যুক্তরাষ্ট্রের বাজার চলছে ধনীদের ব্যয়ে, অন্যদের খরচ বাড়ছে মূল্যবৃদ্ধির কারণে
Published: 16th, October 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের ভোগব্যয় বৃদ্ধিতে অসম প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ধনীদের ব্যয় যে হারে বাড়ছে, অন্যদের ব্যয় সে হারে বাড়ছে না। ফলে সমাজে যেমন ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি অর্থনীতিতেও ভারসাম্য সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিসের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মহামারির পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যে ভোগব্যয় বেড়েছে, তার প্রায় পুরোটাই করেছে ধনিক শ্রেণি। অন্যদিকে নিচের ৮০ শতাংশ আমেরিকান কেবল মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবন যাপন করছে। খবর ফরচুন ম্যাগাজিন।
মুডিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্ক জান্ডি সতর্ক করেছেন, দেশটির অর্থনীতি এখন ক্রমেই ‘ধনীদের আয় ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে।’ ধনীদের সম্পদ দ্রুত বাড়লেও চাকরির বাজারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রবৃদ্ধি দুর্বল। সেই সঙ্গে পণ্যের দামও বেশি থাকায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে না।
জান্ডি লিখেছেন, অনেক আমেরিকান মনে করেন, অর্থনীতি তাঁদের জন্য কাজ করছে না—এটাই সত্যি। তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মহামারির পর থেকে দেশের নিচের সারির ৮০ শতাংশ মানুষ কেবল মূল্যস্ফীতির সমান হারে খরচ বৃদ্ধি করেছে, অর্থাৎ তাদের ব্যয়ের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি নেই। অথচ আয়ের শীর্ষ ২০ শতাংশই এখন যুক্তরাষ্ট্রের মোট ব্যয়বৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি।
ফেডারেল রিজার্ভের ভোক্তা জরিপ ও আর্থিক হিসাবের তথ্য বিশ্লেষণ করে মুডিস দেখিয়েছে, ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে ধনী ও মধ্যবিত্ত–নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে আয়ের ব্যবধান দ্রুত বাড়ছে।
তথ্যে দেখা যাচ্ছে, কেন সাধারণ আমেরিকানরা মনে করেন, এই অর্থনীতি তাঁদের জন্য নয়। যাঁদের বার্ষিক আয় প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ডলারের নিচে, তাঁরা শুধু মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে খরচ বাড়াতে পেরেছেন। কিন্তু ওপরের ২০ শতাংশ, বিশেষ করে শীর্ষ ৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ, অনেক লাভবান হয়েছেন।
১৯৯৯ সালের শেষ প্রান্তিককে ভিত্তি ধরে মুডিস ব্যয়ের সূচক তৈরি করেছে। ওই সময়ের ভিত্তিমানকে ১০০ ধরা হলে এখন শীর্ষ ৩ দশমিক ৪ শতাংশ আমেরিকানের ব্যয় সূচক প্রায় ১৭০ পয়েন্টে পৌঁছেছে। অন্যদিকে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ব্যয় সূচক প্রায় ১২০ পয়েন্ট—অর্থাৎ মূলত মূল্যস্ফীতির সমান। অর্থাৎ অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এখন এক ক্ষুদ্র, ধনী জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
জান্ডির ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন অনেকটাই ধনীদের খরচের ওপর টিকে আছে। যতক্ষণ তারা ব্যয় করছে, মন্দার আশঙ্কা কম। কিন্তু তারা যদি হঠাৎ সতর্ক হয়ে যায়, তাহলে বড় বিপদ হতে পারে।
ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেফেডারেল রিজার্ভের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ধনীরা আরও দ্রুতহারে সম্পদশালী হচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে নিচের ৫০ শতাংশ মানুষের মোট সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৪ ট্রিলিয়ন বা চার লাখ কোটি ডলার; আগের বছরের ৩ দশমিক ৮৪ ট্রিলিয়ন বা ৩ লাখ ৮৪ হাজার কোটি ডলার থেকে যা সামান্য বেড়েছে। মধ্যবিত্ত (৫০ থেকে ৯০ শতাংশ) শ্রেণির সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৪৮ দশমিক ৪৯ ট্রিলিয়ন বা ৪৮ লাখ ৪৯ হাজার কোটি ডলার—গত বছর যা ছিল ৪৭ লাখ ০২ হাজার কোটি ডলার।
শীর্ষ ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। শীর্ষ ১০ শতাংশ শ্রেণির সম্পদ ৫৮ লাখ ৩৮ হাজার কোটি ডলার। শীর্ষ শূন্য দশমিক ১ থেকে ১ শতাংশ ধনীর সম্পদ ২৭ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। শীর্ষ শূন্য দশমিক ১ শতাংশ শ্রেণির হাতে আছে ২২ লাখ ১৯ হাজার কোটি ডলার—দেশটির নিচের সারির অর্ধেক জনগোষ্ঠীর সম্পদের পাঁচ গুণেরও বেশি। শূন্য দশমিক ১ শতাংশ শ্রেণির সম্পদ আরও বাড়ছে।
ফোর্বসের হিসাব বলছে, এখন বিশ্বে বিলিয়নিয়ার বা শতকোটিপতির সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি—এক বছর আগের তুলনায় আরও ২০০ জন বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে ধনী শূন্য দশমিক ১ শতাংশ মানুষের হাতে এখন দেশটির মোট পারিবারিক সম্পদের ১৪ শতাংশ, কয়েক দশকের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। তাদের বিলাস্য–ব্যসনও বাড়ছে, যদিও দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদে বলা হয়েছে, তার ধরন বদলে গেছে।
