Prothomalo:
2025-10-19@16:49:35 GMT

নদী-ভূগোলের লালন

Published: 19th, October 2025 GMT

মার্টিন হাইডেগারের মতে, ভাষা কেবল মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়, একই সঙ্গে তা জগতে মানুষের অস্তিত্বের বাস্তবতা নির্মাণে জরুরি। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, মানুষের অস্তিত্ব ব্যাপারটি কেমন তাহলে, যদি তা ভাষার ভেতর দিয়েই নির্মিত হয়? মানুষের অস্তিত্ব মূলত দুই রকম—ভাবগত আর জৈবিক ও পরিপ্রেক্ষিতগত বিবেচনায় বস্তুগত। বস্তুগতভাবে মানুষের জীবন বাঁচিয়ে রাখার বিষয়টিই সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে; কিন্তু ভাবজগতও বস্তুজগতের সঙ্গী; অর্থাৎ ভাবজগতের ধারণাসমূহও মানবকেন্দ্রিক দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতগত দিক থেকে উৎসারিত হয়। তা ছাড়া এসব ধারণা এককভাবে ভাবগত; অর্থাৎ বিমূর্ত হলেও বিচিত্র ধরনের নৈর্ব্যক্তিক বস্তুদৃঢ়তার ওপর ভিত্তি করেই তার নির্মাণ হয়। তাই ভাষা ও ভাবজগৎগত ভাব সঞ্চারণের জন্য পরিপ্রেক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এতগুলো কথা বলা হলো লালন শাহর গানের ভাষা ও ভাষায় বিধৃত ভাবজগতের পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধানের জন্য। তাঁর গানের ভাষা নির্মাণের আলোচনায় পূর্বোক্ত ধারণা কার্যকর সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনার যথেষ্ট কারণ রয়েছে; অর্থাৎ তাঁর ভাবজগতের আলোচনায় ‘গজদন্তমিনারবাসী’ এবং বিচ্ছিন্ন হিসেবে লালনকে বিবেচনার বিপরীতে বিচিত্র রকমের নৈর্ব্যক্তিক বস্তুদৃঢ়তার সম্পর্ক তাঁর ভাবজগতের আধার হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব হবে।

লালন তাঁর গানে যেসব বিষয় ভাষিক উপাদান; অর্থাৎ তাঁর গানের ভাবগত-প্রতীকতা নির্মাণের ভাষা প্রতীক হিসেবে ব্যহার করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম নদী ও নদীকেন্দ্রিক ধারণা। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী এই অঞ্চলের জনজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

লালন তাঁর গানে যেসব বিষয় ভাষিক উপাদান; অর্থাৎ তাঁর গানের ভাবগত-প্রতীকতা নির্মাণের ভাষা প্রতীক হিসেবে ব্যহার করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম নদী ও নদীকেন্দ্রিক ধারণা। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী এই অঞ্চলের জনজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। খাদ্যের সুষম সংস্থান নিশ্চিতকরণ, যোগাযোগের সহজ মাধ্যম, বাণিজ্যধারণা, ভূমির উর্বরতার সমন্বয় সাধন এবং ক্রমাগত ঐতিহ্য-ধনপ্রাচুর্য নির্মাণে—সর্বোপরি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূমিগঠনগত সৃষ্টিশীলতায় নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

জীবনযাপনের এসব মৌলিক ধারণা ব্যতীত শিল্প-সাহিত্য-সংগীত—সর্বোপরি জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণেও নদীর ভূমিকা সবিশেষ; অর্থাৎ নদী ও নদীতীরবর্তী পূর্বোক্ত কর্মকাণ্ড এই অঞ্চলের জাতীয় সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। লালন কিংবা বাউল মতাদর্শের ভাবগত চিন্তা-আদর্শ প্রকাশ ও প্রচারের বেলায় নদী বিষয়টি বিশেষভাবে এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।

