ওষুধ নিরাপত্তায় দরকার এপিআই শিল্পের বিকাশ
Published: 13th, April 2025 GMT
এ বছর ১ মার্চ প্রথম আলোতে ‘ওষুধের কাঁচামাল তৈরির শিল্প দাঁড়াতে পারেনি’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংবাদে বলা হয়েছিল, ওষুধশিল্পে পরনির্ভরতা কমাতে কাঁচামাল দেশেই তৈরি করতে হবে। এর জন্য জোরালো নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা প্রয়োজন।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য খাতবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন তৈরি করছে, তাতে ওষুধের কাঁচামাল দেশে বেশি পরিমাণে উৎপাদনের বিষয়টিকে স্থান দেওয়া হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো.
বাংলাদেশ ওষুধ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলে আমদানিনির্ভর কাঁচামাল দিয়ে তা সম্ভব না। বাংলাদেশকে ওষুধের কাঁচামাল দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি কমাতে হবে। এটা যে সম্ভব, তা আমরা ওষুধশিল্প দেখেই অনুধাবন করতে পারি। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি ওষুধশিল্পকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। আমাদের আত্মনির্ভরতা আরও অটুট হবে যদি আমরা ওষুধের কাঁচামাল তৈরির ক্ষেত্রেও উদ্যোগী হই, স্বাবলম্বী হয়ে উঠি।
এটা সম্ভব। এর উদাহরণ চীন ও ভারত। এই দুটি দেশ নিজেরাই একসময় ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করত ইউরোপ থেকে। এখন নিজেরাই কাঁচামালে স্বয়ংসম্পূর্ণ শুধু না, আমাদের মতো বিশ্বের বহু দেশে তারা তা রপ্তানি করছে।
ওই দুটি দেশ কী করেছে, তা আমরা জানার চেষ্টা করেছি। সেটি বর্ণনা করার আগে ওষুধের কাঁচামাল আসলে কী, তা অতি সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। হয়তো অনেকের কাছেই বিষয়টি জানা, অনেকের কাছেই অজানা। প্রথম আলো যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তারই পুনরুক্তি করছি। ওষুধে দুই ধরনের উপাদান থাকে। মূল কাঁচামাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই)। অন্যটি সহযোগী নিষ্ক্রিয় উপাদান (এক্সিপিয়েন্ট)। প্যারাসিটামল বড়ির এপিআই-এর নাম ‘প্যারাএসাইটাল অ্যামাইনোফেনাল’। এটাই মানুষের শরীরে কাজ করে। তবে প্যারাসিটামল বড়িতে যে সেলুলোজ, ট্যালকসহ কিছু জিনিস থাকে, সেগুলোকে বলে এক্সিপিয়েন্ট; এগুলো বড়ির আকার দিতে, বড়ি মানুষের শরীরে দ্রবীভূত হতে সহায়তা করে। এক্সিপিয়েন্ট শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখায় না। আমরা ‘প্যারাএসাইটাল অ্যামাইনোফেনাল’-এর মতো বহু ধরনের ওষুধের এপিআই শিল্প গড়ে তোলা ও বিকাশের কথা বলছি।
চীন কী করেছিলচীনের শুরুটাই লম্বা সময় ধরে, ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে। তখন রাষ্ট্রীয় কারখানাগুলো ওষুধ উৎপাদনের ভিত তৈরি করে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক সংস্কারের সময় দেং শিয়াওপিং বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা বা স্পেশাল ইকোনমিক জোন তৈরি করলেন। এতে বিনিয়োগের দরজা খুলল, বেসরকারি কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণে এপিআই তৈরি শুরু করল। এই এপিআই চীনের ওষুধ কোম্পানিতে ব্যবহারের পাশাপাশি রপ্তানি শুরু হলো।
