এ বছর ১ মার্চ প্রথম আলোতে ‘ওষুধের কাঁচামাল তৈরির শিল্প দাঁড়াতে পারেনি’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংবাদে বলা হয়েছিল, ওষুধশিল্পে পরনির্ভরতা কমাতে কাঁচামাল দেশেই তৈরি করতে হবে। এর জন্য জোরালো নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা প্রয়োজন।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য খাতবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন তৈরি করছে, তাতে ওষুধের কাঁচামাল দেশে বেশি পরিমাণে উৎপাদনের বিষয়টিকে স্থান দেওয়া হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো.

সায়েদুর রহমান এই শিল্পের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশ ওষুধশিল্পে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে এতকাল যে দাবি করা হচ্ছিল, গত কয়েক মাসের আলোচনায় সেই মিথ অনেকটাই ভেঙে গেছে। কারণ, বাংলাদেশের ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আমদানিনির্ভর।এই কাঁচামাল মূলত আসে চীন ও ভারত থেকে। ইউরোপ থেকে কাঁচামাল আমদানি হলেও পরিমাণে কম। দেশে কাঁচামাল তৈরি হয় প্রয়োজনের মাত্র ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ওষুধ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলে আমদানিনির্ভর কাঁচামাল দিয়ে তা সম্ভব না। বাংলাদেশকে ওষুধের কাঁচামাল দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি কমাতে হবে। এটা যে সম্ভব, তা আমরা ওষুধশিল্প দেখেই অনুধাবন করতে পারি। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি ওষুধশিল্পকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। আমাদের আত্মনির্ভরতা আরও অটুট হবে যদি আমরা ওষুধের কাঁচামাল তৈরির ক্ষেত্রেও উদ্যোগী হই, স্বাবলম্বী হয়ে উঠি।

এটা সম্ভব। এর উদাহরণ চীন ও ভারত। এই দুটি দেশ নিজেরাই একসময় ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করত ইউরোপ থেকে। এখন নিজেরাই কাঁচামালে স্বয়ংসম্পূর্ণ শুধু না, আমাদের মতো বিশ্বের বহু দেশে তারা তা রপ্তানি করছে।

ওই দুটি দেশ কী করেছে, তা আমরা জানার চেষ্টা করেছি। সেটি বর্ণনা করার আগে ওষুধের কাঁচামাল আসলে কী, তা অতি সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। হয়তো অনেকের কাছেই বিষয়টি জানা, অনেকের কাছেই অজানা। প্রথম আলো যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তারই পুনরুক্তি করছি। ওষুধে দুই ধরনের উপাদান থাকে। মূল কাঁচামাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই)। অন্যটি সহযোগী নিষ্ক্রিয় উপাদান (এক্সিপিয়েন্ট)। প্যারাসিটামল বড়ির এপিআই-এর নাম ‘প্যারাএসাইটাল অ্যামাইনোফেনাল’। এটাই মানুষের শরীরে কাজ করে। তবে প্যারাসিটামল বড়িতে যে সেলুলোজ, ট্যালকসহ কিছু জিনিস থাকে, সেগুলোকে বলে এক্সিপিয়েন্ট; এগুলো বড়ির আকার দিতে, বড়ি মানুষের শরীরে দ্রবীভূত হতে সহায়তা করে। এক্সিপিয়েন্ট শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখায় না। আমরা ‘প্যারাএসাইটাল অ্যামাইনোফেনাল’-এর মতো বহু ধরনের ওষুধের এপিআই শিল্প গড়ে তোলা ও বিকাশের কথা বলছি।

চীন কী করেছিল

চীনের শুরুটাই লম্বা সময় ধরে, ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে। তখন রাষ্ট্রীয় কারখানাগুলো ওষুধ উৎপাদনের ভিত তৈরি করে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক সংস্কারের সময় দেং শিয়াওপিং বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা বা স্পেশাল ইকোনমিক জোন তৈরি করলেন। এতে বিনিয়োগের দরজা খুলল, বেসরকারি কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণে এপিআই তৈরি শুরু করল। এই এপিআই চীনের ওষুধ কোম্পানিতে ব্যবহারের পাশাপাশি রপ্তানি শুরু হলো।

২০০০ সালে চীন তাদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ওষুধে স্বনির্ভরতার ওপর জোর দেয়। ২০০৮ সালে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ওষুধ গবেষণা ও উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করে। ‘থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস’ কর্মসূচির মাধ্যমে বিদেশে থাকা বিজ্ঞানীদের দেশে ফিরিয়ে আনে, এদের একটি অংশ ওষুধ ও এপিআই শিল্প বিকাশে কাজ শুরু করে। সরকার সস্তায় জমি, বিদ্যুৎ আর জ্বালানি সহায়তা দেয়।