অধিকাংশ লালন-জীবনীকার ‘লালনকে কম বয়সে মৃত্যুসম অবস্থায় নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল’ বলে মন্তব্য করেছেন। এর সত্যাসত্য নিয়ে আলোচনা রেখে সত্যকেই ধরে নেওয়া যায় পুরোনো জনজীবনের ইতিহাস থেকে। কিংবা এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশে তা একেবারেই অমূলক নয়। কারণ, মৃত মানুষকে মৃত হিসেবে কিংবা বাঁচিয়ে রাখার জন্য নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো পৌরাণিক কিংবা লৌকিক কাহিনি আমাদের সাহিত্যঝুলিতে যথেষ্ট পরিমাণেই উপস্থিত রয়েছে। সেই বিদ্যমানতার বিবেচনায় লালনের বেঁচে থাকার ভাসমান অবলম্বন ও আশ্রয়গত পরিগ্রহণের পেছনেও নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই ধারণায় ‘লালন ফকির’ হওয়ার জন্য নদীকেন্দ্রিক স্থানিক পটভূমি বিদ্যমানতায় সরব ছিল তাঁর বেলায়। কোনো সূত্রে জানা যায়, কালীগঙ্গা নদীতেই লালনকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর প্রমত্ত পদ্মা আর তার শাখা-প্রশাখার অভাব ছিল না লালনের কালে, বৃহত্তর কুষ্টিয়ার নদী-ভূগোল পরিমণ্ডলে। এসব নদী এবং নদীতীরবর্তী জনপদের মানুষের যাপিত জীবনের বিচিত্র কর্মকাণ্ডই লালনের গানের ভাবজগৎ আর ভাবজগৎ প্রকাশের ভাষা প্রতীকতা নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।

অধিকাংশ লালন-জীবনীকার ‘লালনকে কম বয়সে মৃত্যুসম অবস্থায় নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল’ বলে মন্তব্য করেছেন। কোনো সূত্রে জানা যায়, কালীগঙ্গা নদীতেই লালনকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর প্রমত্ত পদ্মা আর তার শাখা-প্রশাখার অভাব ছিল না লালনের কালে।

লালন তাঁর একটি গানের এক অংশে বলছেন, ‘এই দেহের মাঝে নদী আছে/ সেই নদীতে নৌকা চলছে/ ছয় জনাতে গুণ টানিছে/ হাল ধরেছে একজনা।’ গানের আরও অংশ আছে, কিন্তু এই অংশে ভাব প্রকাশের বেলায় যে ছবিটা এখানে তৈরি হয়, লালন তৈরি করেন, তা আমাদের চেনা। যান্ত্রিক নৌযান বাংলার নদীতে প্রচলনের পূর্বে নদীগুলোতে এই ছবি স্বাভাবিক। এটি শব্দ দিয়ে নির্মিত একরকমের ছবি, কিন্তু এই ছবির ভেতর দিয়েই লালনের গানের ভাবার্থ নির্মাণপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে; অর্থাৎ দেহতত্ত্বের ধারণাই নির্মাণ করেছেন তিনি। কিন্তু তিনি তো চিকিৎসক নন, ফলে তাঁর বর্ণনাপদ্ধতি শিল্পিত হওয়া চায়। ভাষার মাধ্যমে হওয়া চায়। তাই তিনি এই বর্ণনার বিবেচনায় দৈহিক বাস্তবতার চেয়ে প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক বিষয়াদির দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেছেন। যেখানে নদী হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাপরিবাহী।

কিন্তু এই ভাষা নিজস্বতায় পরিগণিত হওয়ার পরও তা সেই সময়ের বাস্তবতায় জনগণের জন্য দরকারি ‘কেজো ভাষার’ চেয়ে আরেকটু শিল্পিত হওয়া চায়। সাহিত্যিক ভাষার জগৎ বিবেচনায় ‘কেজো ভাষার’ সঙ্গে কার্যকর সাহিত্যিক প্রতীকতা সমৃদ্ধ ভাষা নির্মাণের সক্ষমতাও থাকা প্রয়োজন সাহিত্যিকের। লালনের এই গানে এই বিষয়েই তৈরি হয়েছে নদীকেন্দ্রিক সক্রিয়তায়। দেহতত্ত্ব কিংবা এই ধারণার ভাবজগৎ নির্মাণের ধারণায় তত্ত্বগত, আদর্শগত—এই দুই ধারণা নির্মাণে লালন তাঁর চারপাশের বস্তুক ধারণার বিবিধ বিষয়ের সঙ্গে নদীকেও ব্যবহার করেছেন বিশেষভাবে। ‘অপরূপ সেই নদীর পানি/ জন্মে তাহে মুক্তামণি’, এই গানের অংশও পূর্বোক্ত ধারণায় পাঠ সম্ভব।

