উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পরও সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের সঙ্গে এই অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করি। 

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত উপ ত ত স রক ষ র ব যবহ র ক র যকর উদ ব গ অন ম দ ক ষমত র ওপর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাষ্ট্র্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যাপক ছাড়ের পাশাপাশি নজরদারির সুযোগ রয়েছে: টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট

‘ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ ও ‘জাতীয় উপাত্ত ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদনের ক্ষেত্রে সরকার তড়িঘড়ি করেছে। ফলে এগুলোতে কাঠামোগত দুর্বলতা এবং প্রক্রিয়াগত ফাঁক রয়ে গেছে; যা তাদের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে বা অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করতে পারে। অধ্যাদেশ দুটির খসড়ায় রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যাপক ছাড় দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি নজরদারির সুযোগও রাখা হয়েছে।

আজ সোমবার নীতিবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ কথাগুলো বলে।

বিবৃতিতে টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশিদ বলেন, খসড়াগুলো এমন সময়ে অনুমোদিত হয়েছে, যখন নাগরিক সমাজ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞরা আরও বিস্তৃত ও স্বচ্ছ পরামর্শ প্রক্রিয়ার আহ্বান করেছিল। সরকারের এখন উচিত খসড়া দুটির অনুমোদনের প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা এবং সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে প্রমাণভিত্তিক পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেওয়া।

যেসব উদ্বেগ তুলে ধরেছে টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট

খসড়া ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ কোনো বিশেষ শর্ত ছাড়াই দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত সব বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি ডেটা পরিচালকদের জন্য প্রযোজ্য। এটি আইনি অস্পষ্টতা সৃষ্টি করতে পারে, আন্তর্জাতিকভাবে নানা বিষয়ে অসংগতির ঝুঁকি বাড়াতে পারে এবং বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে বৈশ্বিক অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

আইনগুলো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে জাতীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বার্থের মতো অস্পষ্ট কারণ দেখিয়ে (নিয়মের ক্ষেত্রে) ছাড় দেয়। এতে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থা সীমিত তদারকিতে ব্যক্তিগত তথ্য প্রক্রিয়াজাত করতে পারে, যা নাগরিকের গোপনীয়তা দুর্বল করে। টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের আগের গবেষণায় দেখা গেছে, এমন ধারা আইন প্রয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে প্রস্তাবিত কাঠামোর বাইরে নজরদারি চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়।

সরকার জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব বা ব্যক্তিগত অধিকার ও সুনামের সুরক্ষার মতো বিস্তৃত ও অস্পষ্ট কারণ দেখিয়ে কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা, সুরক্ষা ব্যবস্থা বা যৌক্তিকতা ছাড়াই ব্যক্তিগত তথ্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপক ক্ষমতা ধরে রেখেছে। পাশাপাশি তথ্যের স্থানীয় সংরক্ষণ বা দেশান্তরিত তথ্য আদান-প্রদানে শর্ত আরোপের ক্ষমতাও বজায় রয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় অপব্যবহার, আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রবাহে বাধা এবং ব্যবসায়ের জন্য অতিরিক্ত চাপ তৈরি করতে পারে। এ ছাড়াও এই খসড়া অনুযায়ী যেকোনো তথ্যকে যেকোনো সময় ‘সংবেদনশীল’ ঘোষণা করা যেতে পারে, যা নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকে সীমিত করতে পারে।

প্রস্তাবিত শাস্তি—সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানা অতিরিক্ত এবং দেশে ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে অসংগত। সেই তুলনায় ভারত বা শ্রীলঙ্কায় ফৌজদারি শাস্তির পরিবর্তে প্রশাসনিক জরিমানা প্রাধান্য পায়। অতিরিক্ত শাস্তি উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনাকে বাধা দিতে পারে।