২০০০ সালে চীন তাদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ওষুধে স্বনির্ভরতার ওপর জোর দেয়। ২০০৮ সালে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ওষুধ গবেষণা ও উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করে। ‘থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস’ কর্মসূচির মাধ্যমে বিদেশে থাকা বিজ্ঞানীদের দেশে ফিরিয়ে আনে, এদের একটি অংশ ওষুধ ও এপিআই শিল্প বিকাশে কাজ শুরু করে। সরকার সস্তায় জমি, বিদ্যুৎ আর জ্বালানি সহায়তা দেয়।
চীন সরকার এপিআই রপ্তানিকারকদের কর ছাড় দিয়েছে, ১৩ শতাংশ ভ্যাট ফেরত দিয়েছে। পাশাপাশি স্বল্প সুদে ঋণও দিচ্ছে। রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণকারী প্রতিষ্ঠান পুরস্কার হিসেবে অর্থ পেয়েছে। ২০১৩ সালের যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিবেদন বলছে, চীনা মুদ্রার মান ২৮ শতাংশ কম রাখা হয়েছিল, এতে আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের পণ্য সস্তায় পাওয়া যেত। সারা বিশ্বের ৪০ শতাংশ এপিআই এখন চীন রপ্তানি করে।
ভারতের অভিজ্ঞতাস্বাধীনতার পর ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভারত নিজের শিল্পকে বাঁচিয়েছে। এতে স্থানীয় কোম্পানিগুলো ওষুধ তৈরিতে দক্ষ হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের পেটেন্ট আইনে শুধু প্রক্রিয়া (প্রোসেস) পেটেন্ট মানা হতো, পণ্য (প্রোডাক্ট) পেটেন্ট নয়। তার ফলে ভারতীয় কোম্পানিগুলো বিদেশি ওষুধের জেনেরিক সংস্করণ তৈরি করতে পারল, যা এপিআই খাতকে বাড়িয়ে দেয়।
ভারত ২০২০ সাল প্রোডাকশন-লিংক্ড ইনসেনটিভ (পিএলআই) স্কিম চালু করে। এই স্কিমের মাধ্যমে নির্দিষ্ট এপিআই তৈরিতে ১২ শতাংশ এবং ফারমেন্টেশন পণ্যে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হয়। পরিবেশ ছাড়পত্র দ্রুত দেওয়া, বিদ্যুৎ-পানির খরচও কমানো হয়। এতে ভারতের এপিআই শিল্প বিকশিত হতে পেরেছে।
ভারত ও চীন দুটি দেশই এপিআই শিল্পে সহজে ও কম সুদে ঋণ দিচ্ছে, গবেষণার জন্য অর্থ দিচ্ছে এবং অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করেছে। চীনে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক কম সুদে ঋণ দেয়। ভারতে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা সহজে অর্থ পায়।
বাংলাদেশের পথ কীপ্রয়াত শ্রদ্ধেয় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য দেশে প্রথম এপিআই তৈরি করে। এখন ক্ষুদ্র পরিসরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গুটিকয় ওষুধের এপিআই তৈরি করছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের দিকে আঙুল না তুলেই বলছি, প্রবল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এপিআই শিল্পের দিকে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের মনোযোগের ঘাটতি ছিল। আজও কম।
প্রথম কাজ হবে, দেশে যাঁরা ওষুধ তৈরি করছেন, তাঁদের কাছে এপিআই সহজলভ্য করা। আমদানি করে নয়, নিজেরা উৎপাদন করে। এ জন্য ট্যাক্স ছাড়, ভর্তুকি বা প্রশাসনিক সুবিধা যা প্রয়োজন, ব্যবসায়ীদের তা দিতে হবে। কতটুকু কী দিতে হবে, তা নিয়ে মুক্তমনে আলোচনা হতে হবে। সরকার প্রথম চার বা পাঁচ বছর সহায়তা অব্যাহত রাখলে এ শিল্প দাঁড়াবেই।
