চট্টগ্রামের ঈদ বাজারে মিথ্যার ফাঁদে ক্রেতা আকর্ষণ
Published: 16th, March 2025 GMT
ঈদের কেনাকাটায় ধুম লেগেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। ইফতারের বিরতি ছাড়া যেন দম ফেলার ফুসরত নেই বিক্রেতাদের। নগরীর সব মার্কেট, শপিং মল এবং বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাকের দোকানগুলোতে প্রতিদিন দুপুরের পর থেকেই উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ক্রেতারা মার্কেট ও দোকান ঘুরে নিজেদের পছন্দের পোশাক ও প্রসাধনী সমগ্রী কেনাকাটা করছেন মধ্যরাত পর্যন্ত।
ক্রেতা চাহিদার সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন পোষাক ব্র্যান্ডের ব্যবসায়ীরা দেশীয় পোশাককে বিদেশি ও ভারতীয় বলে ক্রেতাদের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কয়েকটি বড় পোশাক ব্র্যান্ডকে জরিমানাও করেছে চট্টগ্রামের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
আরো পড়ুন: দেশী পাঞ্জাবীকে ভারতীয় বলে বিক্রি, জরিমানা ২ লাখ
আরো পড়ুন:
ঈদে যমুনা সেতু মহাসড়কে যানজটের শঙ্কা
ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু আজ, ফিরতি টিকিট ২৪ মার্চ
চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত মিমি সুপার মার্কেট, চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্স, সানমার শপিং মল, ইউনেস্কো সিটি সেন্টার, বালি আর্কেড, আখতারুজ্জামান সেন্টার, ফিনলে স্কয়ার, মতি টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্সসহ নগরীর সবগুলো বড় বড় শপিং মল ও মার্কেটে বেচাবিক্রি চলছে দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। অভিজাত শ্রেণির ক্রেতারা এসব শপিং মলগুলো থেকে কেনাকাটা করছেন।
নিম্ন আয়ের মানুষের কেনাকাটার ভরসাস্থল চট্টগ্রামের হকার্স মার্কেট, রিয়াজ উদ্দিন বাজারসহ সড়কের পাশে গড়ে ওঠা অস্থায়ী ফুটপাতের দোকানগুলো। উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে আড়ং ও সেইলরসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতে।
চট্টগ্রামের বালি আর্কেড শপিং মলে ঈদের কেনাকাটা করতে আসা তানভীরুল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, “বিক্রেতারা পোশাকের অতিরিক্ত মূল্য হাঁকাচ্ছেন। যে পোশাক দুই হাজার টাকায় বিক্রি করবেন তার দাম চাওয়া হচ্ছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এই অবস্থায় পোশাক পছন্দ করে কেনা দায় হয়ে পড়েছে।”
একই মার্কেটে আসা অপর ক্রেতা নাসিমা সুলতানা বলেন, “একদিকে প্রচণ্ড ভিড়, অপরদিকে বিক্রেতাদের অস্বাভাবিক দাম চাওয়া আমাদের বিভ্রান্ত করছে। দরদাম করে পোশাক কেনাও দায় হয়ে পড়েছে।”
এদিকে, বিভিন্ন মার্কেটে ক্রেতা চাহিদা এবং ভিড়কে পুঁজি করে দেশী পোশাককে ভারতীয় ও বিদেশি পোশাক বলে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। চট্টগ্রাম নগরীর পাঞ্জাবির বড় ব্র্যান্ড সেলিম পাঞ্জাবি এবং পরীস্থান নামের দুইটি প্রতিষ্ঠান দেশিয় পাঞ্জাবিকে ভারতীয় পাঞ্জাবি বলে বিক্রি করার চিত্র হাতে নাতে ধরেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। পরে এই দুই প্রতিষ্ঠানকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
চট্টগ্রাম ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ফয়েজ উল্লাহ রাইজিংবিডিকে বলেন, “ঈদ বাজারে প্রতারণা রোধে এবং ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। সর্বশেষ গত শনিবার চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে পাঞ্জাবির বড় ব্র্যান্ড সেলিম পাঞ্জাবি ও পরীস্থানে অভিযান পরিচালনা করা হয়।”
তিনি আরো বলেন, “এই প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা থেকে কিনে আনা দেশে তৈরি পাঞ্জাবিকে ইন্ডিয়ান পাঞ্জাবি বলে ট্যাগ লাগিয়ে বেশি দামে বিক্রি করার চিত্র হাতে নাতে ধরা পড়ে। এছাড়া, এই প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত দামে পোশাক বিক্রি করছিল। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দোষ স্বীকারের পর সেলিম পাঞ্জাবিকে ২ লাখ টাকা এবং পরীস্থানকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এই ধরনের অভিযান আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।”
