হংকংয়ের সঙ্গে ফিরতি ম্যাচেও ড্র করে ২০২৭ এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ। বিদায় নিলেও বাংলাদেশ ভালো খেলেছে। বাংলাদেশের জাতীয় দল নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ বেড়েছে। এর বড় কারণ হামজা চৌধুরীসহ আরও বেশ কজন প্রবাসী বাংলাদেশি ফুটবলারের লাল-সবুজ জার্সি গায়ে তোলা।

এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে চারটি ম্যাচেরই বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে উন্নতির ছাপ ছিল। কিন্তু অর্জন বলতে দুটি ড্র থেকে পাওয়া ২ পয়েন্ট। ভারতের বিপক্ষে ভারতে ড্র দিয়ে শুরু করার পর দেশের মাটিতে সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের বিপক্ষে হারতে হয়েছে, হংকংয়ে ফিরতি ম্যাচে পেনাল্টি গোলে পিছিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র।

এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব ও বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এক আড্ডায় আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন জাতীয় দলের সাবেক কোচ মারুফুল হক ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র। এ আলোচনা অনুষ্ঠানের ডিডিও প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুকে গতকাল প্রকাশিত হয়েছে।

আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের বাইরেও ঘরোয়া ফুটবল, এ দেশের ফুটবল-সংস্কৃতি—এমন নানা কিছু এসেছে। আলোচনা হয়েছে বাংলাদেশে কোচ হাভিয়ের কাবরেরাকে নিয়েও। কাবরেরা বাংলাদেশের একমাত্র কোচ, যাঁর সঙ্গে তৃতীয় দফা চুক্তি নবায়ন করেছে বাফুফে। নতুন চুক্তির মেয়াদ আগামী মার্চ পর্যন্ত।

কাবরেরা দায়িত্ব নেওয়ার পর ৪৬ মাসে এখন পর্যন্ত ৩৫ ম্যাচে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ৯টি। উৎপল শুভ্র সূত্রটা ধরিয়ে দিলে মামুনুল বলেন, ‘এই ৪৬ মাসে দেশের ফুটবলে বদল আনার অনেক জায়গা ছিল। যেমন খেলোয়াড় সংগ্রহ, টিম সিলেকশন। কিন্তু তা হয়নি।’

ফুটবলে কোচই সর্বশক্তিমান। তিনি স্কোয়াড তৈরি করবেন, একাদশ ঠিক করবেন। কাবরেরা কি স্বাধীনভাবে সেই কাজটা করতে পারছেন? উৎপল শুভ্রর এই প্রশ্নে মারুফুল বলেন, ‘তাঁর খেলোয়াড় নির্বাচনে সমস্যা আছে মনে করি। না হলে তিনি কোনো একটা জায়গায় একটা ধরা আছেন।’ উৎপল শুভ্র প্রশ্ন ছুড়ে দেন, সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়। এটা কী আসলেই আছে?

মারুফুল এখানেও রাখঢাক করেননি, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার মনে হয় যে এটা রয়েছে।’

ব্যাখাও দেন তিনি, ‘আপনি একটা খেলোয়াড় কীভাবে জাতীয় দলের প্রাথমিক স্কোয়াডে নেবেন—তাঁর লিগের পারফরম্যান্স দেখে তো? আমি তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দেব,  গত মৌসুমে বাংলাদেশে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে সেরা পারফরমার ছিলেন ব্রাদার্স ইউনিয়নের কৌশিক বড়ুয়া। সেরা সেন্ট্রাল ব্যাক আবাহনীর ইয়াছিন খান। সেরা হোল্ডিং মিডফিল্ডার মানিক মোল্লা। তাঁদের কেউ কাবরেরার প্রাথমিক দলেও ঠাঁই পাননি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কোথাও উনি (কাবরেরা) বাধা রয়েছেন অথবা ওনার অভিজ্ঞতা কম।’