চিন্তাদর্শন নির্মাণের বেলায় কেবলই নিজস্ব স্থানিক পটভূমিকেই ব্যবহার করেছেন। উপনিবেশের কেন্দ্র অবস্থান না করেও পূর্ববাংলায় উপনিবেশের তাপ-উত্তাপ কম হলেও লেগেছিল। সেই তাপ-উত্তাপ বাঁচিয়ে নিজস্ব নদী-ভূগোল আর ভূমি ধারণায় তিনি গান রচনা আর সহজিয়া সাধনা সাধন করে গেছেন ক্রমাগত।

একটি গানে ভাবার্থ প্রকাশের বেলায় নদীতে সৃষ্ট জোয়ার-ভাটার প্রসঙ্গ প্রকাশ করেছেন তিনি। গানের এক জায়গায় তিনি বলছেন, ‘চাঁদকোটালে খেলছেরে ভাটা’। প্রসঙ্গতই, এ কথা বলার সামর্থ্য সে–ই রাখে, যে কিনা নদী সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা রাখে। এই ধারণা আপনি নদীবিহীন কোনো অঞ্চলের মানুষের প্রাকৃতিনির্ভর জীবনযাপনে খুঁজে পাবেন না, বিদ্যায়তনিক ধারণায় পরোক্ষভাবে পাওয়ার বিষয়টি ভিন্নকথা। কিন্তু বিদ্যায়তনিক ভূগোলের ধারণা না থাকা সত্ত্বেও নদী ও নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দেশ-জনপদে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা লালনের গানে পাওয়া যায় এভাবে; অর্থাৎ স্থানিক পটভূমিগত ও পরিবেশগত বাস্তবতায় আর নদীমাতৃকতায় তাঁর গান নতুন ধারণা-অবস্থায় পৌঁছোতে পেরেছে। ফলে মরুকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক ভূগোলে লালনের জন্ম হলে ওই নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ভূগোলের বিবেচনাতেই লালন নিশ্চয় তাঁর গান লিখতেন অন্যভাবে। সেখানে হয়তোবা থাকত নদীর বদলে মরুভূমি; আর পানির বদলে বালু।

শেষ কথা, বাংলায় আঠারো শতকের শেষ থেকেই ‘কৃত্রিম যান্ত্রিক যুগ’ ও ‘আধুনিকায়নের’ ফলে শিল্প-সংস্কৃতির যে ধারণা তৈরি হলো, সেই যুগবাস্তবতায় বসবাস করেও লালন তাঁর চিন্তাদর্শন নির্মাণের বেলায় কেবলই নিজস্ব স্থানিক পটভূমিকেই ব্যবহার করেছেন। উপনিবেশের কেন্দ্র অবস্থান না করেও পূর্ববাংলায় উপনিবেশের তাপ-উত্তাপ কম হলেও লেগেছিল। সেই তাপ-উত্তাপ বাঁচিয়ে নিজস্ব নদী-ভূগোল আর ভূমি ধারণায় তিনি গান রচনা আর সহজিয়া সাধনা সাধন করে গেছেন ক্রমাগত। আর একটা বিষয়: নদী ও নদীকেন্দ্রিকতার বিস্তৃত পরিসরে ভাষা নির্মাণের মাধ্যমে লালন সম্প্রদায় নির্বিশেষ অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী দর্শন-ধারণার নিজস্বতা তৈরি করতে পেরেছিলেন, যা পশ্চিমবাহিত দার্শনিক ধারণার মধ্যে নয়, বরং এই অঞ্চলের জনসমাজ ও জনপরিসর-নির্ভর—এই দুই বর্গের কল্যাণকামিতায় যা সর্বদা সক্রিয় সমর্থন নির্মাণ করে ক্রিয়াশীল থাকে। তাই নদী ও লালন একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ও নদ ক ন দ র ক স থ ন ক পটভ ম পর প র ক ষ ত উপন ব শ র র কর ছ ন প রক শ র ব স তবত র জন য অর থ ৎ অবস থ ল লনক ভ বগত

