‘খাদিম, আজকেই সেই রাত।’ ২৫ মার্চ বেলা ১১টায় মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইন রাজাকে ফোনে চার শব্দের এই বার্তা দেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। প্রায় এক মাস আগে থেকে তৈরি হতে থাকা একটা সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা এভাবেই বাস্তবায়নের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। অভিযানটির নাম ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকেই ‘অপারেশন ব্লিৎজ’ নামে এই অভিযানের কথা প্রথম ভেবেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। এর আওতায় সামরিক শাসন জারি করে সামরিক বাহিনীকে ‘বিদ্রোহী’ রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে হেফাজতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে ৫৭ ব্রিগেডকে কোয়েটা থেকে করাচি আনা হয়। সংকেত পাওয়ামাত্র ঢাকার উদ্দেশে উড়াল দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে তারা।

৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে ঢাকায় আসেন টিক্কা খান। ১৭ মার্চ রাতে খাদিম হুসেইন রাজাকে ফোন করে ৫৭ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে নিয়ে কমান্ড হাউসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন।

আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি বইতে খাদিম রাজা লিখেছেন, দুজন সেখানে গিয়ে দেখেন, চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খানও উপস্থিত। টিক্কা খান তাঁদের জানান, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা ভালো এগোচ্ছে না। তাই প্রেসিডেন্ট চান সামরিক পদক্ষেপের জন্য তাঁরা যেন প্রস্তুত থাকেন এবং পরিকল্পনা তৈরি করে রাখেন। পরদিন সারা সকাল অফিসে বসে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর খসড়া তৈরি করেন খাদিম হুসেইন রাজা এবং রাও ফরমান আলী।

শুরুতেই ঠিক হয়, ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শহরগুলোয় বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা, ছাত্রনেতৃবৃন্দ এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার ও প্রয়োজনে হত্যা আর সামরিক আধা সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে শেখ মুজিবের চলমান শাসনের অবসান ঘটানো হবে। সিদ্ধান্ত হয়, ঢাকায় অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন রাও ফরমান আলী, আর অন্যান্য অঞ্চলে খাদিম হুসেইন রাজা। সে অনুযায়ী দুজন আলাদা দুটি পরিকল্পনা করেন।

সন্ধ্যায় কমান্ড হাউসে টিক্কা খান ও হামিদ খানের সামনে সেটি তুলে ধরেন রাজা। পরিকল্পনাটি তখনই অনুমোদিত হয়ে যায়, শুধু দিনক্ষণ অনির্ধারিত থাকে। ২৫ মার্চ সকালে সেটাও জানা হয়ে যায়। অভিযান শুরু হবে ২৬ মার্চ রাত একটায়।

কিন্তু ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বাঙালিরা ততক্ষণে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলছে। তাই নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগেই সেনাবহর রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে পড়ে। ফার্মগেটে মিছিলের ওপর গুলি চালিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের সূচনা করে তারা। তারপর রাতভর চলে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পুরান ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চলে নির্বিচার মানবনিধন। আগুন আর ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে বসন্ত রাতের তারাভরা আকাশ।

২৬ মার্চ দিনের আলো ফোটার আগেই ব্যারাকে ফিরে আসে সেনাদল। ভোর পাঁচটার দিকে মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারের বারান্দা থেকে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করে রুমাল দিয়ে চশমা মুছতে মুছতে তুষ্ট টিক্কা খান বলেন, ‘ওহ, একটা প্রাণীও নাই!’ ঢাকাকে সেদিন প্রাণহীন এক বিরান শহরে পরিণত করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লে.

জেনারেল এ কে নিয়াজি তাঁর দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান বইয়ে পরে লিখেছেন, ‘অভিযানটি ছিল নিষ্ঠুরতার চরম নিদর্শন। বুখারায় চেঙ্গিস খান, বাগদাদে হালাকু খান অথবা জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের গণহত্যার চেয়েও নির্মম। জেনারেল টিক্কা, তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব অর্থাৎ সশস্ত্র বাঙালি ইউনিট ও ব্যক্তিদের নিরস্ত্রীকরণ এবং বাঙালি নেতাদের আটক করার পরিবর্তে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা এবং পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেন। সৈন্যদের প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল: “মানুষ না, মাটি চাই।” ঢাকায় এই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ফরমান–জাহানজেব আরবাব। অথচ চাইলে রক্তপাত ছাড়াই টিক্কা কাজটা করতে পারতেন।’

২৫–২৬ মার্চ রাতে ঢাকায় ঠিক কত লোক মারা গেছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। তবে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং এবং ঢাকার মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাডের দেওয়া আলাদা দুটি হিসাব থেকে এর সামান্য ধারণা পাওয়া যায়। ঘটনার তিন দিন পর ওয়াশিংটনে পাঠানো একটি টেলিগ্রাম বার্তায় ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞকে ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’ আখ্যায়িত করেন ব্লাড। তাঁর হিসাবে সব মিলিয়ে ৪ থেকে ৬ হাজার মানুষ সেদিন মারা গিয়েছিল।