সাদ উদ্দিন মূলত রাইট ব্যাক। তাঁকে লেফট ব্যাকে খেলাচ্ছেন কোচ। হংকংয়ের বিপক্ষে ঢাকার ম্যাচে তৃতীয় গোলের রাস্তা তৈরি হয়েছে তাঁর পায়ের ফাঁক দিয়ে। এই উদাহরণ টেনে মামুনুল বলছিলেন, ‘উনি (কাবরেরা) চার বছর ধরে আছেন,  কিন্তু একটা লেফট ব্যাক তৈরি করতে পারেননি। দলে কোনো নাম্বার নাইন নেই। কোচ জীবনকে (নাবিব নেওয়াজ) রাগ করে বাদ দিয়ে দিলেন।’

মারুফুলের সংযোজন, ‘(ঢাকায়) হংকং মাচের স্কোয়াড দেখেই বুঝেছি বাংলাদেশ ৫ গোল দিলে ৬টা খাবে। কারণ, বিকল্প সেন্টার ব্যাক ছিল না। ইয়াছিন বা অন্য কাউকে নিতে পারতেন কোচ।’

কোচ হাভিয়ের কাবরেরার সময়ে বেশ কিছু ম্যাচে বাংলাদেশের খেলা দেখতে ভালো লেগেছে—উৎপল শুভ্রর এই মন্তব্যে মারুফুল চলে যান টেকনিক্যাল বিশ্লেষণে, ‘তাঁর সময়ে আমরা কিছু ম্যাচ গিয়েছি অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য। কিছু তিন পয়েন্টের জন্য বা র‍্যাঙ্কিং পয়েন্ট বাড়ানোর জন্য। কিছু ম্যাচ ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতমূলক। দুর্বল দলের বিপক্ষে তাঁর এক রকম অ্যাপ্রোচ ছিল। কম্পিটিটিভ ম্যাচের জন্য আরেক রকম। কিন্তু আমি কখনো দেখিনি কোনো একটা অ্যাপ্রোচে তাঁর পজিটিভ কিছু ছিল।’

কোচ কারা নিয়োগ দেন, তাঁদের টেকনিক্যাল জ্ঞান কতটুকু, নিয়োগপ্রক্রিয়াই–বা কী—প্রসঙ্গক্রমে এসব প্রশ্নও এসেছে আলোচনায়। বাংলাদেশের ফুটবলের বাস্তবতা, খেলোয়াড়দের মানসিকতা, ফেডারেশনের দায়িত্ব এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা এর অভাবও। দর্শক আগ্রহ, প্রবাসী খেলোয়াড়দের প্রভাব এবং জাতীয় দলের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের পথরেখা নিয়েও কথা হয়েছে।

জাতীয় দল নিয়ে এখন আগ্রহ তৈরি হয়েছে নতুন করে। তবে এমন আগ্রহ মাঝেমধ্যেই ফিরে আসে মনে করেন মারুফুল হক। উদাহরণ দিয়েই তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সময় স্টেডিয়াম আরও বড় ছিল এবং দর্শক উপচে পড়েছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামে এখন গ্যালারির ধারণক্ষমতা ২২-২৩ হাজার। তখন প্রায় ৫০ হাজারের গ্যালারি ভরা ছিল। ২০১০ সালে এসএ গেমসেও দেখেছি। এ রকম বারবার আসে। একটা ঢেউ আসবে, আবার সেটা চলে যাবে।’

কিন্তু এই ঢেউটা দেশের ফুটবল বা ফুটবল উন্নয়নে কতটা কাজে আসে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে মারুফুলের। খেলার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে, কিন্তু সেটা নিতে বাংলাদেশ বারবার ব্যর্থ হয়েছে মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে এসএ গেমস জয়ের পর ১৫ বছর পরে আবার দর্শক খেলা দেখতে আসছে। এটাকে আমরা যদি পুঁজি করতে না পারি, তাহলে বৃহত্তর ফল আসবে না।’

বাংলাদেশের ফুটবলে এই নতুন জোয়ারের বড় কারণ হামজা চৌধুরী। মারুফুল বলেন, হামজা হয়তো আরও সাত–আট বছর খেলতে পারেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। আস্তে আস্তে তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা কমে আসবে। কিন্তু এই উন্মাদনা ধরে রাখতে সামগ্রিকভাবে খেলার উন্নয়নে কাজ শুরু করতে হবে। এই দায়িত্ব যে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের, সেটাও মনে করিয়ে দেন মারুফুল।

যা শুনে উৎপল শুভ্র বলেন, ‘মারুফুল হক যে কথাগুলো বললেন, এগুলো ১৫-২০ বছর ধরেই বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।’ মারুফুল তখনই সামনে আনেন দেশে চার বছর পরপর বিশ্বকাপ উপলক্ষে তৈরি হওয়া ফুটবল উন্মাদনার কথা। তারপর দুঃখ করে বলেন, ‘আজকের ঢেউটা আমাদের ঘরের ভেতরে চলে এসেছে আর আগের বিশ্বকাপের ঢেউগুলো হয়তো আমাদের উঠান পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু আমরা তা ধরে রাখতে পারি না।’

মামুনুল ফুটবল নিয়ে উন্মাদনাকে কাজে লাগাতে না পারার দুঃখের সঙ্গে মনে করিয়ে দেন বাস্তবতাও, ‘ভালো সময়টা আমরা কাজে লাগাতে পারি না। এই যে বলা হয়, এশিয়ান কাপে তিনটা ম্যাচে যদি একটা জিততাম, ফুটবল বদলে যেত।  কিন্তু এক জয়ে কোনো কিছুই হবে না। আমরা চিন্তা করেছিলাম হামজাকে নিয়ে এশিয়া কাপ কোয়ালিফাই করব। আসলে কি আমরা এশিয়া কাপ কোয়ালিফাই করার মতো দল?বিগত এশিয়ান কাপে আমাদের ফল কী? যদি বিগত এশিয়া কাপে আমরা ২ নম্বরে থাকি, এই এশিয়া কাপে আমরা ১ নম্বরে থাকার জন্য চেষ্টা করব। কিন্তু আমরা তো আগে দুইয়ে ছিলাম না। মনে রাখতে হবে আমরা সর্বশেষ কোন জায়গায় ছিলাম।’

এটা কি খেলোয়াড়দের মনেও কাজ করে? উৎপল শুভ্রর প্রশ্নে মামুনুলের উত্তর, ‘আপনি একটা টুর্নামেন্টে যাচ্ছেন, যে টুর্নামেন্টে আপনার সেরা সাফল্য হয়তো চতুর্থ হওয়া। সেখানে প্রথমেই আপনাকে প্রথম হওয়ার ভাবতে পারাটাও বাড়তি প্রেশার।’

সারা পৃথিবীতেই ফুটবল ক্লাবকেন্দ্রিক খেলা। বাংলাদেশে উল্টো। এখানে সব আলোচনা জাতীয় দলকেন্দ্রিক। কারণ, বাংলাদেশে ক্লাব ফুটবল নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। জাতীয় দল নিয়েও আগ্রহটা মূলত হামজা চৌধুরী, শমিত সোম ও ফাহামিদুল ইসলাম এসেছেন বলে। দেশের ফুটবলের মান বেড়েছে কি, বাড়েনি, সেই বিশ্লেষণে না গিয়ে উৎপল শুভ্র বলেন, গণমানুষের মনে অন্তত ফুটবল নিয়ে বড় আগ্রহ তৈরি হয়েছে। মামুনুলকে প্রশ্ন করেন, প্রবাসীদের আসাটাকে তিনি কীভাবে দেখেন?

মামুনুল এটাকে স্বাগতই জানিয়েছেন, ‘এটা সত্য হামজা আর আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। হামজা আসায় যে উন্মাদনাটা হয়েছে, এটি ধরে রাখার দায়িত্ব ফেডারেশনেরই। মারুফ ভাই বললেন, চার বছর পরপর ফুটবলে উন্মাদনা আসে বিশ্বকাপ ঘিরে। ২০১০ সালের এসএ গেমস আমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর অনেক আশাবাদী ছিলাম। আমাদের অনেক সুযোগ–সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। স্বপ্ন বেশি দূর এগোয়নি। স্বপ্ন ওখানেই ভাঙা হয়েছে।’

হামজা এসেছেন, শমিত এসেছেন, আরও ভালো খেলোয়াড় আসবেন। কিন্তু একটি স্কোয়াডের লড়াকু মনোভাব যদি না থাকে বা হামজার মতো খেলোয়াড়কে সমর্থন দেওয়ার মতো স্থানীয় খেলোয়াড় তৈরি না হলে শূন্যতা কিন্তু থেকেই যাবে। এই অভিমত মামুনুলের।

হামজা ও শমিতকে নিয়ে আরেকটু বিস্তারিতও বলেছেন মামুনুল, ‘আমি  মাঠে হামজার কোনো ট্রেনিং সেশন দেখিনি। তবে ভিডিও দেখে বা খেলোয়াড়দের কাছ থেকে শুনেছি, সে অনেক মিশুক। এটা ভালো দিক। প্রথমে স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। হামজা তা পেরেছে। সবার মুখে শুনছি খুব ভালো মানুষ, ভদ্র-বিনয়ী। শমিতের ব্যাপারটা জানি না; কারণ, শমিতের অনেক কিছু দেখিনি। ফাহামিদুলের ভালো-মন্দ সবই শুনেছি।’

কোচের দৃষ্টিকোণ থেকে কী মনে হয়, হামজার জন্য মাঠে বাকিদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কি একটু কঠিন হচ্ছে? উৎপল শুভ্রর এই প্রশ্নের জবাবে মারুফ বলেন, ‘এটা কঠিন হয় না; কারণ, দেখতে হবে তার পজিশনটা কোথায়। হামজা যে পজিশনে খেলে, সেই পজিশনে খুব সহজে সবাই ওর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে। কিন্তু এখন বিষয় হলো শমিত সোম। সে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। যদিও কানাডায় সে ডাবল পিভটের একজন হয়ে খেলে। এখানে একটু অ্যাডজাস্টমেন্টের ব্যাপার রয়েছে।’

বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে মারুফুল হক ও মামুনুল ইসলামের সঙ্গে উৎপল শুভ্রর এই আড্ডার আরও বিস্তারিত জানার ইচ্ছা হলে ভিডিওটা দেখে নিতে পারেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল দ শ র ফ টবল উৎপল শ ভ র ম র ফ ল হক জ ত য় দল র ফ টবল ন য় র জন য র অন ক ক বর র আম দ র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে এই আগ্রহ কি ধরে রাখা যাবে

হংকংয়ের সঙ্গে ফিরতি ম্যাচেও ড্র করে ২০২৭ এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ। বিদায় নিলেও বাংলাদেশ ভালো খেলেছে। বাংলাদেশের জাতীয় দল নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ বেড়েছে। এর বড় কারণ হামজা চৌধুরীসহ আরও বেশ কজন প্রবাসী বাংলাদেশি ফুটবলারের লাল-সবুজ জার্সি গায়ে তোলা।

এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে চারটি ম্যাচেরই বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে উন্নতির ছাপ ছিল। কিন্তু অর্জন বলতে দুটি ড্র থেকে পাওয়া ২ পয়েন্ট। ভারতের বিপক্ষে ভারতে ড্র দিয়ে শুরু করার পর দেশের মাটিতে সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের বিপক্ষে হারতে হয়েছে, হংকংয়ে ফিরতি ম্যাচে পেনাল্টি গোলে পিছিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র।

এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব ও বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এক আড্ডায় আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন জাতীয় দলের সাবেক কোচ মারুফুল হক ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র। এ আলোচনা অনুষ্ঠানের ডিডিও প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুকে গতকাল প্রকাশিত হয়েছে।

আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের বাইরেও ঘরোয়া ফুটবল, এ দেশের ফুটবল-সংস্কৃতি—এমন নানা কিছু এসেছে। আলোচনা হয়েছে বাংলাদেশে কোচ হাভিয়ের কাবরেরাকে নিয়েও। কাবরেরা বাংলাদেশের একমাত্র কোচ, যাঁর সঙ্গে তৃতীয় দফা চুক্তি নবায়ন করেছে বাফুফে। নতুন চুক্তির মেয়াদ আগামী মার্চ পর্যন্ত।

