তুরস্কে যখন রোজা রাখা নিষিদ্ধ ছিল
Published: 20th, March 2025 GMT
একটা সময় তুরস্কে রোজা রাখা কঠোর ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সংঘর্ষের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। মসজিদগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে রোজাকে পশ্চাৎপদতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে বহু মানুষ রোজা গোপনে রাখতে বাধ্য হন।
রমজান ছিল তুর্কিদের জীবনে গভীরভাবে প্রোথিত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই ঐতিহ্য লালন করে এসেছে। এরপর একসময় না সমাজ সেসব বাধা পেরিয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছায়। এখন তুরস্কে রমজান সর্বজনীন সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। কেমন ছিল সেই বিধিনিষেধের সময়টি, কীভাবে আবার ফিরে এল রমজানের আবহ, আসুন দেখা যাক।
নিষেধের সূচনা
১৯২৩ সালে তুর্কি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হলে ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্কে নতুন মোড় আসে। পরের বছর মার্চ ১৯২৪ সালে মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে উসমানীয় খিলাফত বিলুপ্ত করেন। জনজীবনে ইসলামের উপস্থিতি আরও কমিয়ে আনতে আরও নানা পদক্ষেপ নেয়। ইসলামি আইন ও ধর্মীয় বিষয় পরিচালনা নিয়োজিত থাকা ওয়াকফ মন্ত্রণালয় বন্ধ হয় এবং শরিয়া আদালত বিলুপ্ত করা হয়। এই পদক্ষেপ কার্যত ধর্ম ও রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ পৃথক করার নীতির একটি ভিত্তি তৈরি করে। ‘শিক্ষা ঐক্য আইন’ প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুনমস্কোয় রমজান: ইফতারে ভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মিলন১৪ মার্চ ২০২৫১৯২৬ সালে তুর্কি সরকার হিজরি বর্ষপঞ্জি বাতিল করে। এর ফলে রমজানসহ অন্যান্য ইসলামি উৎসব ও গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো সরকারি ক্যালেন্ডার থেকে বাদ পড়ে এবং রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মীয় মৌসুমগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইসলামি ইতিহাসবিদ বেনিয়ামিন কোজা ওগলুর একটি গবেষণা অনুসারে, তুর্কি প্রজাতন্ত্রের শুরুর বছরগুলোতে সরকার রোজা আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করেনি, তবে পরোক্ষ বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, যা প্রকাশ্যে রোজা রাখা অসম্ভব করে তোলে।
১৯২৭ সালের রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণাগারের দলিল অনুযায়ী, তখনকার সরকারি অফিসগুলোতে দায়িত্ব পালনকালে রোজা রাখা ধর্মীয় কঠোরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। এমনকি কিছু মন্ত্রণালয় নিজেদের অভ্যন্তরীণ নির্দেশিকায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে— ‘কর্মস্থলে রোজা রাখার বিষয়টি আধুনিক প্রজাতন্ত্রের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
অনেক দপ্তরের ব্যবস্থাপকগণ তাদের কর্মচারীদের প্রকাশ্যে খাবার খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন। তারা মধ্যাহ্নভোজের সময় গুরুত্বপূর্ণ সভার আয়োজন করতেন, যাতে রোজাদার কর্মীদের বিব্রত করা যায় এবং রোজা ভাঙতে বাধ্য করা হয়।
আরও পড়ুনরমজানে কেন বিষণ্নতা আসে১৩ মার্চ ২০২৫শিক্ষা ও সামরিক ক্ষেত্রে কঠোরতা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই নিষেধাজ্ঞা আরও স্পষ্টভাবে প্রয়োগ করা হয়, বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে। সিভাস ও এরজিঞ্জান অঞ্চলের বাসিন্দারা জানান, অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে প্রকাশ্যে পানি পান করতে বলতেন, যাতে তারা প্রমাণ করতে পারে যে, তারা রোজা রাখেনি। এর পেছনে যুক্তি দেওয়া হতো যে—’শিক্ষার জন্য শারীরিক ও মানসিক শক্তির প্রয়োজন।’
সেনাবাহিনীতে নীতিগুলো ছিল আরও কঠোর এবং সুসংগঠিত। ১৯৩১ সালের সামরিক সংরক্ষণাগারের নথি থেকে জানা যায়, সামরিক কর্মকর্তারা খাবারের সময় সৈন্যদের পর্যবেক্ষণ করতেন। কোনো সেনাকে না খেতে দেখলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হতো এবং, সৈন্যদের ‘প্রজাতন্ত্রের সামরিক চেতনার সঙ্গে একীভূত হতে না পারার’ অভিযোগে অভিযুক্ত করা হতো। অনেক সৈন্য প্রকাশ্যে খাবার খেতেন শুধুমাত্র শাস্তির ভয় থেকে। অনেকে বিশ্রামের সময় গোপনে রোজা রাখার চেষ্টা করতেন।
আরও পড়ুনপশ্চিমা গবেষকদের রমজানের অভিজ্ঞতা১২ মার্চ ২০২৫১৯৩০-এর দশকে এই দমননীতি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। কেবলমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং মসজিদ, আজান ও রমজানের ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতির ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তুরস্কের প্রধান পত্রিকা ‘জমহুরিয়াত’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, তৎকালীন প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাহরির সময় ঢাক বাজানোর ঐতিহ্যকে ‘প্রজাতন্ত্রের আধুনিক চেতনার পরিপন্থী’ বলে ঘোষণা করা হয় এবং এটি নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানানো হয়; যা রমজানের বহু ঐতিহ্যিক রীতি পরিবর্তিত হতে থাকে, যা তুরস্কে ইসলাম ও রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্বের ভিত্তি গড়ে তোলে।
জমহুরিয়াত-এর তথ্যমতে, ওই সময়ের আগে উসমানীয় যুগে রমজানে দুপুরের খাবারের সময় ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকলেও ১৯২৮ সালের পর সেগুলো রোজার সময়ও খোলা থাকত।
পরিচয়ের পুনর্জাগরণ