ঢাকা/রেজাউল/মাসুদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ঈদ উৎসব ঈদ নগর র
এছাড়াও পড়ুন:
আরও বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের সংগ্রামের জমিন
মে দিবস। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন শ্রমিকেরা। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়েই কাগজে–কলমে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমের মর্যাদা, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠনের অধিকার। একসময় এসব দাবিই রূপ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ভিত্তিতে।
কিন্তু ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এই দিনে ফিরে তাকাই, তখন প্রশ্ন আসে, এখনো কি সেই সব দাবি প্রাসঙ্গিক? নাকি সময় পাল্টে দিয়েছে সব? এখন তো কাজের ধরনই বদলে গেছে—একদিকে অটোমেশন, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রা। উৎপাদনের পদ্ধতি যেভাবে বদলেছে, তাতে পুরোনো ধরনের শ্রমিক যেন ক্রমে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন।
আজকের দুনিয়ায় পুঁজি এক ক্লিকে দেশান্তরিত হয়, কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে মজুরি কম এবং আইনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। মানুষ এখন আর কেবল শ্রমিক নয়; তাঁদের বলা হচ্ছে ‘ফ্রিল্যান্সার’, ‘কন্ট্রিবিউটর’, ‘পার্টনার’, ‘ডেলিভারি ম্যান’। কিন্তু আসলে, এদের অনেকেই এক নতুন ধরনের দিনমজুর; যাঁদের নেই নিরাপত্তা, নেই সুনির্দিষ্ট অধিকার। কাজ করছেন তাঁরা—কখনো রাস্তায় খাবার পৌঁছে দিয়ে, কখনো কম্পিউটারে চ্যাটবট প্রশিক্ষণ দিয়ে, আবার কখনো অ্যালগরিদম পরিশোধনে; কিন্তু কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন। তাঁরা জানেন না যে তাঁদের কাজের ফল কোথায় যাবে, কীভাবে ব্যবহৃত হবে।
এই ব্যবস্থার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে অ্যামাজন। তাদের গুদাম ও সরবরাহ চেইনে রোবট, ড্রোন ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। শ্রমিকেরা সেখানে নির্ধারিত সময়ের বেশি কাজ করতে বাধ্য হন, মেশিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অথচ যখন তাঁরা সংগঠিত হতে চান, তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠে লবিং, বিরোধিতা, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ। ২০২৩ সালে অ্যামাজনের একাধিক গুদামে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টাকে রুখে দিতে কোম্পানিটি কোটি কোটি ডলার খরচ করে আইনি দল গঠন করে।
মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়; সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে নাশুধু অ্যামাজন নয়, গোটা দুনিয়াতেই শ্রমের এক নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে—ডিজিটাল ও প্ল্যাটফর্মভিত্তিক শ্রম। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকেরা কাজ করেন উবার, ফুডপান্ডা, আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো অ্যাপে যুক্ত হয়ে। অথচ তাঁদের নেই কোনো কর্মস্থল, নেই কর্মঘণ্টার নিশ্চয়তা, নেই অসুস্থতার ছুটি বা পেনশনের মতো সামাজিক সুরক্ষা। বাস্তবে তাঁরা একা, বিচ্ছিন্ন। প্রতিযোগিতার চাপে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় অনিরাপত্তার ভেতর।
২০২৩ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের অন্তত ৮০% গিগ-ওয়ার্কার দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। অথচ তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মাস শেষে কোনো নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি পান না। গ্লোবাল গিগ ইকোনমির এই বাস্তবতা বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। আমাদের শহরগুলোয় এখন হাজারো বাইক বা সাইকেলচালক কাজ করছেন খাবার কিংবা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাঁরা কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন।