অপরাধে জড়িত না থাকার প্রমাণ দিতে না পারলে খসড়ায় কোম্পানির কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত দায় আরোপের বিধান রয়েছে। করপোরেট অপরাধে ব্যক্তিগত দায় যুক্ত করলে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সামষ্টিক দায় এড়িয়ে শুধু ব্যক্তির ওপর দোষ চাপানোর সুযোগ পেতে পারে।

আরও পড়ুনগোপনীয়তার আশ্রয় ও তড়িঘড়ি করে ব‍্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুমোদন১১ অক্টোবর ২০২৫

আইনগুলো রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ‘জনস্বার্থ’ বা ‘সার্বভৌমত্বের’ মতো বিষয়ে অস্পষ্ট নিয়ম, আদেশ বা নির্দেশ জারি করার ক্ষমতা দেয়। স্পষ্ট সীমা বা পর্যবেক্ষণ না থাকায় অপব্যবহারের ঝুঁকি রয়েছে।

যদিও ব্যক্তি তথ্য লঙ্ঘনের জন্য ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে, খসড়াগুলো এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশিকা দেয় না। ফলে ক্ষতিপূরণ মামলা অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে এবং অপ্রত্যাশিত ফলাফল তৈরি হতে পারে।

অপরাধে জড়িত না থাকার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হলে খসড়ায় কোম্পানির কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত দায় আরোপের বিধান রাখা হয়েছে। করপোরেট অপরাধে ব্যক্তিগত দায় যুক্ত করলে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সামষ্টিক দায় এড়িয়ে শুধু ব্যক্তির ওপর দোষ চাপানোর সুযোগ পেতে পারে।

খসড়া আইনে রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ‘জনস্বার্থ’ বা ‘সার্বভৌমত্বের’ মতো বিষয়ে অস্পষ্ট নিয়ম, আদেশ বা নির্দেশ জারি করার ক্ষমতা দেয়। স্পষ্ট সীমা বা পর্যবেক্ষণ না থাকায় অপব্যবহারের ঝুঁকি রয়েছে। যদিও ব্যক্তি তথ্য লঙ্ঘনের জন্য ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে, খসড়াগুলো এই বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশিকা দেয় না। ফলে মামলা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ ভিন্ন হতে পারে এবং অপ্রত্যাশিত ফলাফল তৈরি হতে পারে।

খসড়া আইনগুলোতে একটি উচ্চাভিলাষী নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর পরিকল্পনা থাকলেও, তা বাস্তবায়নের মতো প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বর্তমানে বাংলাদেশের নেই। প্রস্তাবিত ন্যাশনাল ডেটা গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইন্টার–অপারেবিলিটি অথরিটি নীতিনির্ধারণ, বাস্তবায়ন ও প্রযুক্তিগত কাজ—সবকিছুই একসঙ্গে দেখবে, কিন্তু এসবের মধ্যে সমন্বয় ও দায়িত্ব বণ্টনের স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় প্রস্তাবিত ধারা প্রশংসনীয় হলেও, কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনো অনুপস্থিত।

তথ্য পরিচালনায় যুক্ত সংস্থায় নিয়োগ প্রায় সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ বা স্বচ্ছতা সীমিত। এটি আইনটির স্বাধীনতা ও বৈধতা কমিয়ে দেয়, যা মূলত পুরোনো শাসনব্যবস্থা বা পরিচালনার ধরনকেই অনুসরণ করছে, যেখানে কাজের প্রক্রিয়া ছিল অস্বচ্ছ একই সঙ্গে পর্যাপ্ত জবাবদিহি বা তদারকি ছিল না। ফলে নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোরও স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতায় ঘাটতি তৈরির আশঙ্কা রয়ে যায়।

আরও পড়ুনব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ: কর্তৃপক্ষের অবাধ ক্ষমতায় অপব্যবহারের ঝুঁকি১২ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আড়ি পেতে ও ড্রোনের মাধ্যমে নজরদারি হতো
  • রাষ্ট্র্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যাপক ছাড়ের পাশাপাশি নজরদারির সুযোগ রয়েছে: টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট