বাংলাদেশের অন্যতম ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সৌন্দর্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় লাগানো হয়েছে ফুল-ফলের গাছ। মহাসড়কের বিভাজকে এসব গাছ লাগানোর আরেকটি বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে, এক লেনের গাড়ির হেডলাইটের আলো যেন অন্য লেনের গাড়ির চালককে বিভ্রান্ত করতে না পারে, কারণ এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। দুঃখজনক হচ্ছে, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় মহাসড়কের একাংশে সবজি চাষের নামে সেখানকার অর্ধশতাধিক বকুলগাছ নিধন করেছেন এক ব্যক্তি। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, মহাসড়কটি ২০১৬ সালে চার লেনে রূপান্তর করার পর সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি গাড়ির হেডলাইটের আলো নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভাজকের ওপর লাগানো হয়েছিল বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এর মধ্য রয়েছে বকুল, কাঞ্চন, করবী, গন্ধরাজ, রাধাচূড়া, হৈমন্তী, টগর, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, কদম, পলাশসহ নানা ফুলের গাছ। এ রকম ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে অর্ধলক্ষাধিক। এ ছাড়া সড়কের পাশে ও বিভাজকের ওপর লাগানো হয়েছে জলপাই, অর্জুন, কাঁঠাল, মেহগনি, শিশু, আকাশমণি, নিম, একাশিয়া, হরীতকীসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৪০ হাজারের বেশি গাছ। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বেলতলী এলাকাটি বকুলগাছে সাজানো হয়েছে। গাছগুলো পুরো এলাকাটিকে ফুলে ফুলে সৌন্দর্যের শোভা বাড়িয়ে তুলত। কিন্তু মহাসড়কের পাশের এক চায়ের দোকানি বকুলগাছগুলো কেটে ফেলেন।

অভিযুক্ত মো.

আজমির হোসেনের মধ্যে এ নিয়ে ন্যূনতম অনুশোচনাও দেখা যায়নি। বরং গাছগুলো কাটা নিয়ে তাঁর নির্লিপ্ত স্বীকারোক্তি হচ্ছে, ‘ডিভাইডারের এই গাছগুলো আবর্জনার মতো লাগে, কোনো কামের না। এর লাইগ্যা কাইট্টা ফালাইছি। এইখানে এখন কলা, কাঁঠাল, আম, পেঁপেগাছ লাগাইতেছি। আর জায়গাটার মধ্যে শাকসবজির চাষ করমু।’ তিনি শুধু গাছই কাটেননি, সেগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে লাকড়ির জন্য ব্যবহারও করেছেন। এই ধ্বংসাত্মক কাজকে তিনি ‘ভালো কাজ’ হিসেবে আখ্যায়িতও করেছেন। পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে আমাদের সমাজে সচেতনতার চরম ঘাটতির বিষয়টি এর মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয়।

সড়ক বিভাজকের জায়গাটি কোনোভাবেই শাকসবজি চাষের জায়গা নয়। সরকারি সম্পদ দখল করে তিনি এ কাজ করতেও পারেন না। কিন্তু আইন লঙ্ঘন করতে গিয়ে পরিবেশের প্রতি ধ্বংসাত্মক আরেকটি কর্মকাণ্ড করে বসলেন। এখানে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের অবহেলা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যমতে, কয়েক মাস ধরে একটু একটু করে কেটে বা আগুন লাগিয়ে গাছগুলো মারা হচ্ছিল। অথচ সওজ কর্তৃপক্ষের বিষয়টি চোখেই পড়ল না। এটি চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয়। অভিযুক্ত আজমির হোসেনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এমন কর্মকাণ্ডের জন্য শাস্তি না হলে মহাসড়কের গাছগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। ক্ষতিগ্রস্ত জায়গায় আবারও গাছ লাগানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

১৫ বছর ধরে কড়িয়ে আনা শাক বিক্রি করেন বৃদ্ধা সাহেরা খাতুন

পথে–প্রান্তরে ঘুরে খুঁজে নেন নানা জাতের শাক। জঙ্গলে নিজ থেকে গজানো কলমি, বিলের শাপলা, কচু, কচুর লতি, হেলেঞ্চাসহ নানা জাতের শাক সংগ্রহ করেন দিনভর। বিকেল হলেই বাজারের একপাশে এসে বসে সবুজ শাকের পসরা সাজিয়ে বসেন। চাষ করা নয় বলে তরতাজা এই শাকের স্বাদ ও গুণাগুণ অনেক বেশি। তবু প্রতি আঁটি ২০ টাকায় বিক্রি করেন। ১৫ বছর ধরে এভাবেই শাক বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন বৃদ্ধা সাহেরা খাতুন।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ বাজারে প্রতি বিকেলেই শাক নিয়ে বসেন সাহেরা। নিয়মিত ক্রেতাদের অনেকেই চেনেন তাঁকে। তরজাতা কীটনাশকমুক্ত বলে বিক্রিও হয় তাঁর আনা নানা পদের শাকসবজি। এলাকায় ‘শাক কুড়ানো বুড়ি’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।