ইসলামি ইতিহাসবিদ ফওজি ইয়ালতিন ব্যাখ্যা করেছেন যে, তুরস্কে ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃত পরিবর্তন শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকে, যখন বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনরায় কার্যকর হয় এবং সরকার ধর্মীয় বিধিনিষেধ শিথিল করতে শুরু করে। ১৯৫০ সালের নির্বাচনে আদনান মেনদেরেসের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্রেটিক পার্টির বিজয় এই পরিবর্তনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ক্ষমতায় এসে তার প্রথম সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি ছিল, আরবি ভাষায় আজান পুনর্বহাল করা। এই পদক্ষেপটি শুধুমাত্র ধর্মীয় নয়, বরং প্রতীকীভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এটি রক্ষণশীল তুর্কি সমাজের কাছে স্পষ্ট বার্তা দেয় যে, রাষ্ট্র ও ইসলামি সংস্কৃতির মধ্যে যে বিচ্ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে। রোজা ও রমজানের সংকোচ কেটে যায় এবং আবার রমজানের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিগুলো ফিরে আসে।
গবেষক ইয়ালতিনের মতে, তুরস্কের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, ধর্মীয় দমননীতি কখনোই সমাজে ধর্মের প্রভাব কমাতে পারে না; বরং এটি জনগণকে তাদের বিশ্বাসের প্রতি আরও দৃঢ় করে তোলে।
সূত্র: আলজাজিরা ডট নেট
আরও পড়ুনজার্মানিতে রমজান: বৈচিত্র্যে খাপ খাইয়ে নেওয়া১১ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: রমজ ন র সরক র ইসল ম র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের হামলায় ২০ ইসরায়েলি নিহত
ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের পাল্টাপাল্টি হামলা চারদিন ধরে চলছে। এসব হামলায় উভয় দেশের মধ্যে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ইসরায়েলের জাতীয় পরিষেবা জানিয়েছে, আজ সোমবার ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গত শুক্রবার থেকে আজ সোমবার পর্যন্ত ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা ২০ জনে পৌঁছুল। আজ সোমবার এ তথ্য জানিয়েছে বিবিসি।
অন্যদিকে আল-জাজিরা বলছে, ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় রোববার পর্যন্ত ইরানে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২২৪ জনে পৌঁছেছে।
ইসরায়েলের জাতীয় জরুরি পরিষেবার প্রধান ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডমের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, মধ্য ইসরায়েলজুড়ে ইরানের হামলায় চারজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুইজন নারী।
এর আগে সিএনএন ইসরায়েলের ১৫ জন নিহত হওয়ার খবর দেয়। ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম কানের খবর বলছে, বন্দরনগরী হাইফায় অন্তত দুইজন আহত হয়েছেন। এছাড়া, তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন।
রোববার ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানায়, ইরান থেকে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়েছে। একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছে ইসরায়েল। বর্তমানে হামলা প্রতিহত করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে আইডিএফ।
আজ সিএনএনের এক খবরে বলা হয়েছে, তেল আবিব ও জেরুজালেমসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে জরুরি সতর্ক সংকেত (সাইরেন) বাজতে শুরু করেছে। আইডিএফ সতর্ক করে বলেছে, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি অভেদ্য নয়।
সিএনএনের একজন প্রযোজক জেরুজালেমে সাইরেন এবং একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। তার তোলা ভিডিওতে আকাশে বহু ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে যেতে দেখা গেছে।
ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবা সংস্থা ম্যাগেন ডেভিড আদোম জানিয়েছে, তাদের দলগুলো আক্রান্ত এলাকার দিকে রওনা দিয়েছে।
সারা দেশের নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে ঢুকতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকার আহ্বান জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেছে, বর্তমানে বিমানবাহিনী হামলা প্রতিহত করার পাশাপাশি পাল্টা হামলা চালানোর কাজ করছে।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট নিউজ জানিয়েছে, মধ্য ইসরায়েলের পেতাহ টিকভা শহরের একটি ভবনে একটি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে। হামলার ফলে ওই স্থানে আগুন ধরে যায়। তবে এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
এদিকে মধ্য ইরানে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির সেনাবাহিনী এ তথ্য জানিয়েছে। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর দাবি, বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সফলভাবে মধ্য ইরানে অবস্থিত একাধিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। আমাদের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এসব স্থাপনা থেকে ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হচ্ছিল।’
তবে ইসরায়েলের এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান এখনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।
এদিকে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় রোববার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২২৪ জনে পৌঁছেছে।
বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক। হামলায় ১ হাজার ২৭০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
এপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ১৩ জুন ইরানে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ওই হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ ও ইসফাহান অঞ্চলের পারমাণবিক স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। ইরানে বর্তমানে মসজিদ ও মেট্রো স্টেশনগুলোকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের তিন শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন। রোববার ইসরায়েল সরকারের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ বলেছে, এছাড়া ইরানের হামলায় কমপক্ষে ৩৮৫ জন আহত হয়েছেন, যার মধ্যে সাত জনের অবস্থা গুরুতর।
এদিকে ইসরায়েলি পুলিশের বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, তেল আবিবের দক্ষিণে অবস্থিত বাত ইয়াম শহরে ৬ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। এছাড়া সাতজন এখনও নিখোঁজ। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন জরুরি সেবাদানকারীরা।