পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) গঠিত হয়েছে ২৭ বছর হয়েছে। তারও আগে ১৯৮৯ সালের স্থানীয় সরকার পরিষদ ধরলে জেলা পরিষদের ৩৬ বছর বয়স হয়েছে। এত বছর পরও মন্ত্রণালয় এবং পরিষদগুলোর ক্ষমতা ও ক্ষমতায়নের ব্যাপারে বিতর্কের শেষ নেই।

জেলা পরিষদে যাঁদের বসানো হয়, তাঁদের সক্ষমতা নিয়ে রীতিমতো হাস্য রসিকতা বহু দিনের। কারও মতে, ফ্যাক্স পরিষদ (মন্ত্রণালয়ের ফ্যাক্স বার্তায় পুনর্গঠন হয়), কেউ মনে করেন শান্তকরণ পরিষদ। আবার কেউ কেউ সুকুমার রায়ের বাবুরাম সাপুড়ে ছড়া আবৃত্তি করে বলেন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ‘খায় শুধু দুধভাত’ পরিষদ হয়ে উঠেছে বহু আগে।

ক্ষমতার পালাবদল হলে মন্ত্রণালয়ের ফ্যাক্স বার্তায় নাম ওঠানোর দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। রীতিমতো ক্যাঙারু দৌড়ের প্রতিযোগিতা চলে। দৌড়ে চতুর কচ্ছপের কাছে বোকা খরগোশের হেরে যাওয়ার অন্তরালের নানা কাহিনিও শোনা যায়।

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদে একজন চেয়ারম্যান নিয়োগ ও তাঁর কর্মকাণ্ড মুখরোচক বিনোদন হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ (সদ্য প্রয়াত) রাঙামাটিতে আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ নিয়ে আলোচনার সময় বলেছিলেন, নির্বাচন না হওয়ায় আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ অকার্যকর হয়ে পড়ছে। পরিষদগুলো মূল চেতনা ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে। নির্বাচন না হলে প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল চেতনায় ক্ষমতা চর্চা হবে না, চর্চা না হলে ক্ষমতায়ন হবে না এবং সক্ষমতাও আসবে না।

জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদ নিয়ে এত দিন কথা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কেও কথা উঠেছে। সম্প্রতি পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি পত্র নিয়ে আবার নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। গত পয়লা আগস্ট পাঠানো পত্রে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত বিভাগগুলোতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী নিয়োগে কোটা পদ্ধতি কী হবে, জানতে চাওয়া হয়েছে। পত্রে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চাকরিতে নিয়োগে কোটা পুনর্বিন্যাস করে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত বিভাগে শূন্যপদ পূরণে কোটা নির্ধারণের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট মতামতের প্রয়োজন।

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, বিষয়টি এমন যে আগে দেশে কোনো কোটা পদ্ধতি ছিল না। আবার পত্রে কোটা পুনর্বিন্যাসও উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে আগে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য যখন ৫ শতাংশ কোটা ছিল, তখন পরিষদের নিয়োগে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল? জেলা পরিষদের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্পষ্ট মত হচ্ছে, আগের নিয়োগে জেলা পরিষদের আইনের বিধান অনুসরণ করা হয়েছিল।

তাহলে এবার কেন পার্বত্য মন্ত্রণালয় উপযাচক হয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কোটা নির্ধারণে ব্যাখ্যা চাইবে? এই ব্যাখ্যা চাওয়া নিয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা ও সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। কারণ, এই মন্ত্রণালয় পার্বত্য অঞ্চলের জন্য সর্বোচ্চ বার্গেনিং প্রতিষ্ঠান। বার্গেনিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে সব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রণালয়ও এই মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয় হয়ে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বরাদ্দ, পরিকল্পনা, পরিপালনীয় বিষয়সহ সবকিছু পার্বত্য চট্টগ্রামে আসার কথা।

প্রবেশদ্বার হিসেবে কোনটি আসবে অথবা আসবে না—পার্বত্য অঞ্চলের বিশেষ বিধানের এখতিয়ারের বিষয়গুলো পার্বত্য মন্ত্রণালয় বাতলে দেব। কিন্তু পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতি আনুগত্যে নতজানু। এর ফলে, অনেক ক্ষেত্রে অযাচিত পদক্ষেপে নিজেদের সীমাবদ্ধতার ঘের তৈরি করে। পার্বত্য অঞ্চলে এই নিয়ে অনেকের আক্ষেপ রয়েছে। এবারও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানে বিশেষ বিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠান আছে, তাই কোটা পুনর্বিন্যাস নির্দেশনা অনুসরণের কথা বলেনি। বরং পার্বত্য মন্ত্রণালয় পত্র পাঠিয়ে অনুসরণ করার জন্য বলতে বলেছে।

জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদ কেন গঠন করা হয়েছে, পরিষদগুলোর মূল চেতনা ও চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কী—জেলা পরিষদের আইনের শুরুতে বলা হয়েছে: ‘যেহেতু (সংশ্লিষ্ট জেলা) বিভিন্ন অনগ্রসর উপজাতি-অধ্যুষিত একটি বিশেষ এলাকা বিধায় উহার সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নকল্পে একটি পরিষদ স্থাপনের বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়।’

আঞ্চলিক পরিষদের আইনে আরও স্পষ্ট করে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন অগ্রাধিকারের কথা বলা হয়েছে। তার অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে, পার্বত্য অঞ্চল ও এই অঞ্চলের মানুষ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে সব ক্ষেত্রে অনগ্রসর রয়েছে। এর ফলে একধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এই বৈষম্য দূর করে সমতা অর্জন করতে হলে দেশে প্রচলিত বিধিবিধানের সঙ্গে আরও কিছু বিশেষ বিধান করা প্রয়োজন। সে জন্য বিশেষ বিধানে জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদ করা হয়েছে।

বৈষম্য নিরসনে পরিষদগুলোর আইনে জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক আসনবিন্যাস করা হয়েছে। সংরক্ষিত তিনটি নারী আসন ব্যতীত ৩০ সদস্যের জেলা পরিষদে সংখ্যানুপাতে কোন জেলায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও অন্য জনগোষ্ঠীর কতজন সদস্য থাকবে, স্পষ্টভাবে বণ্টন করা আছে। আসনবিন্যাস অনুযায়ী, পরিষদের ও পরিষদে হস্তান্তরিত বিভাগগুলোতে সব উন্নয়ন, কর্মচারী নিয়োগের কোটা নির্ধারণ করা হয়। এককেন্দ্রিক সরকারের কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ সবার উন্নয়ন অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা কঠিন। তাই বিশেষ বিধানে পার্বত্য জেলা পরিষদের ওপর সমতাভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এটাই পার্বত্য জেলা পরিষদের মূল চেতনা ও বৈশিষ্ট্য। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

জেলা পরিষদ গঠিত হওয়ার আগে থেকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি-বেসরকারি নিয়োগে ৫ শতাংশ কোটা ছিল। কিন্তু পরিষদ আইনে যেহেতু জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক আসন বণ্টন করা আছে, সে জন্য নির্বাহী আদেশের কোটা নির্দেশনার চেয়ে আইনের গুরুত্ব বেশি। তাই জেলা পরিষদ ও হস্তান্তরিত বিভাগে নির্বাহী আদেশের কোটাবিন্যাস নির্দেশনার অনুসরণ করা আবশ্যকতা নেই। পরিষদ আইনেই পরিষদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। কারণ, আইন কার্যকারণপ্রণালি বা মোডাস অপারেন্ডি অনুযায়ী নির্বাহী আদেশ, বিধি, প্রবিধি ও নির্দেশনার আগে সংসদে প্রণীত আইনকে প্রাধান্য দিতে হবে। দেশের প্রচলিত বিধিবিধানে সবকিছু চললে বিশেষ বিধানের জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদ করার কোনো দরকার ছিল না।

বুদ্ধজ্যোতি চাকমা প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য ক ষমত সরক র র আইন

এছাড়াও পড়ুন:

সাত কলেজ নিয়ে গুজব ছড়ানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক: শিক্ষা উপদেষ্টা

শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেছেন, “সাত কলেজকে একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু ভুল বোঝাবুঝি ও ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় দ্বিধা তৈরি করছে।”

বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় শিক্ষা সচিব রেহেনা পারভীনসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আরো পড়ুন:

কুবিতে নিম্নমানের খোয়া ব্যবহারের অভিযোগে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিলেন ছাত্রদল নেতা

‘সাজিদ হত্যার ৯০তম দিন, এরপর কি আমি?’

তিনি বলেন, “বিভিন্ন গ্রুপে গুজব ছড়ানো মোটেও কল্যাণকর নয়।”

তিনি আরও জানান, “উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এবং সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া বিবেচনায়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নেতৃত্বে সিরিজ সভা ও মন্ত্রণালয়ের নিবিড় উদ্যোগের মাধ্যমে পরিকল্পনাটি এগোয়। ইতিমধ্যে অনলাইনে প্রায় ৪,৫০০ মতামত সংগৃহীত হয়েছে এবং বিভিন্ন লিখিত মন্তব্যও পাওয়া গেছে। এগুলো মন্ত্রণালয়ের ১২ সদস্য যাচাই করছেন।”

শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, “চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আমরা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে আছি। আশা করছি, আগামী ২০, ২১ ও ২২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় এই বিষয়গুলো উপস্থাপন ও আলোচনার মাধ্যমে ড্রাফট তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।”

ড. আবরার বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং কাজ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “যতটা সম্ভব নিয়ম, নীতি এবং উৎসাহের মধ্য দিয়ে আমরা এগোচ্ছি। শিক্ষার্থীদের কল্যাণ নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য।”

ঢাকা/এএএম/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