সাইমন ড্রিংয়ের হিসাবে সংখ্যা আরও বেশি। বিদেশি সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগে বাধ্য করা হলেও লুকিয়ে ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন সাইমন। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ঢাকায় ঘুরে ঘুরে ‘ট্যাংকস ক্রাশেস রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ নামে তাঁর একটি প্রতিবেদন ৩০ মার্চ প্রকাশ করে টেলিগ্রাফ। প্রতিবেদনের উপশিরোনাম ছিল ‘সেভেন থাউজেন্ড স্লটারড’। অর্থাৎ ওই রাতে শুধু ঢাকাতেই মারা গেছেন ৭ হাজার। নানা এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে বোঝা যায়, প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত আরও অনেক বেশি।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে রাতভর অপারেশন সার্চলাইট প্রত্যক্ষ করে পরদিন ঢাকা ছাড়ার আগে এবং করাচিতে পৌঁছানোর পর সেনাবাহিনীর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, ‘আল্লাহর অশেষ রহমত, পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।’ এই উক্তির মাত্র ৯ মাসের মাথাতেই প্রমাণ হয়ে যায়, আসলে পাকিস্তান ধ্বংসের সূচনা করেছিল অপারেশন সার্চলাইট। নানা আন্দোলন আর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল, তার কফিনে শেষ পেরেকটি মারে এই সামরিক হত্যা–অভিযান।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খ দ ম হ স ইন র জ ফরম ন

এছাড়াও পড়ুন:

ইসরায়েল ‘সংগঠিত ও ব্যাপক নির্যাতনকে  রাষ্ট্রীয় নীতি’ হিসেবে ব্যবহার করছে

জাতিসংঘের নির্যাতন বিষয়ক কমিটি জানিয়েছে, ইসরায়েল কার্যত ‘সংগঠিত ও ব্যাপক নির্যাতনের রাষ্ট্রীয় নীতি’ পরিচালনা করছে এবং এর প্রমাণ রয়েছে। শনিবার কমিটির বরাত দিয়ে বিবিসি এ তথ্য জানিয়েছে।

কমিটি নিয়মিতভাবে নির্যাতনের বিরুদ্ধে কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী সব দেশের রেকর্ড পর্যালোচনা করে, তাদের সরকার এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীর সাক্ষ্য গ্রহণ করে।

ইসরায়েলের পর্যালোচনার সময় ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি উভয় অধিকার গোষ্ঠীই ইসরায়েলি আটক কেন্দ্রগুলোর পরিস্থিতি সম্পর্কে ভয়াবহ বিবরণ দিয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে যে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েল হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে।

প্রশাসনিক আটক এবং অবৈধ যোদ্ধাদের - সন্দেহভাজনদের যাদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায় না - ইসরায়েলের আইন অনুসারে, তাদের আইনজীবী বা পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ ছাড়াই দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রাখা যেতে পারে।

অনেক ফিলিস্তিনি পরিবার জানিয়েছে, তারা মাসের পর মাস অপেক্ষা করেছে। এমনকি জানতেও পারেনি যে তাদের প্রিয়জনকে আটক করা হয়েছে। বিষয়টিকে জাতিসংঘের কমিটি ‘বলপূর্বক অন্তর্ধান’ বলে অভিহিত করেছে।

কমিটি বিশেষভাবে শিশু, গর্ভবতী মহিলা এবং বয়স্কদেরসহ পুরো ফিলিস্তিনিদের আটক করার জন্য ইসরায়েলের অবৈধ যোদ্ধা আইন ব্যবহারের সমালোচনা করেছে।

কমিটি প্রাপ্ত প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে জানিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের নিয়মিতভাবে খাবার ও পানি থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং তাদের প্রচণ্ড মারধর, কুকুরের আক্রমণ, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করা, জল সরবরাহ এবং যৌন সহিংসতার শিকার হতে হয়। কিছু বন্দিকে স্থায়ীভাবে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়, টয়লেটে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং ডায়াপার পরতে বাধ্য করা হয়।

কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে এই ধরনের আচরণ ‘যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ।’ এতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের ‘সংগঠিত ও ব্যাপক নির্যাতনের রাষ্ট্রীয় নীতি’ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে গণহত্যার অপরাধের একটি।

ইসরায়েল বারবার গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।


 

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইসরায়েল ‘সংগঠিত ও ব্যাপক নির্যাতনকে  রাষ্ট্রীয় নীতি’ হিসেবে ব্যবহার করছে