চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে এবার ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন ২৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে ছাত্রী সাড়ে ১১ হাজার। অর্থাৎ মোট ভোটারের প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। এই বিপুল ভোটার ঘিরে এখন প্রার্থীদের সব হিসাব-নিকাশ, কৌশল আর আশাবাদ। এককথায়, ভোটযুদ্ধে ছাত্রীরাই গড়ে দিতে পারেন ব্যবধান।

ক্যাম্পাসে গত ১৯ দিন প্রচার চলছে জোরেশোরে। ঝুপড়ি, শাটল ট্রেন, হল-কটেজ কিংবা অনুষদের সিঁড়ি—সব জায়গাতেই দেখা মিলছে প্রার্থীদের। প্রচারপত্র ও ইশতেহার নিয়ে তাঁরা ঘুরে বেড়িয়েছেন। ভোট চেয়েছেন। গতকাল সোমবার রাত ১২টায় শেষ হয়েছে আনুষ্ঠানিক প্রচার।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী হলের সংখ্যা ৫। সব মিলিয়ে আবাসন রয়েছে ২ হাজার ৫৮২ জনের।

তবে গাদাগাদি করে হলে থাকেন সাড়ে ৩ হাজারের মতো ছাত্রী। বাকি শিক্ষার্থীরা হলে থাকার সুযোগ পান না। তাঁদের থাকতে হয় ক্যাম্পাসের আশপাশের কটেজ, মেসে ও দূরের চট্টগ্রাম শহরে। ফলে ছাত্রীদের বেশির ভাগই ভোট দিতে আসবেন ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে।

প্রার্থীরা ছাত্রীদের উদ্দেশে দিয়েছেন আলাদা প্রতিশ্রুতি। নিরাপদ ক্যাম্পাস, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কার্যকর নীতি, পোশাক ও চলাফেরার স্বাধীনতা, নারী জিমনেসিয়াম, স্বাস্থ্যসেবা ও স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন—এমন নানা প্রতিশ্রুতি ছিল প্রচারণার মূল বিষয়। ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বামপন্থী জোট—সব প্যানেলই নারী ভোটারদের গুরুত্ব বুঝে ইশতেহারে বিশেষ দফা যুক্ত করেছে।

‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ ছাত্রীদের জন্য শাটল ট্রেনে আলাদা বগি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ‘দ্রোহ পর্ষদ’ বলেছে, নারীদের জন্য পৃথক শৌচাগার চালুর ব্যবস্থা করবে। যোগ্য ছাত্রীদের দেওয়া হবে এককালীন বৃত্তি। এ ছাড়া যৌন হয়রানির অভিযোগে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে তারা সেল গঠন করবে। অন্যদিকে ছাত্রদলের প্যানেল দিয়েছে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ ও পোশাকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার। আর ছাত্রশিবিরের ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ বলছে, ক্যাম্পাসে আলাদা নারী জিম ও কমনরুম করবে তারা।

ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ৪০ শতাংশ ভোটারই নারী। এ ভোট ফলাফল নির্ধারণ করে দেবে। নির্বাচিত হলে ছাত্রীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তুলবেন তাঁরা। নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্র নারী চিকিৎসক নিশ্চিত করবেন। এসব কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, শিক্ষার্থীদের কাছে শপথও।

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আগামীকাল বুধবার চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোট গ্রহণ শুরু হবে সকাল ৯টায়। শেষ হবে বিকেল ৪টায়।

ছাত্রীদের প্রত্যাশা: নিরাপত্তা ও সম্মান

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রী বলছেন, তাঁদের কাছে প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তবায়নের সম্ভাবনা। ছাত্রীদের বেশির ভাগ ভোট যে প্যানেলে পড়বে, সে প্যানেলই জিতে যাবে। নৃবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনিন্দিতা চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতের বেলা ক্যাম্পাসে চলাচল করতে তিনি নিরাপদ বোধ করছেন না। কিছুদিন আগেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। একজন ছাত্রীর রাত করে ফেরা নিয়ে ওই সংঘর্ষ হয়েছিল। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে এখনো উদ্বেগ রয়েছে। এবার আমরা এমন প্রার্থী বেছে নেব, যিনি আমাদের সমস্যাগুলো সত্যি বুঝবেন।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাজিয়া জেরিন বলেন, ‘আমরা নিরাপদ ক্যাম্পাস প্রত্যাশা করছি। আমরা চাই কোনো ছাত্রী যেন ক্যাম্পাসে নিপীড়নে শিকার না হন। অসম্মানিত না হোন। প্রার্থীদের যাঁরা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করবেন, এমন প্রার্থীকে ভোট দেব।’

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। তবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ১৩ প্যানেলের বেশির ভাগ ইশতেহারেই নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। প্রার্থীরা বলছেন, তাঁরা চাপ দিয়ে প্রশাসনকে নিরাপত্তা জোরদার করতে বাধ্য করবেন।