এর পাশাপাশি আরও একটি বড় পরিবর্তন এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান। প্রশ্ন উঠেছে, এআই কি শ্রমিকের বন্ধু, না প্রতিদ্বন্দ্বী? যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে এআই কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে কাজ হারাতে পারেন। হোয়াইট-কলার পেশাগুলো যেমন হিসাবরক্ষণ, গ্রাহকসেবা, এমনকি সাংবাদিকতার কাজও এই প্রযুক্তির কারণে সংকটে পড়ছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৩ সালের ‘দ্য ফিউচার অব জবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ কাজ হারিয়ে যাবে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের কারণে। তবে একটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। যদি উৎপাদিত পণ্যের খরিদ্দার না থাকে, তাহলে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফা আসবে? আর শ্রমিক না থাকলে কিনবে কে? তবে একই সময়ে ৯ কোটি ৭০ লাখ নতুন ধরনের কাজের সৃষ্টি হতে পারে। কাজগুলো হবে ডেটা অ্যানালিটিকস, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালনা এবং সৃজনশীল ও মানবিক দক্ষতানির্ভর কাজ। এই নতুন শ্রমিকদের অবস্থার কথা ওপরে বলা হয়েছে।
কিন্তু এই নতুন কাজের মালিকানা কার হাতে? শ্রমিকদের নয়, রাষ্ট্রেরও নয়—এই ক্ষমতা এখন করপোরেট অলিগার্কদের হাতে কেন্দ্রীভূত। যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গদের মতো প্রযুক্তি ধনকুবেররা শুধু প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকই নন, তাঁরা রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছেন। করপোরেট লবিংয়ের মাধ্যমে আইন তৈরির পেছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; যেমন ট্যাক্স ছাড়, শ্রম আইন শিথিলকরণ বা প্রতিযোগিতা নীতির ধ্বংস।
বাংলাদেশেও দৃশ্যপট খুব আলাদা নয়। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাঁরা দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি। কিন্তু তাঁরা এখনো ন্যূনতম মানবিক মজুরি পান না। গত বছর শ্রমিকেরা ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি চাইলেও সরকার তা নামিয়ে ১২ হাজারে নিয়ে আসে। আন্দোলনের জবাবে আসে পুলিশি দমন, ধরপাকড়, ভয়ের পরিবেশ। মালিকেরা নতুন প্রযুক্তি বসিয়ে আরও কম শ্রমিক দিয়ে আরও বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করবেন। আগে–পরে এটা অবধারিত।
এই প্রেক্ষাপটে মে দিবস আজ আমাদের সামনে এক নতুন প্রশ্ন তোলে—শ্রমিক আসলে কে? তাঁর অধিকার কী? আর লড়াইটা কিসের জন্য?
যদি শ্রমিকের সংজ্ঞাই বদলে যায়, তাহলে লড়াইয়ের রূপও কি পাল্টাতে হবে না? একসময়ের আট ঘণ্টার কাজের দাবি এখন হয়তো পুরোনো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে বহু মানুষ এখনো দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। কেউ কাজ পাচ্ছেন না, কেউ কাজ করেও মাস শেষে ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কেউ এমন এক ধরনের ডিজিটাল শ্রম করছেন, যার নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা তাঁর নয়, তিনি জানেনই না যে কার জন্য কাজ করছেন।
তাই আজ মে দিবস শুধু অতীত স্মরণের দিন নয়—এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনারও দিন। এটি নতুন ধরনের দাবির জায়গা—ডিজিটাল শ্রমের স্বীকৃতি, গিগ-ওয়ার্কারদের অধিকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি। আর অবশ্যই আমাদের মতো দেশে গায়ে খাটা শ্রমের ন্যায্য মজুরির দাবি।
মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়, সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক, শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না।
এই সত্য যত দিন থাকবে, মে দিবস তত দিন থাকবে; নতুন প্রশ্ন নিয়ে, নতুন লড়াই নিয়ে।
জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী