দুপুরের নরম রোদে হাঁসের খামার ঘুরে দেখছিলেন সিরাজগঞ্জের খামারি আবদুস সালাম। তাঁর এক ডাকে পুকুরপাড় থেকে দৌড়ে এল একঝাঁক হাঁস। খামারে ঢুকেই বললেন, ‘১২ বছর ধরে হাঁস পালছি। এত লাভজনক জাত আগে দেখিনি।’

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার চয়ড়া গ্রামে আবদুস সালামের খামার। একসময় দেশি হাঁস পালতেন, কিন্তু মৃত্যুহার বেশি বলে লাভের মুখ দেখাটা কঠিন হয়ে উঠেছিল। সম্প্রতি পালা শুরু করেছেন নতুন জাতের হাঁস ‘বাউ-ডাক’। অভিজ্ঞতা কী, জানতে চাইলে আবদুস সালাম বলেন, ‘আগে হাঁস পালনে যা আয় করতাম, তা দিয়ে চলা কঠিন ছিল। আর এখন মাত্র ১০-১২ সপ্তাহেই দুই-আড়াই কেজি হয়ে যায় বাউ-ডাক, আর বছরে ২২০ থেকে ২৩০টি ডিম দেয়। দেশি হাঁসের তুলনায় এটাতে লাভ বেশি।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষক ২০১৪ সালে হাঁসের জাত উন্নয়নে গবেষণা শুরু করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামছুল আলম ভূঁঞার নেতৃত্বে এ গবেষণা পরিচালিত হয়।

অধ্যাপক সামছুল আলম ভূঁঞা বলেন, ‘হাঁসের ডিম ও মাংস উৎপাদনে খামারিরা যেন লাভবান হন, সে জন্যই দেশি-বিদেশি জাতের হাঁসের সংকরায়ণ নিয়ে গবেষণা হয়। গবেষণাগার ও মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা শেষে ২০২০ সালে জাতটি সরকারিভাবে অনুমোদন পায়। এরপর পল্লি কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক এনজিও মানব মুক্তি সংস্থার (এমএমএস) মাধ্যমে গবেষণাটি মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়।’

নতুন জাতটির বিষয়ে গবেষক জানান, উন্নত জাত উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি জাতের হাঁস নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। চীনের পেকিন জাতের হাঁস ও দেশি নাগেশ্বরী জাতের হাঁসের ক্রস ব্রিডিং করে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়। পেকিন হাঁস বেশি মাংস উৎপাদনকারী হলেও কেবল বদ্ধ পদ্ধতিতে টিকে থাকে। এটি দেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও পরিবেশগত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না বলে আধা-বদ্ধ বা উন্মুক্ত রাখলে দৈহিক বৃদ্ধি কম হয়। আবার ডিমও কম দেয়। অন্যদিকে দেশি নাগেশ্বরী হাঁস পরিবেশ সহনশীল হলেও মাংস উৎপাদন কম। এ সমস্যা সমাধানে দুটি জাতের সংকরায়ণ করে উদ্ভাবিত হয় ‘বাউ-ডাক’। বাউ-ডাক বদ্ধ ও উন্মুক্ত দুই জায়গাতেই সুবিধাজনক।

আরও পড়ুনসিএসইর ছাত্র মাহাবুবের খামারে এখন শতাধিক গরু-ছাগল২৬ জুন ২০২৩

উল্লাপাড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা.

শেখ এম এ মতিন বলেন, ‘বাউ-ডাক দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। ওজন দ্রুত বাড়ে, রোগবালাই কম, আর ডিমও দেয় বেশি। তাই এটি খামারিদের জন্য লাভজনক।’ পল্লি কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে খামারিরা এই হাঁস পালনে অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন। অন্যদিকে খামারিরা যেন দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন, সে জন্য মানব মুক্তি সংস্থা নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে বলে জানান মানব মুক্তি সংস্থার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মারুফ হাসান।

মাঠপর্যায়ে গবেষণার সাফল্য নিয়ে গবেষক অধ্যাপক সামছুল আলম ভূঁঞা বলেন, ‘আমাদের গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল এমন একটি উন্নত জাতের হাঁস উদ্ভাবন, যা দেশি হাঁসের মতো পরিবেশ সহনশীল হবে, আবার বিদেশি জাতের মতো বেশি মাংস ও ডিম উৎপাদন করবে। দীর্ঘ ছয় বছরের গবেষণায় আমরা সেটি করতে পেরেছি। বাউ-ডাক এখন খামারিদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে, যা আমাদের কাজেও অনুপ্রেরণা জোগায়।’

আরও পড়ুনউদ্যোক্তা থেকে যেভাবে দেশের প্রথম সফল নারী অ্যাগ্রো–ইনফ্লুয়েন্সার হলেন পপি০৮ মার্চ ২০২৫

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবনের বড় গেছো প্যাঁচা

শরতের সুন্দরবন দেখার প্রত্যয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে খুলনা থেকে ছোট্ট লঞ্চ গাংচিলযোগে শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা হলাম। কিন্তু ঢাংমারীতে লঞ্চে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় শেখেরটেক পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। কটকা ও কচিখালীর তুলনায় এখানে পর্যটকদের আনাগোনা কম। শেখেরটেকে একটি কালীমন্দির রয়েছে। মন্দিরের আশপাশে বাঘের আনাগোনা বেশি। কিন্তু আমরা এবার ‘মামা’র খোঁজে আসিনি, এসেছি দুটি বিরল পাখির সন্ধানে। তবে লঞ্চ থেকে নেমেই মামার পায়ের তাজা ছাপ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। সম্ভবত গত রাতে সে এখান দিয়ে হেঁটে গেছে।

একটি ছোট্ট বিরল পাখির খোঁজে টাওয়ারে যাওয়ার রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আছি। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। কিন্তু মুহূর্তেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মাথায় দু-তিনটি বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই পাখি খোঁজা রেখে ক্যামেরা বাঁচাতে টাওয়ারের দিকে দৌড় দিলাম। বৃষ্টি থামলে মন্দিরের দিকে গেলাম। কিন্তু বহুক্ষণ খুঁজেও দেখা পেলাম না। অথচ এর আগে অনেকেই এই দুটি স্থানে পাখিটির দেখা পেয়েছেন। কিন্তু বারবার রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরির খেলায় আমরা পাখিটি দেখতে ব্যর্থ হয়ে লঞ্চে ফিরে এলাম।

কিছুক্ষণ পর চারদিক অন্ধকার হয়ে সন্ধ্যা নামল। ক্যামেরা হাতে লঞ্চের সামনে যে যার মতো পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম নিশাচর এক বিরল পাখির খোঁজে। চারদিক সুনসান। ছোট্ট একটি ডিভাইসে পাখিটির কল (ডাক) বাজছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর শেখেরটেক খালের অন্য পাড় থেকে ডাকের প্রতি–উত্তর পাওয়া গেল। ডাকের উৎসের দিকে টর্চ ফেলে পাখিটিকে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু খুঁজে পেলাম না।

প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টার পর পাখিটির অবস্থান শনাক্ত করা গেল পন্টুনের পাশে একটি বড় গাছে। খুব সাবধানে লঞ্চ থেকে পন্টুনে নামলাম। কিন্তু পাখিটি টের পেয়ে উড়ে গিয়ে অন্য একটি গাছে বসল। বুঝতে পারলাম সে বারবার গাছ বদল করবে। কাজেই নৌকা ছাড়া ওর কাছাকাছি যাওয়া যাবে না। লঞ্চের সঙ্গে নিয়ে আসা নৌকায় উঠে পাখিটি যে গাছে বসেছে, সেদিকে গেলাম। রাত ৯টা ২৮ মিনিট ১২ সেকেন্ডে পাখিটির প্রথম ছবি তুললাম। কিন্তু মাত্র ২৯ সেকেন্ড সময় দিয়ে পাখিটি উড়াল দিল। দ্বিতীয়বার পাখিটির ছবি তুললাম রাতের খাবার সেরে আরও দুই ঘণ্টা পর ঠিক রাত ১২টায়।

সুন্দরবনের শেখেরটেকে দেখা প্যাঁচাটি এ দেশের বিরল আবাসিক পাখি বড় গেছো প্যাঁচা। ইংরেজি নাম ব্রাউন উড আউল। স্ট্রিজিডি গোত্রের প্যাঁচাটির বৈজ্ঞানিক নাম Strix leptogrammica। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, চীনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই পাওয়া যায়।

বড় গেছো প্যাঁচা বড় মাথা-চোখ, খাটো ঘাড় ও চওড়া ডানার পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক প্যাঁচার দৈর্ঘ্য ৩৯ থেকে ৫৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৮০০ থেকে ১ হাজার ১০০ গ্রাম। কাঁধে চিকন সাদা ডোরাসহ দেহের ওপরটা ঘন বাদামি বা খয়েরি। দেহের নিচটা হলদে-সাদা ও তাতে থাকে সরু বাদামি ডোরা। মুখমণ্ডলের গোলক ডাম্বেল আকারের। গোলকের প্রান্ত কালো। এ দেশে পাখিটির যে উপপ্রজাতিটি দেখা যায়, তার মুখমণ্ডল গাঢ় বাদামি বা খয়েরি, ভ্রু সুস্পষ্ট ও সাদা এবং ঘাড়ের সামনের অংশে সুস্পষ্ট সাদা বন্ধনী দেখা যায়। চোখ হলদে। চঞ্চু ফ্যাকাশে নীলচে ও পা ফ্যাকাশে বাদামি। প্যাঁচা ও পেঁচীর চেহারা একই রকম।

সুন্দরবন ছাড়াও ওরা সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং ঢাকা বিভাগের পত্রঝরা বনের বাসিন্দা। অত্যন্ত লাজুক ও নিশাচর পাখিগুলোকে একাকী বা জোড়ায় দেখা যায়। দিনে বনের উঁচু কোনো গাছের ঘন পাতার আড়ালে বসে বিশ্রাম করে। ভোর ও সন্ধ্যায় উঁচু গাছ বা জায়গা থেকে মাটিতে বা পানিতে শিকার খোঁজে ও পায়ের তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে ইঁদুর, ছোট পাখি, সরীসৃপ ইত্যাদি শিকার করে খায়। নিচু কণ্ঠে ও গভীরভাবে ‘টু...হুও...’ বা ‘উ...হুও...’ শব্দে ডাকে।

জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে প্রজনন করে। সচরাচর গাছের গর্তে কাঠিকুটি ও ঝরা পালক বিছিয়ে বাসা বানায়। পেঁচী তাতে দুটি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। প্রায় ৩০ দিন তা দিয়ে ছানা ফোটায়। সচরাচর পেঁচী ডিমে তা দেয় ও প্যাঁচা ডিমে তা–দানরত পেঁচী ও পরে ছানাদের খাওয়ায়। ছানারা প্রায় দেড় মাসে উড়তে শেখে। তবে এরপরও বেশ কয়েক মাস বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। আয়ুষ্কাল প্রায় ১০ বছর।

আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিদেশিদের বন্দর দেওয়ার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হবে
  • একা বাস করতে পারে যে পাখি
  • সুন্দরবনের বড় গেছো প্যাঁচা