জ্ঞানচর্চায় বৃত্তি পেতেন সব ধর্মের মানুষ
Published: 16th, August 2025 GMT
কায়রোর বায়তুল হিকমার একটি কক্ষে মোমবাতির আলোয় একজন শিক্ষার্থী পড়ছেন। তাঁর পাশে একজন খ্রিষ্টান পণ্ডিত, হুনাইন ইবনে ইসহাক (মৃ. ৮৭৩ খ্রি.), গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের একটি পাণ্ডুলিপি আরবিতে অনুবাদ করছেন। এই শিক্ষার্থী একজন মুসলিম, তার পাশেরজন খ্রিষ্টান, দুজনই শিক্ষার জন্য ওয়াক্ফ থেকে ভাতা পান। দৃশ্যটি মুসলিম সভ্যতার শিক্ষাবৃত্তির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে—কেননা, এই সভ্যতা শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, অমুসলিম পণ্ডিতদেরও জ্ঞানচর্চায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে।
এই সিরিজের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে আমরা শিক্ষাবৃত্তির ধর্মীয় ভিত্তি, এর প্রাথমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এবং ওয়াক্ফর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি। এ পর্বে আমরা দেখব, কীভাবে অমুসলিম পণ্ডিতরা ইসলামি শিক্ষাবৃত্তিতে অবদান রেখেছেন, কীভাবে বিজ্ঞান ও দর্শনের মতো বিশেষ ক্ষেত্রে বৃত্তি দেওয়া হতো এবং কীভাবে এই শিক্ষাবৃত্তি ইসলামি সভ্যতার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে।
মুসলিম সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তি ছিল একটি বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা। গ্রন্থাগার ও গবেষণাকেন্দ্রে মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি এমনকি জরথুস্ত্রীয় পণ্ডিতেরা একসঙ্গে কাজ করতেন।শিক্ষাবৃত্তিতে অমুসলিমদের অবদানমুসলিম সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তি ছিল একটি বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা। মৃত্যুর এক বছর আগে আব্বাসীয় খলিফা মামুনের প্রতিষ্ঠিত বাগদাদের বায়তুল হিকমা ছিল (প্রতিষ্ঠিত: ৮৩২ খ্রি.
কর্ডোভা ও কায়রোতে কাজ করা প্রখ্যাত ইহুদি দার্শনিক মাইমোনাইদেস (মৃ. ১২০৪ খ্রি.) ইসলামি শিক্ষাবৃত্তির পরিবেশে উপকৃত হন। তাঁর প্রখ্যাত রচনা গাইড ফর দ্য পারপ্লেক্সডর ওপর মুসলিম দার্শনিক আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার প্রভাব ছিল। তিনি কায়রোর ফাতিমি শাসকদের কাছ থেকে গবেষণার জন্য আর্থিক সহায়তা পেতেন। (ইবনে আল-উসাইবিয়া, উয়ুন আল-আনবা, ২/১২৩, কায়রো: দারুল কুতুব, ১৮৮২)।
অমুসলিম পণ্ডিতদের অবদান ইসলামি শিক্ষাবৃত্তির বৈচিত্র্য ও গভীরতা প্রমাণ করে। তাদের কাজ বিজ্ঞান, দর্শন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলিম সভ্যতাকে বিশ্বের শীর্ষে নিয়ে গেছে। ইমাম জাহাবি বলেন, ‘বাগদাদের জ্ঞানচর্চায় ধর্মের সীমানা ছিল না। যিনিই জ্ঞানী ছিলেন, তিনিই সম্মানিত হতেন।’ (সিয়ার আলাম আল-নুবালা, ১৫/৪৫৬, বৈরুত: মুআসসাসাত আল-রিসালা, ১৯৮৫)