কাবরেরা দায়িত্ব নেওয়ার পর ৪৬ মাসে এখন পর্যন্ত ৩৫ ম্যাচে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ৯টি। উৎপল শুভ্র সূত্রটা ধরিয়ে দিলে মামুনুল বলেন, ‘এই ৪৬ মাসে দেশের ফুটবলে বদল আনার অনেক জায়গা ছিল। যেমন খেলোয়াড় সংগ্রহ, টিম সিলেকশন। কিন্তু তা হয়নি।’

ফুটবলে কোচই সর্বশক্তিমান। তিনি স্কোয়াড তৈরি করবেন, একাদশ ঠিক করবেন। কাবরেরা কি স্বাধীনভাবে সেই কাজটা করতে পারছেন? উৎপল শুভ্রর এই প্রশ্নে মারুফুল বলেন, ‘তাঁর খেলোয়াড় নির্বাচনে সমস্যা আছে মনে করি। না হলে তিনি কোনো একটা জায়গায় একটা ধরা আছেন।’ উৎপল শুভ্র প্রশ্ন ছুড়ে দেন, সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়। এটা কী আসলেই আছে?

মারুফুল এখানেও রাখঢাক করেননি, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার মনে হয় যে এটা রয়েছে।’

ব্যাখাও দেন তিনি, ‘আপনি একটা খেলোয়াড় কীভাবে জাতীয় দলের প্রাথমিক স্কোয়াডে নেবেন—তাঁর লিগের পারফরম্যান্স দেখে তো? আমি তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দেব,  গত মৌসুমে বাংলাদেশে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে সেরা পারফরমার ছিলেন ব্রাদার্স ইউনিয়নের কৌশিক বড়ুয়া। সেরা সেন্ট্রাল ব্যাক আবাহনীর ইয়াছিন খান। সেরা হোল্ডিং মিডফিল্ডার মানিক মোল্লা। তাঁদের কেউ কাবরেরার প্রাথমিক দলেও ঠাঁই পাননি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কোথাও উনি (কাবরেরা) বাধা রয়েছেন অথবা ওনার অভিজ্ঞতা কম।’

সাদ উদ্দিন মূলত রাইট ব্যাক। তাঁকে লেফট ব্যাকে খেলাচ্ছেন কোচ। হংকংয়ের বিপক্ষে ঢাকার ম্যাচে তৃতীয় গোলের রাস্তা তৈরি হয়েছে তাঁর পায়ের ফাঁক দিয়ে। এই উদাহরণ টেনে মামুনুল বলছিলেন, ‘উনি (কাবরেরা) চার বছর ধরে আছেন,  কিন্তু একটা লেফট ব্যাক তৈরি করতে পারেননি। দলে কোনো নাম্বার নাইন নেই। কোচ জীবনকে (নাবিব নেওয়াজ) রাগ করে বাদ দিয়ে দিলেন।’

মারুফুলের সংযোজন, ‘(ঢাকায়) হংকং মাচের স্কোয়াড দেখেই বুঝেছি বাংলাদেশ ৫ গোল দিলে ৬টা খাবে। কারণ, বিকল্প সেন্টার ব্যাক ছিল না। ইয়াছিন বা অন্য কাউকে নিতে পারতেন কোচ।’

কোচ হাভিয়ের কাবরেরার সময়ে বেশ কিছু ম্যাচে বাংলাদেশের খেলা দেখতে ভালো লেগেছে—উৎপল শুভ্রর এই মন্তব্যে মারুফুল চলে যান টেকনিক্যাল বিশ্লেষণে, ‘তাঁর সময়ে আমরা কিছু ম্যাচ গিয়েছি অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য। কিছু তিন পয়েন্টের জন্য বা র‍্যাঙ্কিং পয়েন্ট বাড়ানোর জন্য। কিছু ম্যাচ ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতমূলক। দুর্বল দলের বিপক্ষে তাঁর এক রকম অ্যাপ্রোচ ছিল। কম্পিটিটিভ ম্যাচের জন্য আরেক রকম। কিন্তু আমি কখনো দেখিনি কোনো একটা অ্যাপ্রোচে তাঁর পজিটিভ কিছু ছিল।’

