সুনামগঞ্জের জলমহালে ‘পলো বাওয়া’ উৎসবের নামে যেটা ঘটেছে, সেটা যেমন একদিকে মানুষের দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের প্রাথমিক নিষ্ক্রিয়তারও প্রতিফলন। যেভাবে হাজার হাজার মানুষ পলো, লাঠিসোঁটা ও টেঁটা নিয়ে একের পর এক জলমহালে নেমে মাছ ধরেছেন, সেটাকে নৈরাজ্য না বলে উপায় নেই। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এই নৈরাজ্যে তিনজনের প্রাণহানি হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছেন একজন।
সুনামগঞ্জের ক্ষেত্রে একটা প্রথা দেখা যায় যে হাওর এলাকার জলমহালগুলোতে মাছ ধরা শেষ হয়ে গেলে ইজারাদারদের পক্ষ থেকে আশপাশের লোকজনকে মাছ ধরার সুযোগ দেওয়া হয়। এবার ইজারাদারেরা মাছ ধরার আগেই হাজার হাজার মানুষ মাছ ধরে নিয়ে গেছেন। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এটা থামাতে শুরুতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাতে প্রথম আলো জানাচ্ছে, জলমহাল ইজারা দেওয়ার যে নীতিমালা রয়েছে, এত দিন সুস্পষ্টভাবে তার লঙ্ঘন করে আসা হচ্ছে। নীতিমালা অনুযায়ী, মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে জলমহাল ইজারা নিতে হয়। কিন্তু জলমহাল ব্যবস্থাপনার যে খরচ ও শক্তি দরকার, সেটি সমিতির সাধারণ মৎস্যজীবীদের থাকে না। তাই পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী শক্তি।
প্রতিটি জলমহালের নির্ধারিত সীমানা থাকে। কিন্তু বর্ষায় পুরো হাওর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন ইজারাদারের লোকজন। স্থানীয় বাসিন্দা, দরিদ্র জেলে ও কৃষকদের হাওরে নামতে কিংবা ভাসান পানিতে মাছ ধরতে বাধা দেন তাঁরা। কথা না শুনলে তাঁদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। এ নিয়ে ইজারাদারের প্রতি স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু এভাবে রীতিমতো উৎসব করে মাছ লুটের ঘটনার পেছনে কারও কারও ইন্ধন থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তদন্ত করে অবশ্যই ইন্ধনদাতাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা জরুরি।
বিগত ১৫ বছরে এ জলমহালগুলো আওয়ামী লীগের লোকজনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিছু জলমহালে বিএনপির লোকেরাও অংশীদার ছিলেন। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের লোকজন হয় পালিয়ে গেছেন অথবা বিএনপির লোকদের সঙ্গে একধরনের বন্দোবস্তে এসেছেন। লোক পাল্টালেও পুরোনো ব্যবস্থা থেকে বের হওয়া যাবে, তার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। মামলা, গ্রেপ্তারসহ প্রশাসনিক পদক্ষেপের কারণে শেষ পর্যন্ত এই অরাজকতা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু যে অনাস্থা ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হলো, তাতে ভবিষ্যতে জলমহাল ইজারা কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এতে স্থানীয় মানুষেরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, আবার সরকারও রাজস্ব হারাবে।
সুনামগঞ্জে জলমহাল ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ইজারার নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। প্রভাবশালী কিংবা রাজনৈতিক লোকদের কাছে ইজারা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা। জলমহাল যেন সাধারণ জেলে–কৃষকের জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে, প্রশাসনকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইজ র দ র
এছাড়াও পড়ুন:
গোপালগঞ্জে এনসিপির অনেকের জীবননাশের হুমকি ছিল, আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগ করা হয়েছে
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অনেকের জীবননাশের হুমকি ছিল বলে জানিয়েছে সেনা সদর। তারা বলেছে, সেই ব্যক্তিদের জীবন বাঁচানোর জন্যই সেনাবাহিনী সহায়তা করেছে। আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়েছে। এখানে জীবন বাঁচানোই মূল লক্ষ্য ছিল, অন্য কিছু নয়।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সেনা সদরের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলা হয়েছে। ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেস-এ-তে অনুষ্ঠিত এই ব্রিফিংয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা এবং সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘প্রত্যেকটি জীবন মূল্যবান। যেকোনো কারণেই হোক, কোনো জীবনহানি ঘটবে এটা আমরা আশা করি না। গোপালগঞ্জে যে ঘটনাটি ঘটেছে, এটা অবশ্যই দুঃখজনক। কিন্তু কোন প্রেক্ষাপটে ঘটেছে, কেন সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলপ্রয়োগ করতে হয়েছে, সে ব্যাপারেও সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর তৎপরতাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘কোনো দলকে নয়, কোনো ব্যক্তিকে নয়, বরং যাদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে, সেটি বিবেচনা করেই তাদেরকে উদ্ধার করেছি। ইতিপূর্বেও একই কাজ করেছি। কোনো দল নয়, জীবন রক্ষার্থেই এই কাজটি করতে হয়েছিল।’
নাজিম-উদ-দৌলা আরও বলেন, সেনাবাহিনীর আয়ত্তের ভেতরে আছে, কাছাকাছি বা দায়িত্বের ভেতরে আছে এমন সময় কারও জীবন বিপন্ন হবে, এ সময় সেনাবাহিনী চুপ থাকতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যে কারও বিষয়ে আমাদের অবস্থান একই। ‘সিনিয়র লিডারশিপের’ (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের) নির্দেশনা একইভাবে দেওয়া। কোনো একটা জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে, এ সময় তাকে মৃত্যুর মুখে রেখে বা তার প্রতি নজর না দিয়ে সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অবশ্যই সেনাবাহিনীর জন্য জীবন রক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই কাজটিই করেছি এবং করব।
সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক বলেন, ‘একটা বিপৎসংকুল সময় আমরা পার করছি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সবার সহযোগিতা দরকার। আমরা যেন সম্মিলিতভাবে কাজ করে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারি।’
গোপালগঞ্জের ঘটনার বিষয়ে আগাম কোনো তথ্য ছিল কি না, থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া গেল না কেন—এসব বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। জবাবে সেনা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনো রাজনৈতিক দল কোথায় তাদের সভা, সমাবেশ বা বৈঠক করবে এটা মূলত স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। এ বিষয়ে তারা জানত, আমাদের কাছে আগাম কোনো তথ্য ছিল না।’
গোপালগঞ্জে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল স্টাফ কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এটা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ছিল। যেখানে শুধু ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়নি, ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। সেখানে জীবননাশের হুমকি ছিল। তখন আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। এখানে প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়নি।’
এনসিপির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এক সাংবাদিক জানতে চান একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর বিশেষ কোনো দুর্বলতা আছে কি না—জবাবে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশেষ কোনো দলের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর আলাদা কোনো নজর নেই। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সবাই সমান। তবে যেখানে জনদুর্ভোগ ও জীবননাশের হুমকি থাকে সেখানে সেনাবাহিনী কঠোর হয়। জনসাধারণকে সহায়তা করে থাকে। সেখানে (গোপালগঞ্জ) সেনাবাহিনী যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করত, তাহলে আরও হতাহত বা জীবননাশের শঙ্কা থাকত। সেই হিসেবে সেনাবাহিনী সেটা করেছে।’
সেনা সদরের ব্রিফিংয়ে কথা বলেন সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেস-এ-তে এই ব্রিফিং হয়