আরও পড়ুনমসজিদে নববি ছিল শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের আশ্রম০৭ আগস্ট ২০২৫বাগদাদের জ্ঞানচর্চায় ধর্মের সীমানা ছিল না। যিনিই জ্ঞানী ছিলেন, তিনিই সম্মানিত হতেন।ইমাম জাহাবি (রহ.), সিয়ার আলাম আল-নুবালা, ১৫/৪৫৬বিজ্ঞান ও দর্শনের জন্য শিক্ষাবৃত্তিইসলামি শিক্ষাবৃত্তি ধর্মীয় বিষয়ের বাইরেও বিস্তৃত ছিল। বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও দর্শনের জন্য বিশেষ বৃত্তি দেওয়া হতো। আল-বিরুনি ছিলেন ভারতের জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের গবেষক। তিনি তাঁর কিতাব আল-হিন্দ লেখার জন্য গজনির শাসক মাহমুদের (মৃ. ১০৩০ খ্রি.) কাছ থেকে প্রতি মাসে ১০০ দিনার বৃত্তি পেতেন। (ইয়াকুত আল-হামাভি, মুজাম আল-উদাবা, ৪/৫৬৭, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৯৩)
এই বৃত্তি তাকে ভারতের সংস্কৃত গ্রন্থ অধ্যয়ন ও আরবিতে অনুবাদ করার সুযোগ করে দিয়েছে।
বাগদাদের শাসক আল-মুকতাদির বিল্লাহ (মৃ. ৯৩২ খ্রি.) একটি জ্যোতির্বিদ্যা পর্যবেক্ষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে জ্যোতির্বিদেরা গবেষণার জন্য বৃত্তি পেতেন। আল-বাত্তানি বৃত্তির সাহায্যে সূর্য ও চাঁদের গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করেন। তার কাজ পরবর্তী সময়ে কোপার্নিকাসের (মৃ. ১৫৪৩ খ্রি.) ওপর প্রভাব ফেলে। (ইবনে আল-উসাইবিয়া, উয়ুন আল-আনবা, ১/২৩৪)
চিকিৎসাবিজ্ঞানেও শিক্ষাবৃত্তি ছিল। ইমাম আল-রাজি বাগদাদের একটি হাসপাতালে গবেষণার জন্য আব্বাসীয় শাসকদের কাছ থেকে বৃত্তি পেতেন। তার গবেষণার জন্য তিনি প্রতিবছর ১ হাজার ৫০০ দিনার পেতেন, যা আজকের হিসাবে প্রায় তিন লাখ মার্কিন ডলার। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১১/১২৩, বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৯৮৮)
ইমাম আল-রাজি বাগদাদের একটি হাসপাতালে গবেষণার জন্য আব্বাসীয় শাসকদের কাছ থেকে প্রতিবছর ১ হাজার ৫০০ দিনার পেতেন, যা আজকের হিসাবে প্রায় তিন লাখ মার্কিন ডলার।এই বৃত্তি তাকে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনে সাহায্য করেছে।
দর্শনের ক্ষেত্রে আল-কিন্দি গ্রিক দর্শনের সঙ্গে ইসলামি চিন্তার সমন্বয় করেন। তিনি খলিফা মুতাসিমের (মৃত্যু ৮৪২ খ্রি.) কাছ থেকে বৃত্তি পেতেন, যা তাকে রিসালা ফি আল-আকল লেখাটা সহজ করেছে। (ইবনে আল-নাদিম, আল-ফিহরিস্ত, পৃ. ২৫৬)
বরং বলা যায়, এইসব বৃত্তি মুসলিম সভ্যতাকে বিজ্ঞান ও দর্শনের ক্ষেত্রে অগ্রগামী করে দিয়েছে।
আরও পড়ুনযেভাবে গড়ল ইসলামি জ্ঞানচর্চার অর্থনৈতিক ভিত্তি১০ আগস্ট ২০২৫ইসলামি শিক্ষাবৃত্তির উত্তরাধিকারইসলামি শিক্ষাবৃত্তির প্রভাব শুধু মধ্যযুগে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি আধুনিক বিশ্বের জ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতিতেও অবদান রেখেছে। নিজামিয়া মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার একটি সংগঠিত মডেল প্রতিষ্ঠা করেছে, যা ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (যেমন বোলোনিয়া, ১০৮৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠায় পথ দেখিয়েছে। ইতিহাসবিদ জর্জ মাকদিসি বলেন, ‘ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাবৃত্তি ব্যবস্থা নিজামিয়া মাদ্রাসার দ্বারা প্রভাবিত ছিল।’ (দ্য রাইজ অব কলেজেস, পৃ. ১৫৫, এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮১)
