বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্মে দণ্ডের বিধানের বৈধতা নিয়ে রিট
Published: 7th, April 2025 GMT
বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্মের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দণ্ডনীয় হবেন—নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যুক্ত করা এমন বিধানের বৈধতা নিয়ে রিট হয়েছে। এ–সংক্রান্ত বিধানটি সংবিধানের সঙ্গে কেন সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, এ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়েছে রিটে।
‘এইড ফর ম্যান ফাউন্ডেশনের’ পক্ষে সংগঠনের সেক্রেটারি এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো.
২০০৮ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনটি সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আইনে সংশোধনী আনা হয়। চলতি বছরের ২৫ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয়।
অধ্যাদেশের ৫ ধারায় বলা হয়, ওই আইনের ধারা ৯ক এর পর নতুন ধারা ৯খ সন্নিবেশিত হবে। আর ৯খ ধারায় বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম করলে দণ্ডের বিষয়ে বলা আছে। এর ভাষ্য, যদি কোনো ব্যক্তি দৈহিক বলপ্রয়োগ ছাড়া বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ১৬ বছরের বেশি বয়সের কোন নারীর সঙ্গে যৌনকর্ম করেন এবং যদি ওই ঘটনার সময় ওই ব্যক্তির সঙ্গে ওই নারীর আস্থাভাজন সম্পর্ক থাকে, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
২০২৫ সালের অধ্যাদেশের ৫ ধারার মাধ্যমে সন্নিবেশিত ৯খ ধারার বৈধতা নিয়ে মূলত রিটটি করা হয়েছে বলে জানান রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী ইশরাত হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক অপরাধ হিসেবে ৯খ ধারায় বলা হয়েছে, যা মূল আইনে ছিল না। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করার পর, তা না রাখলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাত বছরের দণ্ড হবে বলা হয়েছে। শুধু ‘বিয়ের প্রতিশ্রুতি’ না রাখার কারণে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলে তা ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নারীর সম্মতির অধিকার লঙ্ঘন করে। প্রতিশ্রুতি না রাখার কারণে শুধু লিঙ্গের ভিত্তিতে একজনকে অপরাধী এবং অপরজনকে অপরাধী হিসেবে গণ্য না করার সুযোগ নেই। সংবিধান অনুসারে আইনের চোখে সবাই সমান। যখন ঘটনা ঘটছে, তখন তা অপরাধ নয়, পরবর্তী সময়ে প্রতিশ্রুতি না রাখলে তা অপরাধ হিসেবে দেখা হয়েছে বিধানটিতে। এমন অনুমান বা ধারণার ভিত্তিতে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না।
আরও পড়ুনধর্ষণ মামলার জট কমাতে ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম’ আলাদা ধারা করা হয়েছে২৮ মার্চ ২০২৫রিটের আবেদনে দেখা যায়, ২০২৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশের ৫ ধারার মাধ্যমে সন্নিবেশিত ৯খ ধারা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, এ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে রিটে।
আরও পড়ুন‘বিয়ের প্রলোভনে যৌন সম্পর্ক’ কি শুধু পুরুষেরই অপরাধ২৩ মার্চ ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য নকর ম অপর ধ বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
মুহাম্মদ ইলিয়াসের তাবলিগি দর্শন
মানুষের হৃদয়ে ঈমানের আগুন জ্বালানোর প্রয়াসে শায়খ মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (১৮৮৫-১৯৪৪) গড়ে তুলেছিলেন জামায়াতে তাবলিগ, যা বিশ্বব্যাপী দাওয়াতের এক অপূর্ব নজির। তাঁর বাণী ও উপদেশের সংকলন ‘মালফুজাত’ নামে আরবি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে, যা তাঁর দাওয়াতি দর্শন ও তরবিয়তি পদ্ধতির এক জীবন্ত দলিল। দামেস্কের দারুল কলম থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থ, শায়খ আদিল হাররাজি আল-ইয়ামানি আন-নাদভির তত্ত্বাবধানে সম্পাদিত, তাবলিগ জামায়াতে মূল দর্শনের প্রাথমিক উৎস হিসেবে বিবেচিত। এটি শুধু মুহাম্মদ ইলিয়াসের বাণীর সংকলন নয় বরং একটি ঐতিহাসিক ও দাওয়াতি দলিল, যা আধুনিক ইসলামি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে।
‘মালফুজাত’-এর শিক্ষা