কোচ কারা নিয়োগ দেন, তাঁদের টেকনিক্যাল জ্ঞান কতটুকু, নিয়োগপ্রক্রিয়াই–বা কী—প্রসঙ্গক্রমে এসব প্রশ্নও এসেছে আলোচনায়। বাংলাদেশের ফুটবলের বাস্তবতা, খেলোয়াড়দের মানসিকতা, ফেডারেশনের দায়িত্ব এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা এর অভাবও। দর্শক আগ্রহ, প্রবাসী খেলোয়াড়দের প্রভাব এবং জাতীয় দলের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের পথরেখা নিয়েও কথা হয়েছে।

জাতীয় দল নিয়ে এখন আগ্রহ তৈরি হয়েছে নতুন করে। তবে এমন আগ্রহ মাঝেমধ্যেই ফিরে আসে মনে করেন মারুফুল হক। উদাহরণ দিয়েই তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সময় স্টেডিয়াম আরও বড় ছিল এবং দর্শক উপচে পড়েছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামে এখন গ্যালারির ধারণক্ষমতা ২২-২৩ হাজার। তখন প্রায় ৫০ হাজারের গ্যালারি ভরা ছিল। ২০১০ সালে এসএ গেমসেও দেখেছি। এ রকম বারবার আসে। একটা ঢেউ আসবে, আবার সেটা চলে যাবে।’

কিন্তু এই ঢেউটা দেশের ফুটবল বা ফুটবল উন্নয়নে কতটা কাজে আসে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে মারুফুলের। খেলার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে, কিন্তু সেটা নিতে বাংলাদেশ বারবার ব্যর্থ হয়েছে মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে এসএ গেমস জয়ের পর ১৫ বছর পরে আবার দর্শক খেলা দেখতে আসছে। এটাকে আমরা যদি পুঁজি করতে না পারি, তাহলে বৃহত্তর ফল আসবে না।’

বাংলাদেশের ফুটবলে এই নতুন জোয়ারের বড় কারণ হামজা চৌধুরী। মারুফুল বলেন, হামজা হয়তো আরও সাত–আট বছর খেলতে পারেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। আস্তে আস্তে তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা কমে আসবে। কিন্তু এই উন্মাদনা ধরে রাখতে সামগ্রিকভাবে খেলার উন্নয়নে কাজ শুরু করতে হবে। এই দায়িত্ব যে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের, সেটাও মনে করিয়ে দেন মারুফুল।

যা শুনে উৎপল শুভ্র বলেন, ‘মারুফুল হক যে কথাগুলো বললেন, এগুলো ১৫-২০ বছর ধরেই বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।’ মারুফুল তখনই সামনে আনেন দেশে চার বছর পরপর বিশ্বকাপ উপলক্ষে তৈরি হওয়া ফুটবল উন্মাদনার কথা। তারপর দুঃখ করে বলেন, ‘আজকের ঢেউটা আমাদের ঘরের ভেতরে চলে এসেছে আর আগের বিশ্বকাপের ঢেউগুলো হয়তো আমাদের উঠান পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু আমরা তা ধরে রাখতে পারি না।’

মামুনুল ফুটবল নিয়ে উন্মাদনাকে কাজে লাগাতে না পারার দুঃখের সঙ্গে মনে করিয়ে দেন বাস্তবতাও, ‘ভালো সময়টা আমরা কাজে লাগাতে পারি না। এই যে বলা হয়, এশিয়ান কাপে তিনটা ম্যাচে যদি একটা জিততাম, ফুটবল বদলে যেত।  কিন্তু এক জয়ে কোনো কিছুই হবে না। আমরা চিন্তা করেছিলাম হামজাকে নিয়ে এশিয়া কাপ কোয়ালিফাই করব। আসলে কি আমরা এশিয়া কাপ কোয়ালিফাই করার মতো দল?বিগত এশিয়ান কাপে আমাদের ফল কী? যদি বিগত এশিয়া কাপে আমরা ২ নম্বরে থাকি, এই এশিয়া কাপে আমরা ১ নম্বরে থাকার জন্য চেষ্টা করব। কিন্তু আমরা তো আগে দুইয়ে ছিলাম না। মনে রাখতে হবে আমরা সর্বশেষ কোন জায়গায় ছিলাম।’