ছাত্রীদের চলাফেরা এখন আগের চেয়ে স্বস্তিদায়ক হলেও রাতে অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। অনুষদের সামনে, বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে টহল বাড়ানোর দাবিও রয়েছে তাঁদের।

চাকসু নির্বাচনের ইতিহাসে নারী ভোটারদের এমন প্রভাব আগে ছিল না। কারণ, তখন ছাত্রীসংখ্যা ছিল হাতে গোনা। নব্বইয়ের দশক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ভর্তির সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এর মধ্যে গড়ে ৪০ শতাংশই ছাত্রী। বর্তমানে ৪৮টি বিভাগ ও ৬টি ইনস্টিটিউটে পড়ছেন ১১ হাজার ৬০৪ জন ছাত্রী। ফলে প্রার্থীরা জানেন, ছাত্রীদের মন জয় করাই এবার আসল লড়াই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন নিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ রয়েছে। অনেকেই প্রথমবার ভোট দিচ্ছেন। তাঁদের কাছে চাকসু মানে একধরনের নতুন সম্ভাবনা, যেখানে ক্যাম্পাস রাজনীতি আধিপত্য থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক পথ তৈরি করবে। সমাজতত্ত্ব দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম বলেন, ‘চাকসু নিয়ে এখন ছেলেরা যেমন আগ্রহী, মেয়েরাও ঠিক তেমন। আমরা চাই আমাদের কথা বলার জায়গা হোক।’

নারী প্রার্থী ৪৭, শীর্ষ পদে মাত্র ১

বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, অতীতে চাকসুর পদগুলোয় ছাত্রীর সংখ্যা ও ভোটার খুবই কম ছিল। সর্বশেষ নির্বাচনে (১৯৯০) মোট ভোটার ছিলেন ১০ হাজার ৫২৬। এর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ২ হাজার ২৭৬। এবার কেন্দ্রীয় সংসদে ৪৭ জন নারী প্রার্থী আছেন।

১৩টি প্যানেল নির্বাচনে লড়ছে। অথচ শীর্ষ পদে কেবল একজন প্রার্থী আছেন। প্যানেলগুলো শীর্ষ পদে নারী প্রার্থী না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলছে, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ ও সাংগঠনিক দুর্বলতা। তবে ছাত্রীরা মনে করছেন, মূল সমস্যা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি এবং সব সময় নারীকে পিছিয়ে রাখার প্রবণতা।

যে প্যানেল থেকে একমাত্র নারী প্রার্থী হয়েছেন, তা হলো ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড) ও ছাত্র ফেডারেশন জোট বেঁধে এ প্যানেল দিয়েছে। তাদের প্যানেল থেকে জিএস পদে নির্বাচন করছেন চৌধুরী তাসনীম জাহান শ্রাবণ। তিনি পদার্থবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী।

তাসনীম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ফলে অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই তিনি পরিচিত। এবার প্রচারণা চালাতে গিয়ে তিনি দারুণ সাড়া পেয়েছেন।

অন্যদিকে চাকসুতে এজিএস (সহসাধারণ সম্পাদক) পদে নির্বাচন করছেন দুই ছাত্রী। তাঁরা হলেন আইন বিভাগের ছাবেকুন নাহার (স্বতন্ত্র) ও ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের জান্নাতুল ফেরদৌস। জান্নাতুল নির্বাচন করছেন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেল থেকে।

জান্নাতুল প্রচারণায় বেশ সরব ছিলেন। রেলস্টেশন থেকে ঝুপড়ি—সবখানেই প্রচারপত্র হাতে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। নির্বাচনে জেতার ব্যাপারেও আশাবাদী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রচার চলাকালে তিনি দারুণ সাড়া পেয়েছেন। শীর্ষ পদগুলোয় নারী থাকুক—এটি অনেক শিক্ষার্থী চাইছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র পদ ক য ম প স প রথম আল ক শ র ষ পদ করব ন করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরাকে স্থায়ীভাবে অপসারণ

দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরাকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মাহাফুজ।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোগল চন্দ্র পাল স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (১৯৮৯ সালের ২০ নং আইন) এর ধারা ১২ (১) (গ) অনুযায়ী খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (দায়িত্ব থেকে বিরত) জিরুনা ত্রিপুরাকে তাঁর পদ থেকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করা হলো।’

এর আগে চলতি বছরের ৭ জুলাই বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে সাময়িকভাবে সব ধরনের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখার নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, জেলা পরিষদের ১৪ জন সদস্য জিরুনা ত্রিপুরার বিরুদ্ধে পরিষদের সদস্যদের অবমূল্যায়ন, হস্তান্তরিত বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, শিক্ষক বদলি-বাণিজ্য এবং ঠিকাদারদের বিল আটকে রেখে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেন। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত চালায় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় জিরুনা ত্রিপুরাকে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগের কারণে সমালোচনার মুখে পড়েন।

আরও পড়ুনখাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব পালনে বিরত থাকার নির্দেশ০৭ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