গত বুধবার সন্ধ্যায় মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ বাজারে গিয়ে কথা হয় সাহেরা খাতুনের সঙ্গে। তাঁর সামনে তখন কলমি, লাউ, হেলেঞ্চাসহ নানা রকম শাক সাজানো। বিক্রির এক ফাঁকে অনেকটা সময় নিয়েই তিনি কথা বললেন। জানালেন নিজের জীবনসংগ্রামের গল্প। বৃদ্ধা সাহেরার বাড়ি উপজেলার পশ্চিম সোনাপাহাড় গ্রামে।

সাহেরা জানান, মা–বাবার আদর-আহ্লাদেই তিনি বড় হয়েছিলেন। এরপর তাঁর বিয়ে হয় ফটিকছড়ি উপজেলার হেয়াকো এলাকার বড়ইতলি রাস্তার মাথার গোল টিলা গ্রামে। স্বামী আবুল কালাম বারোয়ারি কাজ করতেন। তবে তাঁর সংসারে মনোযোগ ছিল না। দেখতে দেখতেই এক ছেলে আর এক মেয়ের জন্ম দেন তিনি। তবে এর মধ্যে স্বামী আরও তিন বিয়ে করেন। এসবের মধ্যেই অনটনে তাঁর সংসার চলতে থাকে। একপর্যায়ে স্বামীও মারা যান।

সাহেরার ছেলে অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছেলে কাজ নেওয়ায় কিছুদিন সাহেরা শাক বিক্রি বন্ধ রাখেন। তবে ছেলের বিয়ে ও সন্তান হওয়ার পর আবারও অনটন দেখা দেয়। এ কারণে শাক কুড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৫ বছর ধরে এভাবে চলছে তাঁর জীবন।

সাহেরা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর মিরসরাইয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। সেখান থেকে তাঁর মূল জীবনসংগ্রাম শুরু। শুরুতে বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে ডেকোরেটরে ধোয়া-পালার কাজ করতেন। এরপর নিজের কিছু জমানো টাকা ও স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতা নিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেন তিনি। অনটনের কারণে ছেলে–মেয়ে কাউকেই পড়াশোনা করাতে পারেননি।

সাহেরার ছেলে অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছেলে কাজ নেওয়ায় কিছুদিন সাহেরা শাক বিক্রি বন্ধ রাখেন। তবে ছেলের বিয়ে ও সন্তান হওয়ার পর আবারও অনটন দেখা দেয়। এ কারণে শাক কুড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৫ বছর ধরে এভাবে চলছে তাঁর জীবন।

জানতে চাইলে সাহেরা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন। ‘ভোরে বের হয়ে আশপাশের গ্রাম থেকে কলমি, হেলেঞ্চা, থানকুনি, কচু, লতি—যে শাক পাই, তা কুড়িয়ে আনি। কোনো ধরনের সার না থাকায় অনেকেই এসব পছন্দ করেন। শাক বিক্রি থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০০ টাকা আয় হয় তাঁর। এ টাকা দিয়ে নিজের খরচ মেটাই। বাকি টাকা নাতি-নাতনির জন্য কেক-বিস্কুট নিয়ে যাই। কিছু বাঁচলে তুলে দিই ছেলের হাতে।’

জোরারগঞ্জ বাজারে সাহেরা খাতুনের থেকে নিয়মিত শাক কেনেন গৃহবধূ তাসলিমা আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন তো বাজারের সব শাকসবজি সার-কীটনাশকে ভরা। সাহেরা খাতুনের আনা শাকের দাম কম, তবে স্বাদ ভালো। এ কারণে তিনি শাক কেনেন।

জোরারগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী বাহার আলী বলেন, ‘সাহেরা খাতুন এই এলাকারই মেয়ে। ১৫ বছর ধরে বাজারে শাক বিক্রি করেন। বয়স হলেও কাজপাগল এ নারী সব সময় হাসিখুশি থাকেন। সংসার-সন্তানের জন্য তাঁর নিবেদন সত্যিই অসাধারণ।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘আবর্জনার মতো লাগে’, তাই বিভাজকের অর্ধশত বকুলগাছ কাটলেন তিনি
  • ১৫ বছর ধরে কড়িয়ে আনা শাক বিক্রি করেন বৃদ্ধা সাহেরা খাতুন