এছাড়াও পড়ুন:

নদী-ভূগোলের লালন

মার্টিন হাইডেগারের মতে, ভাষা কেবল মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়, একই সঙ্গে তা জগতে মানুষের অস্তিত্বের বাস্তবতা নির্মাণে জরুরি। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, মানুষের অস্তিত্ব ব্যাপারটি কেমন তাহলে, যদি তা ভাষার ভেতর দিয়েই নির্মিত হয়? মানুষের অস্তিত্ব মূলত দুই রকম—ভাবগত আর জৈবিক ও পরিপ্রেক্ষিতগত বিবেচনায় বস্তুগত। বস্তুগতভাবে মানুষের জীবন বাঁচিয়ে রাখার বিষয়টিই সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে; কিন্তু ভাবজগতও বস্তুজগতের সঙ্গী; অর্থাৎ ভাবজগতের ধারণাসমূহও মানবকেন্দ্রিক দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতগত দিক থেকে উৎসারিত হয়। তা ছাড়া এসব ধারণা এককভাবে ভাবগত; অর্থাৎ বিমূর্ত হলেও বিচিত্র ধরনের নৈর্ব্যক্তিক বস্তুদৃঢ়তার ওপর ভিত্তি করেই তার নির্মাণ হয়। তাই ভাষা ও ভাবজগৎগত ভাব সঞ্চারণের জন্য পরিপ্রেক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এতগুলো কথা বলা হলো লালন শাহর গানের ভাষা ও ভাষায় বিধৃত ভাবজগতের পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধানের জন্য। তাঁর গানের ভাষা নির্মাণের আলোচনায় পূর্বোক্ত ধারণা কার্যকর সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনার যথেষ্ট কারণ রয়েছে; অর্থাৎ তাঁর ভাবজগতের আলোচনায় ‘গজদন্তমিনারবাসী’ এবং বিচ্ছিন্ন হিসেবে লালনকে বিবেচনার বিপরীতে বিচিত্র রকমের নৈর্ব্যক্তিক বস্তুদৃঢ়তার সম্পর্ক তাঁর ভাবজগতের আধার হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব হবে।

লালন তাঁর গানে যেসব বিষয় ভাষিক উপাদান; অর্থাৎ তাঁর গানের ভাবগত-প্রতীকতা নির্মাণের ভাষা প্রতীক হিসেবে ব্যহার করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম নদী ও নদীকেন্দ্রিক ধারণা। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী এই অঞ্চলের জনজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

লালন তাঁর গানে যেসব বিষয় ভাষিক উপাদান; অর্থাৎ তাঁর গানের ভাবগত-প্রতীকতা নির্মাণের ভাষা প্রতীক হিসেবে ব্যহার করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম নদী ও নদীকেন্দ্রিক ধারণা। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী এই অঞ্চলের জনজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। খাদ্যের সুষম সংস্থান নিশ্চিতকরণ, যোগাযোগের সহজ মাধ্যম, বাণিজ্যধারণা, ভূমির উর্বরতার সমন্বয় সাধন এবং ক্রমাগত ঐতিহ্য-ধনপ্রাচুর্য নির্মাণে—সর্বোপরি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূমিগঠনগত সৃষ্টিশীলতায় নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

জীবনযাপনের এসব মৌলিক ধারণা ব্যতীত শিল্প-সাহিত্য-সংগীত—সর্বোপরি জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণেও নদীর ভূমিকা সবিশেষ; অর্থাৎ নদী ও নদীতীরবর্তী পূর্বোক্ত কর্মকাণ্ড এই অঞ্চলের জাতীয় সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। লালন কিংবা বাউল মতাদর্শের ভাবগত চিন্তা-আদর্শ প্রকাশ ও প্রচারের বেলায় নদী বিষয়টি বিশেষভাবে এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।