চীন সরকার এপিআই রপ্তানিকারকদের কর ছাড় দিয়েছে, ১৩ শতাংশ ভ্যাট ফেরত দিয়েছে। পাশাপাশি স্বল্প সুদে ঋণও দিচ্ছে। রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণকারী প্রতিষ্ঠান পুরস্কার হিসেবে অর্থ পেয়েছে। ২০১৩ সালের যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিবেদন বলছে, চীনা মুদ্রার মান ২৮ শতাংশ কম রাখা হয়েছিল, এতে আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের পণ্য সস্তায় পাওয়া যেত। সারা বিশ্বের ৪০ শতাংশ এপিআই এখন চীন রপ্তানি করে।

ভারতের অভিজ্ঞতা

স্বাধীনতার পর ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভারত নিজের শিল্পকে বাঁচিয়েছে। এতে স্থানীয় কোম্পানিগুলো ওষুধ তৈরিতে দক্ষ হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের পেটেন্ট আইনে শুধু প্রক্রিয়া (প্রোসেস) পেটেন্ট মানা হতো, পণ্য (প্রোডাক্ট) পেটেন্ট নয়। তার ফলে ভারতীয় কোম্পানিগুলো বিদেশি ওষুধের জেনেরিক সংস্করণ তৈরি করতে পারল, যা এপিআই খাতকে বাড়িয়ে দেয়।

ভারত ২০২০ সাল প্রোডাকশন-লিংক্ড ইনসেনটিভ (পিএলআই) স্কিম চালু করে। এই স্কিমের মাধ্যমে নির্দিষ্ট এপিআই তৈরিতে ১২ শতাংশ এবং ফারমেন্টেশন পণ্যে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হয়। পরিবেশ ছাড়পত্র দ্রুত দেওয়া, বিদ্যুৎ-পানির খরচও কমানো হয়। এতে ভারতের এপিআই শিল্প বিকশিত হতে পেরেছে।

ভারত ও চীন দুটি দেশই এপিআই শিল্পে সহজে ও কম সুদে ঋণ দিচ্ছে, গবেষণার জন্য অর্থ দিচ্ছে এবং অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করেছে। চীনে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক কম সুদে ঋণ দেয়। ভারতে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা সহজে অর্থ পায়।

বাংলাদেশের পথ কী

প্রয়াত শ্রদ্ধেয় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য দেশে প্রথম এপিআই তৈরি করে। এখন ক্ষুদ্র পরিসরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গুটিকয় ওষুধের এপিআই তৈরি করছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের দিকে আঙুল না তুলেই বলছি, প্রবল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এপিআই শিল্পের দিকে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের মনোযোগের ঘাটতি ছিল। আজও কম।

প্রথম কাজ হবে, দেশে যাঁরা ওষুধ তৈরি করছেন, তাঁদের কাছে এপিআই সহজলভ্য করা। আমদানি করে নয়, নিজেরা উৎপাদন করে। এ জন্য ট্যাক্স ছাড়, ভর্তুকি বা প্রশাসনিক সুবিধা যা প্রয়োজন, ব্যবসায়ীদের তা দিতে হবে। কতটুকু কী দিতে হবে, তা নিয়ে মুক্তমনে আলোচনা হতে হবে। সরকার প্রথম চার বা পাঁচ বছর সহায়তা অব্যাহত রাখলে এ শিল্প দাঁড়াবেই।

স্বাধীনতার দ্বিতীয় দশকে দেশে ওষুধশিল্প বিকাশের সময় অনেকেই ধারণা করতে পারেননি যে বাংলাদেশ ওষুধের মতো পণ্য রপ্তানি করার সামর্থ্য দেখাতে পারে। কিন্তু পেরেছে। বাংলাদেশ এপিআই রপ্তানিও করতে পারবে। উদাহরণ আছে। চীন ও ভারতের সরকারের মতো বাংলাদেশ সরকারও নীতি সহায়তা ও আর্থিক সুবিধা নিয়ে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াক। এটাই ঠিক সময়।

এস এম সাইফুর রহমান সভাপতি, বাংলাদেশ এপিআই অ্যান্ড ইন্টারমেডিয়েটারিস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র ভর প রথম সরক র আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক

অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।

বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক। 

আরো পড়ুন:

রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী

‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত

সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের  প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।

জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে  বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।

লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