চারদিকে জাতীয়তাবাদের উত্থান, বাংলাদেশের সাবধানতা দরকার
Published: 15th, February 2025 GMT
বাংলাদেশের চারদিকে বলিষ্ঠ জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটছে। এর আঁচ কিছুটা বাংলাদেশেও লাগছে। আবার বাংলাদেশের আশপাশে নতুন একটা স্নায়ুযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর ক্ষমতার লড়াইয়ের রাজনীতিতে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়া উচিত হবে না। নতুন এই বাস্তবতা মোকাবিলার জন্য জাতীয় সংহতি তৈরি করতে হবে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও কৌশলগত অপরিহার্যতা–বিষয়ক এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। আজ শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ (বিআইপিএস)।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবীর। এ সময় তিনি বাংলাদেশের সামনে চারটি চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন। মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদের নেতিবাচক ফল বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন, এ কথা উল্লেখ করে হুমায়ুন কবীর বলেন, মিয়ানমারে এমন জাতীয়তাবাদ কমছে না। ভারতেও একই বিষয় ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যেও এমন ইঙ্গিত মিলছে। চারদিকেই একধরনের বলিষ্ঠ জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটছে। তার কিছুটা আঁচ বাংলাদেশেও লাগছে। এ বিষয়ে সাবধান থাকা দরকার।
বাংলাদেশের আশপাশে একটা নতুন স্নায়ুযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বলেও মনে করেন হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, স্নায়ুযুদ্ধ আগে ইউরোপে থাকলেও এবার তা বাংলাদেশের ঘাড়ে এসেছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র–চীনের মধ্যে টানাটানি, আবার ভারতের সঙ্গে চীনের। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশ। ফলে এখানে চিন্তার কারণ আছে এবং সাবধান হওয়া দরকার।
এ অঞ্চলের ভূ–অর্থনীতি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে হুমায়ুন কবীর বলেন, এখানে প্রথম শক্তি চীন, যাদের অর্থনীতি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। মিয়ানমারসহ দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশ নিয়ে গঠিত আসিয়ান দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসছে। তৃতীয় শক্তি হিসেবে আসছে ভারত। ২৫ বছর পর এ অঞ্চলে ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হতে পারে, যা মার্কিন অর্থনীতির চার গুণ বড়। হয় এর সঙ্গে বাংলাদেশকে চলতে হবে। নয়তো এই অর্থনীতিগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী হবে, যারা বাংলাদেশকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ চায়, যা দেশকে নতুন ব্যবস্থাপনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে হুমায়ুন কবীর বলেন, নতুন প্রজন্মের উত্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
নতুন এই বাস্তবতা মোকাবিলার জন্য জাতীয় সংহতি তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় থাকতে হবে। অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি লাগবে। বাংলাদেশের বাইরে যে ভূকৌশলগত পরিবর্তনগুলো হচ্ছে, সেসব বুঝতে হলে সজাগভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। রোহিঙ্গার মতো ঝড় আসার আগেই প্রতিরোধমূলক কূটনীতির মাধ্যমে সামাল দিতে হবে। বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকেই নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের ওপর ভরসা রাখতে হবে।
বাংলাদেশের স্বার্থ দেখার জন্য উপযুক্ত মানুষ প্রয়োজন বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান। উপযুক্ত মানুষেরা মূল্যবোধের অবক্ষয়ে জর্জরিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, যাঁরা বিদেশনীতি নিয়ে কাজ করবেন তাঁদের দক্ষতা একটু কম হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু তাঁদের বাংলাদেশের স্বার্থ দেখতে হবে।
এই অঞ্চলে দীর্ঘ মেয়াদে সম্পর্কহীনতা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন কামরুল আহসান। তিনি বলেন, তবে সম্পর্ক খারাপ হলে সে জায়গায় থাকা যাবে না। আর সম্পর্ক হতে হবে রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের চাপের কারণে চীনের সঙ্গে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের চুক্তিতে বাংলাদেশ যায়নি বলে উল্লেখ করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.
