জানমালের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন
Published: 16th, November 2025 GMT
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়কে কেন্দ্র করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ অনলাইনে কর্মসূচি দেয়। এই কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ ও যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা অব্যাহত আছে। জননিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা রয়েই গেছে। পুলিশ আশঙ্কা করছে, আগামীকাল (১৭ নভেম্বর) পর্যন্ত এ ধরনের চোরাগোপ্তা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটতে পারে। ফলে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আদৌ সেটা যথেষ্ট কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন ও সংশয় থেকে যাচ্ছে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার রাত ১০টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা, মানিকগঞ্জ, বরগুনা ও গাজীপুরে চারটি বাসে ও আশুলিয়ায় একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন দেওয়া হয়। ঢাকায় পাঁচ জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্প থেকে ৩৫টি ককটেল উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া বাসে আগুন দিয়ে পালানোর সময় স্থানীয় মানুষের ধাওয়ায় নদীতে পড়ে এক তরুণের মৃত্যু হয়।
১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগ সেদিন অনলাইনে লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং ৭ নভেম্বর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছেন্ন কিছু নাশকতার ঘটনা শুরু হয়। শুক্রবার রাত পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ২৯টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহের ফুলপুরে একটি বাসে আগুন দিলে ঘুমিয়ে থাকা এক ব্যক্তি নিহত হন, আহত হন আরও একজন। মানিকগঞ্জে গভীর রাতে বাসে আগুন দিলে একজন গুরুতরভাবে দগ্ধ হন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চোরাগোপ্তা ককটেল বিস্ফোরণ ও ঝটিকা মিছিলও হয়েছে। ব্যাংক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাশকতার ঘটনাও ঘটেছে।
সামগ্রিকভভাবে নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা বাড়ানো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল ও নাশকতাকারীদের ধরতে বিশেষ অভিযানের পরও নাশকতা থামানো যাচ্ছে না। ঢাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করায় নাশকতার ঘটনা কিছুটা কমলেও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। ফলে যেসব জেলায় নাশকতার ঘটনা বেশি ঘটছে, সেসব জায়গায় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে হবে।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ কোনো রাজনৈতিক দলের আইনগতভাবে কর্মসূচি পালনের কোনো সুযোগ নেই। নাশকতা ঠেকাতে সরকারকে অবশ্যই কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সেই দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। গত এক সপ্তাহে প্রায় ১৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে নাশকতা ঠেকানোর নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা–কর্মীদের যেভাবে মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিতে দেখা গেছে, তাতে নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কর্মসূচির নামে সহিংসতা, বাসে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা এবং এসব নাশকতা প্রতিরোধের নামে পাল্টা কর্মসূচি আকছার দেখা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিকদের জিম্মি করে কর্মসূচি পালন করতে অভ্যস্ত। এতে শেষ পর্যন্ত নাগরিকেরাই দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে পড়েন, নাশকতার আগুনে মৃত্যু হয়, সর্বস্ব হারান। এই ধারার সংঘাতময় রাজনীতির অবসান চান নাগরিকেরা। রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখা প্রয়োজন যে নাশকতা ঠেকানো ও নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তারের দায়িত্ব পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
আইসিটিতে শেখ হাসিনার রায় ঘিরে নাগরিকদের মধ্যে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তা প্রশমন করতে হবে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন শকত র ঘটন র জন ত ক রক ষ ক র ব যবস থ ককট ল
এছাড়াও পড়ুন:
স্থিতিশীলতা বিঘ্নের পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়
বাংলাদেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক এবং সেটা বেশ একটা ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে আছে। এ ছাড়া বৃহদাকারে যদি আমরা দৃষ্টি দিই, তাহলে বলতে হবে বাংলাদেশ একটা বেশ কঠিন রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিপ্লবোত্তর পরিবেশে আমাদের যে ধরনের জাতীয় সংহতি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল, রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে সেটা আমরা অর্জন করতে পারিনি। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য একটি মাত্র পথ খোলা আছে। সেটা হলো সঠিক নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এখন আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, রাজনৈতিক ও সমষ্টিগতভাবে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা, যাতে আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারি। এটাই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে আমাদের উত্তরণ এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ।
ভারত থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন রকম উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন এবং বাংলাদেশে তাদের সমর্থক ও কর্মীদের তাঁরা একধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে একটা অরাজকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন। এটাকে সম্পূর্ণভাবে এবং কঠোর হাতে দমন করতে হবে। কোনোভাবে এমন পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, যাতে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়।
যেকোনো দেশে বিপ্লবোত্তর পরিবেশে বা পরিস্থিতিতে জাতীয় স্থিতিশীলতা এবং অস্থিতিশীলতার ভেতরে খুব ক্ষীণ একটা রেখা থাকে। এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা যদি কোনোভাবে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হই, সেখান থেকে আমাদের ফিরে আসা বেশ কঠিন হবে। কাজেই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বাত্মকভাবে নিজেদের কাজে নিয়োজিত থেকে এ ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড, যেটা আওয়ামী লীগ করার চেষ্টা করছে, সেটাকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে।
বর্তমানে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে ধরনের দুর্বলতা লক্ষ করা যাচ্ছে, সেটাও একটা বড় উদ্বেগের কারণ। আমাদের পুলিশ বাহিনী সম্পূর্ণভাবে কাজ করতে পারছে না। গত দেড় বছর সময় অতিক্রান্ত হলেও আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের মাধ্যমে এই বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠন করা যায়নি। এর ফলে তাদের যে কর্মদক্ষতা বা যে কর্মক্ষমতা থাকা দরকার ছিল, তার মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। একই সঙ্গে এ ধরনের পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের যে গোয়েন্দা সক্ষমতা থাকা দরকার ছিল, সেখানেও বড় ধরনের দুর্বলতা এবং ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। কাজেই দুই ক্ষেত্রেই নজর দিয়ে খুব আশু পরিবর্তন এনে আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, যদি আমরা সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু মতভেদ এমন পর্যায়ে কোনোভাবে পৌঁছানো উচিত নয়, যেটা আমাদের রাজনৈতিক এবং জাতীয় স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করতে পারে। আমাদের সামনে বড় ছবিটা কী, সেটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। অর্থাৎ ছোটখাটো কারণে যাতে বড় ছবিটা হারিয়ে না যায়, সেটা লক্ষ রেখে আমাদের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। ছোটখাটো বিভেদের কারণে আমরা যাতে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি না করি, যাতে আমাদের আসল আকাঙ্ক্ষাটা বাস্তবায়ন হওয়ার আগে হারিয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, যেকোনো বিপ্লবোত্তর পরিবেশ যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য একটা নাজুক পরিবেশ। এখানে যদি কোনো ভুল পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে।
মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