ইসলামি শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে অনূদিত গ্রিক ও পার্সি গ্রন্থগুলো ইউরোপে রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে। ইবনে রুশদের লেখা এরিস্টটলের ভাষ্য ইউরোপে লাতিনে অনুবাদ করা হলে তা টমাস অ্যাকুইনাসের (মৃ. ১২৭৪ খ্রি.) মতো দার্শনিকদের প্রভাবিত করেছে। (ইবন আল-উসাইবিয়া, উয়ুন আল-আনবা, ২/৪৫৬)
ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাবৃত্তি ব্যবস্থা নিজামিয়া মাদ্রাসার দ্বারা প্রভাবিত ছিল।ইতিহাসবিদ জর্জ মাকদিসি, দ্য রাইজ অব কলেজেস, পৃ. ১৫৫ইবনে সিনার কানুন ফি আত-তিব সতেরো শতক পর্যন্ত ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হতো। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া, খণ্ড ১২, পৃ. ১২৩)।
ইসলামি শিক্ষাবৃত্তির মধ্য দিয়ে সামাজিক ন্যায়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে শিক্ষা ও ভাতার ব্যবস্থা আধুনিক শিক্ষাবৃত্তিব্যবস্থাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। ইতিহাসবিদ ফ্রান্সিস রবিনসন বলেন, ‘ইসলামি শিক্ষাবৃত্তি ছিল এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে সম্পদের ওপর প্রাধান্য পেত যোগ্যতা।’ (দ্য মাদ্রাসাজ অব দ্য অটোমান এম্পায়ার, পৃ. ৪৫, রাউটলেজ, লন্ডন, ২০০৪)।
ইসলামি শিক্ষাবৃত্তি ছিল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈচিত্র্যময় ব্যবস্থা, যেখানে অমুসলিম পণ্ডিতেরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিজ্ঞান ও দর্শনের জন্য বিশেষ বৃত্তি মুসলিম সভ্যতাকে জ্ঞানের শীর্ষে নিয়ে যায়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রেনেসাঁ থেকে আধুনিক শিক্ষাবৃত্তি পর্যন্ত বিস্তৃত।
আরও পড়ুনশরণার্থীদের জন্য মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা০৫ আগস্ট ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ঞ নচর চ র জন য ব দ র জন য ব যবস থ গ রন থ র একট ইউর প অবদ ন ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
আজ মুক্তি পাচ্ছে নতুন দুই সিনেমা, হলে আছে আরও ৭ সিনেমা
কুয়াকাটায় একদল ব্যাচেলর
করোনার সময় দীর্ঘদিন ঘরবন্দী ছিল মানুষ। বিধিনিষেধ শিথিল করা হলে কুয়াকাটায় ঘুরতে যায় একদল ব্যাচেলর। সেখানে নারীদের একটি দলের সঙ্গে তাদের দেখা হয়ে যায়। তাদের কেন্দ্র করেই রোমান্টিক, কমেডি ও থ্রিলারের মিশেলে তৈরি হয়েছে নাসিম সাহনিকের ‘ব্যাচেলর ইন ট্রিপ।’
সিনেমাটির শুটিং শুরু হয় ২০২২ সালের শেষ দিকে। প্রথম লটে এক সপ্তাহের মতো শুটিং করার কথা থাকলেও বাজেটের সমস্যায় দুই দিন পর শুটিং টিমকে রেখেই ঢাকায় চলে গেছেন পরিচালক—এমন একটা অভিযোগ সে সময় এনেছিলেন সিনেমার নায়িকা শিরিন শিলা। পরে তিনি আরও জানান, নায়ক-নায়িকাসহ শিল্পীদের থাকা, খাওয়া—সবকিছুতেই অব্যবস্থাপনা ছিল। এতে ইউনিটে অসন্তোষ তৈরি হয়। সে সময় কলাকুশলীরা ধরেই নিয়েছিলেন, এ সিনেমার শুটিং আর হবে না। দ্বন্দ্ব মিটিয়ে পরের বছর শেষ হয় শুটিং। ডাবিং ও পোস্টের কাজ শেষ করতে লেগে যায় আরও এক বছর।
সিনেমায় জুটি হয়েছেন শিরিন শিলা ও কায়েস আরজু। ছবি: কায়েসের সৌজন্যে