দেশের অভ্যন্তরে নিজেরা ঠিক থাকলে বিদেশনীতি ঠিক হয়ে যাবে বলে মনে করেন আইনজীবী আফজাল এইচ খান। তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়তে পারলে ভূরাজনীতিসহ অন্যান্য সংকট ভালোভাবে মোকাবিলা করা যাবে।
বাংলাদেশের হুমকি বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে আফজাল এইচ খান বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেনা মোতায়েনের কথা বলেছিলেন। তখন মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই দেশটির ওপর।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত নাক গলাচ্ছে, মন্তব্য করে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, ভারত, চীনসহ সবার সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক থাকতে হবে। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের অন্যদের ভারতে বসে উসকানিমূলক কথাবার্তা বলা দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে বাধা।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজের (বিআইপিএস) চেয়ার সিএএফ দৌলা। তিনি সেমিনার সঞ্চালনাও করেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর নির্ভর করে আসছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ভারতের জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশের জন্য হুমকি হিসেবেও দেখছেন দৌলা।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির উপদেষ্টা আবুল কাশেম চৌধুরী।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য র জন ত ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
৮% জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কীভাবে ঐক্য হয়, প্রশ্ন সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনসহ কোনো সংস্কার কমিশনে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছে সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন। তাদের প্রশ্ন, ঐকমত্য কমিশনে কোনো রাজনৈতিক দলকেও প্রশ্ন করতে দেখা গেল না যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কোনো প্রতিনিধি না থাকলে বা তাদের বাদ দিয়ে কীভাবে ঐক্য গঠন হয়।
‘অভ্যুত্থান পরবর্তী এক বছরে ৮% জনগোষ্ঠীর অবস্থা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্ন তোলা হয়েছে সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের লিখিত বক্তব্যে। আজ শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সংগঠনটি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) তরুণ রায়। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গণ-অভ্যুত্থানের আগে হোক বা পরে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এখনো ৮ শতাংশ শুধু রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার জায়গা। তাদের অধিকার নিয়ে সচেষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে না কোনো রাজনৈতিক দলকে। সে ক্ষেত্রে এমন অবস্থা চলমান থাকলে ৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে ভবিষ্যতে নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্র বয়কটের সিদ্ধান্তও নিতে হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে বলা হয়, গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা আক্রান্ত হতে থাকেন। তাৎক্ষণিকভাবে গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে সংখ্যালঘুরা জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই আন্দোলন থেকে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠনসহ ৮ দফা দাবি তোলা হয়। সেসব দাবি বাস্তবায়নে তখন অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু গত ১ বছরে ৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের আশানুরূপ কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি।
সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন লিখিত বক্তব্যে আরও উল্লেখ করেছে, বিগত ৫৩ বছরে কোনো সরকারই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। আগামী দিনের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় ৮ দফার বাস্তবায়ন করতে হবে। ৮ দফা যে দেশের ৮ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের মনের কথা জানান দিতে ২২ আগস্ট ‘জাতীয় সংখ্যালঘু সম্মেলন-২০২৫’ আয়োজন করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক সুস্মিতা কর বলেন, সরকারের ঐকমত্য কমিশনে সংখ্যালঘু প্রতিনিধি নেই। দেশের একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে নিয়ে তো ঐকমত্য গঠন হতে পারে না। গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেষ্ট আছে। সংখ্যালঘুদের সব সংগঠন আট দফা দাবিতে একাত্ম। যদি নির্বাচন–পূর্ববর্তী সময়ে সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো থেকে এসব দাবি বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে না দেখা যায়, তাহলে হয়তো সংখ্যালঘুরা ভোট বয়কট লড়তে পারে।
এই সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের প্রচার সম্পাদক সুব্রত বল্লভ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির আদিবাসী সংগঠক সুমন ত্রিপুরা।