খুচরা বিক্রি এখনো শক্ত অবস্থানেযুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থানের গতি মন্থর। মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়লেও ভোক্তারা এখনো খরচ কমায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের তথ্যানুসারে, আগস্ট মাসে খুচরা বিক্রি শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে—এটি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। সেপ্টেম্বর মাসেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল।
বিশ্লেষকেরা বলেন, চাকরির বাজার কিছুটা দুর্বল হলেও স্কুল খোলার মৌসুমে খরচ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। যখন আর উপায়ান্তর থাকবে না, তখনই মার্কিনরা খরচের লাগাম টানবে, তার আগে নয়।
বিশ্লেষকদের সতর্কবার্তা হলো, সাম্প্রতিক তিন মাসে ব্যয়ের বড় অংশ এসেছে মূল্যবৃদ্ধির কারণে, প্রকৃত ক্রয় থেকে নয়। তাঁরা আরও বলেন, সাম্প্রতিক চাহিদা বৃদ্ধির পেছনে শুল্ক বৃদ্ধির আশঙ্কায় আগেভাগে কেনাকাটার প্রবণতাও কাজ করেছে—অক্টোবরে তা কমে যেতে পারে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র শ ন য দশম ক ১ আম র ক ন
এছাড়াও পড়ুন:
ইতিহাসের অভিনব পাঠ
বাংলাদেশের ইতিহাস–পাঠের ক্ষেত্রে হরহামেশা যে গলদ চোখে পড়ে, তা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোর নিরিখে চিহ্নিত করা সম্ভব। ইতিহাসকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির নিরিখে না দেখে কেবলই তা রাষ্ট্রীয় কিংবা নির্ধারিত ক্ষমতাকাঠামোর বিবেচনায় দেখার ঐতিহাসিক প্রবণতার কারণে অনেক সময় বৃহৎ জনসমাজ বিবেচনার বাইরে রয়ে যায়। সাংস্কৃতিক রাজনীতি যেসব বিষয় নিয়ে তার আলোচনা জারি রাখে তার মধ্যে অন্যতম সংস্কৃতি ও ক্ষমতা-সম্পর্ক। বাংলাদেশ-পাঠের ক্ষেত্রে রাফাত আলম এই দুই বিষয়ের মধ্যে সমন্বয়ের ওপর জোর দিয়েছেন।
এই গ্রন্থে ইতিহাসের যে ধারণা বা তত্ত্ব ব্যবহৃত হয়েছে, তা প্রথাগত কাঠামোবাদী ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে আলাদা তা বলা যায়। এখানে লেখক ঐতিহাসিক সমালোচনামূলক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই পদ্ধতি রাফাত আলম এই গ্রন্থে কীভাবে কার্যকর রেখেছেন? শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গে লেখা প্রবন্ধটির দিকে নজর দিলে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে নির্দলীয় ইতিহাস-নির্মাণ বিবেচনায় না রেখে প্রায়ই তাঁকে দলীয় বিচার-বিবেচনায় বিচার করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান যে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের যাত্রা শুরু করেছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের ভেতর দিয়ে, তা অনেকেই চেপে যেতে চান। কিন্তু এই যে পাকিস্তান-আন্দোলন এবং তার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক চেপে যাওয়া—একার্থে তা তাঁর সম্পর্কে প্রকৃত ইতিহাসকে এড়িয়ে একটি স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ইতিহাস নির্মাণ করা, যা সুবিধাবাদী ধারণার ভেতরেই প্রোথিত থাকে। এই গ্রন্থের “শেখ মুজিবের ‘পাকিস্তান-আন্দোলন’ পাঠ: আত্মজীবনীর দর্পণে” শীর্ষক প্রথম প্রবন্ধে জীবনী-সাহিত্যের পটভূমিকায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক কর্মতত্পরতার বিষয়টি বিশেষভাবে স্পষ্ট করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
দ্বিতীয় প্রবন্ধের শিরোনাম: ‘মুনীর চৌধুরীর গল্পসাহিত্য: নবোদ্ভিন্ন বাঙালির জীবনভাষ্য’। প্রবন্ধটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব মুনীর চৌধুরীর গল্প নিয়ে। কিন্তু এই প্রবন্ধের বিষয় কেবল গল্প নয়, বরং গল্পের সীমানা পেরিয়ে ঢাকায় নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ-সময় আর সেই সময়ে যাপিত মানুষজনের কাছে নিয়ে যায়।
এই প্রবন্ধগ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধ অ্যাকাডেমিক সংগঠক মুহম্মদ আবদুল হাই: ‘পাকিস্তান’ থেকে ‘বাংলাদেশ’। যে কেউ আবদুল হাই সম্পর্কে জানতে গেলে এই সত্য খুঁজে পাবেন যে তিনি তাঁর জীবনের প্রথম দিকে তীব্রভাবে পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। রাফাত আলম প্রবন্ধটিতে আবদুল হাইয়ের এই চিন্তা-ধারণা আর কর্মপরিসরের সক্রিয়তা বিষয়েই আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
গ্রন্থটির প্রতিটি প্রবন্ধে লেখকের এই দৃষ্টিভঙ্গি সক্রিয় থেকেছে। ইতিহাসের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতার বিবেচনায় ‘বাংলাদেশ-পাঠ’ বিষয়টি তাই ভিন্ন মাত্রা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। পাঠক গ্রন্থ পাঠের পর এই সত্য নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারবেন।
বাংলাদেশ পাঠ: সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতার অনুষঙ্গে
রাফাত আলম
প্রকাশক: ইউপিএল
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদ: আল নোমান;
পৃষ্ঠা: ১৫৪; মূল্য: ৬০০ টাকা