অধিকাংশ লালন-জীবনীকার ‘লালনকে কম বয়সে মৃত্যুসম অবস্থায় নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল’ বলে মন্তব্য করেছেন। এর সত্যাসত্য নিয়ে আলোচনা রেখে সত্যকেই ধরে নেওয়া যায় পুরোনো জনজীবনের ইতিহাস থেকে। কিংবা এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশে তা একেবারেই অমূলক নয়। কারণ, মৃত মানুষকে মৃত হিসেবে কিংবা বাঁচিয়ে রাখার জন্য নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো পৌরাণিক কিংবা লৌকিক কাহিনি আমাদের সাহিত্যঝুলিতে যথেষ্ট পরিমাণেই উপস্থিত রয়েছে। সেই বিদ্যমানতার বিবেচনায় লালনের বেঁচে থাকার ভাসমান অবলম্বন ও আশ্রয়গত পরিগ্রহণের পেছনেও নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই ধারণায় ‘লালন ফকির’ হওয়ার জন্য নদীকেন্দ্রিক স্থানিক পটভূমি বিদ্যমানতায় সরব ছিল তাঁর বেলায়। কোনো সূত্রে জানা যায়, কালীগঙ্গা নদীতেই লালনকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর প্রমত্ত পদ্মা আর তার শাখা-প্রশাখার অভাব ছিল না লালনের কালে, বৃহত্তর কুষ্টিয়ার নদী-ভূগোল পরিমণ্ডলে। এসব নদী এবং নদীতীরবর্তী জনপদের মানুষের যাপিত জীবনের বিচিত্র কর্মকাণ্ডই লালনের গানের ভাবজগৎ আর ভাবজগৎ প্রকাশের ভাষা প্রতীকতা নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।

অধিকাংশ লালন-জীবনীকার ‘লালনকে কম বয়সে মৃত্যুসম অবস্থায় নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল’ বলে মন্তব্য করেছেন। কোনো সূত্রে জানা যায়, কালীগঙ্গা নদীতেই লালনকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর প্রমত্ত পদ্মা আর তার শাখা-প্রশাখার অভাব ছিল না লালনের কালে।

লালন তাঁর একটি গানের এক অংশে বলছেন, ‘এই দেহের মাঝে নদী আছে/ সেই নদীতে নৌকা চলছে/ ছয় জনাতে গুণ টানিছে/ হাল ধরেছে একজনা।’ গানের আরও অংশ আছে, কিন্তু এই অংশে ভাব প্রকাশের বেলায় যে ছবিটা এখানে তৈরি হয়, লালন তৈরি করেন, তা আমাদের চেনা। যান্ত্রিক নৌযান বাংলার নদীতে প্রচলনের পূর্বে নদীগুলোতে এই ছবি স্বাভাবিক। এটি শব্দ দিয়ে নির্মিত একরকমের ছবি, কিন্তু এই ছবির ভেতর দিয়েই লালনের গানের ভাবার্থ নির্মাণপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে; অর্থাৎ দেহতত্ত্বের ধারণাই নির্মাণ করেছেন তিনি। কিন্তু তিনি তো চিকিৎসক নন, ফলে তাঁর বর্ণনাপদ্ধতি শিল্পিত হওয়া চায়। ভাষার মাধ্যমে হওয়া চায়। তাই তিনি এই বর্ণনার বিবেচনায় দৈহিক বাস্তবতার চেয়ে প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক বিষয়াদির দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেছেন। যেখানে নদী হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাপরিবাহী।

কিন্তু এই ভাষা নিজস্বতায় পরিগণিত হওয়ার পরও তা সেই সময়ের বাস্তবতায় জনগণের জন্য দরকারি ‘কেজো ভাষার’ চেয়ে আরেকটু শিল্পিত হওয়া চায়। সাহিত্যিক ভাষার জগৎ বিবেচনায় ‘কেজো ভাষার’ সঙ্গে কার্যকর সাহিত্যিক প্রতীকতা সমৃদ্ধ ভাষা নির্মাণের সক্ষমতাও থাকা প্রয়োজন সাহিত্যিকের। লালনের এই গানে এই বিষয়েই তৈরি হয়েছে নদীকেন্দ্রিক সক্রিয়তায়। দেহতত্ত্ব কিংবা এই ধারণার ভাবজগৎ নির্মাণের ধারণায় তত্ত্বগত, আদর্শগত—এই দুই ধারণা নির্মাণে লালন তাঁর চারপাশের বস্তুক ধারণার বিবিধ বিষয়ের সঙ্গে নদীকেও ব্যবহার করেছেন বিশেষভাবে। ‘অপরূপ সেই নদীর পানি/ জন্মে তাহে মুক্তামণি’, এই গানের অংশও পূর্বোক্ত ধারণায় পাঠ সম্ভব।