এটা কি খেলোয়াড়দের মনেও কাজ করে? উৎপল শুভ্রর প্রশ্নে মামুনুলের উত্তর, ‘আপনি একটা টুর্নামেন্টে যাচ্ছেন, যে টুর্নামেন্টে আপনার সেরা সাফল্য হয়তো চতুর্থ হওয়া। সেখানে প্রথমেই আপনাকে প্রথম হওয়ার ভাবতে পারাটাও বাড়তি প্রেশার।’

সারা পৃথিবীতেই ফুটবল ক্লাবকেন্দ্রিক খেলা। বাংলাদেশে উল্টো। এখানে সব আলোচনা জাতীয় দলকেন্দ্রিক। কারণ, বাংলাদেশে ক্লাব ফুটবল নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। জাতীয় দল নিয়েও আগ্রহটা মূলত হামজা চৌধুরী, শমিত সোম ও ফাহামিদুল ইসলাম এসেছেন বলে। দেশের ফুটবলের মান বেড়েছে কি, বাড়েনি, সেই বিশ্লেষণে না গিয়ে উৎপল শুভ্র বলেন, গণমানুষের মনে অন্তত ফুটবল নিয়ে বড় আগ্রহ তৈরি হয়েছে। মামুনুলকে প্রশ্ন করেন, প্রবাসীদের আসাটাকে তিনি কীভাবে দেখেন?

মামুনুল এটাকে স্বাগতই জানিয়েছেন, ‘এটা সত্য হামজা আর আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। হামজা আসায় যে উন্মাদনাটা হয়েছে, এটি ধরে রাখার দায়িত্ব ফেডারেশনেরই। মারুফ ভাই বললেন, চার বছর পরপর ফুটবলে উন্মাদনা আসে বিশ্বকাপ ঘিরে। ২০১০ সালের এসএ গেমস আমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর অনেক আশাবাদী ছিলাম। আমাদের অনেক সুযোগ–সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। স্বপ্ন বেশি দূর এগোয়নি। স্বপ্ন ওখানেই ভাঙা হয়েছে।’

হামজা এসেছেন, শমিত এসেছেন, আরও ভালো খেলোয়াড় আসবেন। কিন্তু একটি স্কোয়াডের লড়াকু মনোভাব যদি না থাকে বা হামজার মতো খেলোয়াড়কে সমর্থন দেওয়ার মতো স্থানীয় খেলোয়াড় তৈরি না হলে শূন্যতা কিন্তু থেকেই যাবে। এই অভিমত মামুনুলের।

হামজা ও শমিতকে নিয়ে আরেকটু বিস্তারিতও বলেছেন মামুনুল, ‘আমি  মাঠে হামজার কোনো ট্রেনিং সেশন দেখিনি। তবে ভিডিও দেখে বা খেলোয়াড়দের কাছ থেকে শুনেছি, সে অনেক মিশুক। এটা ভালো দিক। প্রথমে স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। হামজা তা পেরেছে। সবার মুখে শুনছি খুব ভালো মানুষ, ভদ্র-বিনয়ী। শমিতের ব্যাপারটা জানি না; কারণ, শমিতের অনেক কিছু দেখিনি। ফাহামিদুলের ভালো-মন্দ সবই শুনেছি।’

কোচের দৃষ্টিকোণ থেকে কী মনে হয়, হামজার জন্য মাঠে বাকিদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কি একটু কঠিন হচ্ছে? উৎপল শুভ্রর এই প্রশ্নের জবাবে মারুফ বলেন, ‘এটা কঠিন হয় না; কারণ, দেখতে হবে তার পজিশনটা কোথায়। হামজা যে পজিশনে খেলে, সেই পজিশনে খুব সহজে সবাই ওর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে। কিন্তু এখন বিষয় হলো শমিত সোম। সে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। যদিও কানাডায় সে ডাবল পিভটের একজন হয়ে খেলে। এখানে একটু অ্যাডজাস্টমেন্টের ব্যাপার রয়েছে।’

বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে মারুফুল হক ও মামুনুল ইসলামের সঙ্গে উৎপল শুভ্রর এই আড্ডার আরও বিস্তারিত জানার ইচ্ছা হলে ভিডিওটা দেখে নিতে পারেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