শায়খ মুহাম্মদ ইলিয়াসের মজলিস মালফুজাত সংরক্ষণ করেছেন তাঁর শিষ্য মুহাম্মদ মানজুর। তাবলিগ জামায়াতে ছয়টি মূলনীতি—কালিমা, নামাজ, ইলম ও জিকর, ইকরামুল মুসলিমিন, ইখলাস ও নিয়ত এবং আল্লাহর পথে বের হওয়ার ভিত্তিতে গ্রন্থটি রচিত। তিনি তাওহিদকে (আল্লাহর একত্ব) নাজাতের মূল ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তাওহিদের দুর্বলতা মুসলিমদের অধঃপতনের কারণ’। তিনি ফরজ ইবাদতের প্রাধান্য, জিকিরের প্রাচুর্য এবং তাকওয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফরজগুলোর মর্যাদা নফলের চেয়ে অনেক উঁচুতে। নফলের উদ্দেশ্য ফরজগুলোর ঘাটতি পূরণ করা’ (মালফুজাত, দারুল কলম, ২০২৫)।
তাঁর দাওয়াতি পদ্ধতি ছিল সরল কিন্তু গভীর। তিনি আল্লাহর পথে বের হওয়াকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যম হিসেবে দেখতেন, যা তাবলিগের একটি বৈশিষ্ট্য। তিনি রিয়া (লোকদেখানো) ও বিতর্ক এড়ানোর পরামর্শ দেন, বলেন, ‘ইখলাস (খাঁটি আল্লাহর জন্য) ছাড়া কোনো কাজ কবুল হয় না।’ তাঁর দৃষ্টিতে, দাওয়াতের লক্ষ্য হলো আল্লাহর আদেশকে মানুষের স্বভাবে পরিণত করা, যাতে নিষিদ্ধ কাজ তার কাছে অপছন্দনীয় হয়। তিনি জিকিরকে এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রধান উপায় হিসেবে বিবেচনা করতেন।
শায়খ ইলিয়াসের দাওয়াতি পদ্ধতি ছিল তাওয়াজ্জুহ বা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের পরিবর্তে তাজকিয়া (আত্মশুদ্ধি) ও ইখলাসের ওপর কেন্দ্রীভূত। তিনি জটিল তাত্ত্বিক আলোচনার পরিবর্তে সরল নসিহতের ওপর জোর দিতেন। তাঁর মতে, দাওয়াত হবে এমন, যেন ‘আল্লাহর আদেশ মানুষের স্বভাব হয়ে যায়’। তিনি আল্লাহর পথে বের হওয়াকে তুলনা করতেন সাহাবিদের ত্যাগের সঙ্গে, যা দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক উন্নতি আনে। তিনি বলেন, ‘দাওয়াতে আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার ফরজ, কিন্তু কতজন এই ফরজ পালন করে?’ (মালফুজাত, দারুল কলম, ২০২৫)।
আরও পড়ুনসুরা হুমাজাতে চারটি পাপের শাস্তির বর্ণনা০৬ মে ২০২৫ঐতিহাসিক পটভূমি
মুহাম্মদ ইলিয়াস ভারতের কান্ধলায় একটি আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দেওবন্দি সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে তাঁর শৈশব কাটে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, সাধারণ মুসলিমদের ধর্মীয় অজ্ঞতা এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ তাঁর দাওয়াতি চিন্তার পটভূমি। তিনি বিশ্বাস করতেন, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মুসলিমদের সংস্কার করতে পারবে না। তাই তিনি একটি জনগণভিত্তিক, বিকেন্দ্রীকৃত আন্দোলন শুরু করেন, যেখানে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা দাওয়াতে অংশ নেয়। তিনি নবীর (সা.) মক্কার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হন, যেখানে তিনি ঘুরে ঘুরে মানুষকে দাওয়াত দিতেন। তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) মক্কায় তাওয়াফ করে মানুষকে হকের দাওয়াত দিতেন’ (মালফুজাত, দারুল কলম, ২০২৫)।
গ্রন্থের গঠন ও সম্পাদনা
মালফুজাত তাঁর মজলিসের সংকলন হলেও এটি একটি সুশৃঙ্খল দাওয়াতি দলিল। সম্পাদনা করেছেন আবুল হাসান আলী নাদভি (রহ.)-এর শিষ্য শেখ আদিল হাররাজি। মুফতি মুহাম্মদ তকী উসমানী, ড. খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানি ও নূরুল হাসান রাশিদ কান্ধলভী প্রমুখের মতো পাকিস্তান ও ভারতের শীর্ষস্থানীয় ইসলামবেত্তাদের ভূমিকা গ্রন্থটিকে মহামূল্য করে তুলেছে। তাদের ভূমিকাগুলো গ্রন্থের দাওয়াতি ও ঐতিহাসিক পটভূমি বুঝতে সাহায্য করবে। আলী নাদভির সঙ্গে মুহাম্মাদ ইলিয়াসের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক এবং তাবলিগের বিশ্বব্যাপী প্রভাবও এতে তুলে ধরা হয়েছে।
আজ যখন মুসলিম বিশ্ব নানা সংকটের মুখোমুখি, এই গ্রন্থ আমাদের তাওহিদ, ইখলাস ও তাজকিয়ার প্রতি ফিরে যেতে আহ্বান জানায়। এটি প্রতিটি দাঈ ও মুসলিমের জন্য একটি পাঠ্য, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ‘দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনকে জীবন্ত করে তুলতে হবে।’
সূত্র: আল-জাজিরা ডটনেট
আরও পড়ুন সুরা ইউসুফের সারকথা১৫ জুলাই ২০২৪