চিন্তাদর্শন নির্মাণের বেলায় কেবলই নিজস্ব স্থানিক পটভূমিকেই ব্যবহার করেছেন। উপনিবেশের কেন্দ্র অবস্থান না করেও পূর্ববাংলায় উপনিবেশের তাপ-উত্তাপ কম হলেও লেগেছিল। সেই তাপ-উত্তাপ বাঁচিয়ে নিজস্ব নদী-ভূগোল আর ভূমি ধারণায় তিনি গান রচনা আর সহজিয়া সাধনা সাধন করে গেছেন ক্রমাগত।

একটি গানে ভাবার্থ প্রকাশের বেলায় নদীতে সৃষ্ট জোয়ার-ভাটার প্রসঙ্গ প্রকাশ করেছেন তিনি। গানের এক জায়গায় তিনি বলছেন, ‘চাঁদকোটালে খেলছেরে ভাটা’। প্রসঙ্গতই, এ কথা বলার সামর্থ্য সে–ই রাখে, যে কিনা নদী সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা রাখে। এই ধারণা আপনি নদীবিহীন কোনো অঞ্চলের মানুষের প্রাকৃতিনির্ভর জীবনযাপনে খুঁজে পাবেন না, বিদ্যায়তনিক ধারণায় পরোক্ষভাবে পাওয়ার বিষয়টি ভিন্নকথা। কিন্তু বিদ্যায়তনিক ভূগোলের ধারণা না থাকা সত্ত্বেও নদী ও নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দেশ-জনপদে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা লালনের গানে পাওয়া যায় এভাবে; অর্থাৎ স্থানিক পটভূমিগত ও পরিবেশগত বাস্তবতায় আর নদীমাতৃকতায় তাঁর গান নতুন ধারণা-অবস্থায় পৌঁছোতে পেরেছে। ফলে মরুকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক ভূগোলে লালনের জন্ম হলে ওই নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ভূগোলের বিবেচনাতেই লালন নিশ্চয় তাঁর গান লিখতেন অন্যভাবে। সেখানে হয়তোবা থাকত নদীর বদলে মরুভূমি; আর পানির বদলে বালু।

শেষ কথা, বাংলায় আঠারো শতকের শেষ থেকেই ‘কৃত্রিম যান্ত্রিক যুগ’ ও ‘আধুনিকায়নের’ ফলে শিল্প-সংস্কৃতির যে ধারণা তৈরি হলো, সেই যুগবাস্তবতায় বসবাস করেও লালন তাঁর চিন্তাদর্শন নির্মাণের বেলায় কেবলই নিজস্ব স্থানিক পটভূমিকেই ব্যবহার করেছেন। উপনিবেশের কেন্দ্র অবস্থান না করেও পূর্ববাংলায় উপনিবেশের তাপ-উত্তাপ কম হলেও লেগেছিল। সেই তাপ-উত্তাপ বাঁচিয়ে নিজস্ব নদী-ভূগোল আর ভূমি ধারণায় তিনি গান রচনা আর সহজিয়া সাধনা সাধন করে গেছেন ক্রমাগত। আর একটা বিষয়: নদী ও নদীকেন্দ্রিকতার বিস্তৃত পরিসরে ভাষা নির্মাণের মাধ্যমে লালন সম্প্রদায় নির্বিশেষ অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী দর্শন-ধারণার নিজস্বতা তৈরি করতে পেরেছিলেন, যা পশ্চিমবাহিত দার্শনিক ধারণার মধ্যে নয়, বরং এই অঞ্চলের জনসমাজ ও জনপরিসর-নির্ভর—এই দুই বর্গের কল্যাণকামিতায় যা সর্বদা সক্রিয় সমর্থন নির্মাণ করে ক্রিয়াশীল থাকে। তাই নদী ও লালন একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