স্বাধীনতার দ্বিতীয় দশকে দেশে ওষুধশিল্প বিকাশের সময় অনেকেই ধারণা করতে পারেননি যে বাংলাদেশ ওষুধের মতো পণ্য রপ্তানি করার সামর্থ্য দেখাতে পারে। কিন্তু পেরেছে। বাংলাদেশ এপিআই রপ্তানিও করতে পারবে। উদাহরণ আছে। চীন ও ভারতের সরকারের মতো বাংলাদেশ সরকারও নীতি সহায়তা ও আর্থিক সুবিধা নিয়ে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াক। এটাই ঠিক সময়।
এস এম সাইফুর রহমান সভাপতি, বাংলাদেশ এপিআই অ্যান্ড ইন্টারমেডিয়েটারিস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র ভর প রথম সরক র আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
অফিসে আপনি কি ১১ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন
প্ল্যান ওয়ান জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা নিয়ে চলছে আলোচনা। সেখানে দুই হাজার ফুলটাইম কর্মজীবীর ওপর একটা জরিপ পরিচালনা করা হয়। পেশাগত কাজ বা চাপের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক নিয়ে পরিচালিত গবেষণাটি থেকে পাওয়া গেছে চমকপ্রদ তথ্য।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, যাঁরা কর্মক্ষেত্রে ১১ ঘণ্টা বা তার বেশি কাজ করেন, তাঁদের খাদ্যাভ্যাস তুলনামূলকভাবে অস্বাস্থ্যকর, তাঁরা অন্যদের তুলনায় মানসিক চাপে ভোগেন বেশি। ঠিকমতো পানি খাওয়ার প্রবণতা কম। পরিবার, প্রকৃতি ও পোষা প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটানোর প্রবণতাও কম। কম ঘুমান। আর যেকোনো মানসিক আঘাত থেকে সেরে ওঠার পর্যাপ্ত সময় বা সুযোগ পান না। এই মানুষেরাই বেশি হতাশায় ভোগেন।
শুধু তা-ই নয়, দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া এবং হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের মতো কার্ডিওভাস্কুলার রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। যাঁরা ১১ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় অফিস করেন, তাঁদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সংখ্যাও অনেক।
আরও পড়ুন২৫ বছর ধরে অফিসে যাননি তিনি১৩ মার্চ ২০২৫যদি ১১ ঘণ্টা কর্মক্ষেত্রে থাকতেই হয়, তাহলে যেসব বিষয় খেয়াল রাখবেনরাতে ৮ ঘণ্টা ঘুমাতেই হবে। তাতে শরীর ও মস্তিষ্ক দিনের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের ধকল কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিরতি নিন। সবুজের দিকে তাকান। ডেস্কে গাছ রাখতে পারেন। উঠে একটু হাঁটুন। ব্যায়াম করুন। সহকর্মীর সঙ্গে চা খেতে খেতে গল্প করুন। গবেষণা জানাচ্ছে, ছোট ছোট বিরতি কাজে মনোযোগ পুনঃস্থাপন করতে সাহায্য করে এবং কাজের গুণমান বাড়ায়।
দুপুরে খাওয়ার পর একটা ন্যাপ নিতে পারেন।
২ লিটারের একটা বোতলে পানি রাখবেন। প্রতিদিন ১ বোতল পানি অবশ্যই শেষ করবেন। তা ছাড়া পানি, শরবত, জুস, ডাবের পানি, তরমুজ, শসা, আনারস ইত্যাদি খাবেন। হাইড্রেটেড থাকলে এনার্জি ধরে রেখে কাজ করা সহজ হয়।
প্রক্রিয়াজাত খাবার, কার্বোনেটেড ড্রিংক, চিনিযুক্ত খাবার বাদ দিন। এসব কেবল আপনার ক্লান্তি বাড়াবে।
আর সম্ভব হলে কর্মক্ষেত্রে কথা বলে আপনার কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টায় নিয়ে আসতে পারলে তো কথাই নেই।
সূত্র: এনবিসি নিউজ
আরও পড়ুনঅফিসের বাড়তি কাজকে যেভাবে ‘না’ বলবেন১৩ মার্চ ২০২৫