জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের (জাকসু) ১৯৯০, ১৯৯১ ও ১৯৯২ সালের শেষ তিনটি নির্বাচনে ছাত্রদলের একচেটিয়া জয় ছিল। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর আয়োজিত জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের সেই অতীত ঐতিহ্য ফিরে আসবে, এমন প্রত্যাশা করেছিলেন কর্মী–সমর্থকেরা। তবে সাংগঠনিক দুর্বলতাসহ নানা কারণে শেষ পর্যন্ত জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল মনোনীত প্যানেলের ভরাডুবি হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত দশম জাকসু নির্বাচনে ২৫টি পদের একটি পদেও জিতে আসতে পারেননি ছাত্রদলের প্রার্থীরা। সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ২৪টি পদে ছাত্রদল মনোনীত প্রার্থীরা চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান অর্জন করেছেন। শুধু স্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তা–বিষয়ক সম্পাদক পদের প্রার্থী মমিনুল ইসলাম দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন। যদিও ভোট গ্রহণের শেষ দিকে কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করে ছাত্রদলের প্যানেল।

জাকসুতে ছাত্রদলের ভরাডুবির কারণ জানতে সংগঠনের বর্তমান, সাবেক নেতা–কর্মী ও কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের বেশির ভাগ জানিয়েছেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকা, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, প্রতিপক্ষের প্রচারণা প্রতিহতে কৌশলী না হওয়া, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ট্যাগিং ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির নেতিবাচক কর্মকাণ্ড ভোটারদের মনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে।

শুরু থেকেই গা ছাড়া ভাব

গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই জাকসু নির্বাচনের দাবি তোলেন শিক্ষার্থীরা। ওই সময় ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। একই সময়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের সাবেক শিক্ষার্থীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলার রেশ না কাটতেই বর্তমান শিক্ষার্থীদের থেকে ১৪ বছরের জ্যেষ্ঠ (৩৯ ব্যাচ) দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে ছাত্রদল। এরপর যতবার প্রশাসন থেকে জাকসু নির্বাচনের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হয়, ততবার পরোক্ষভাবে নির্বাচন পেছানোর দাবি জানায় ছাত্রদল। ফলে তিন দফায় জাকসু নির্বাচন পেছায় প্রশাসন।

নেতা–কর্মীরা বলছেন, ছাত্রদলের মধ্যে মনোভাব ছিল জাকসু নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হবে না। ফলে সংগঠনটির মধ্য থেকে কোনো নেতা-কর্মীকে আগে থেকে জাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রস্তুত করা হয়নি। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, ছাত্রশিবিরসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আগে থেকেই শীর্ষ পদে কারা প্রার্থী হবেন, সেই প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পাশাপাশি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে দেখা যায়।

কোন্দলে ব্যস্ত ছিল ছাত্রদল
জাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ৮ আগস্ট ১৭টি আবাসিক হলে হল কমিটি ও শাখা ছাত্রদলের কমিটি বর্ধিত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। ওই দিন রাতেই ছাত্রদলের হল কমিটি দেওয়ায় সংবাদ সম্মেলন করে নিন্দা জানায় গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ। ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ একটি দল হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়। একই সময়ে ছাত্রদলের একটি অংশ ঘোষিত কমিটিতে ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন বিতর্কিত ব্যক্তি পদ পেয়েছেন দাবি করে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। তারপর টানা ৯ দিন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারেননি শাখা ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা।

এর মধ্যে ১০ আগস্ট জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিলের পর অন্যান্য সংগঠন যখন প্যানেল গোছাতে তোড়জোড় শুরু করে, তখন ছাত্রদল ছিল অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে। ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা নিয়মিত ক্যাম্পাসে মোটরসাইকেল মহড়া দিতেন। শেষ পর্যায়ে ১৮ আগস্ট তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে ক্যাম্পাসে আসেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরসহ শীর্ষ কয়েকজন নেতা। ওই দিন ও পরের দিন দুই পক্ষ কয়েক দফায় হাতাহাতিতে জড়ালে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকে যেটার প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। জাকসু নির্বাচনে এসব কর্মকাণ্ডের প্রভাব বেশি পড়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

পুরোনো ধারাতেই চলছিল রাজনীতি
গত ১৫ বছর ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। সে সময় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ‘শিবির’, ‘জঙ্গি’ ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে মারধরের অভিযোগ রয়েছে। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘ট্যাগিং সংস্কৃতির’ বিলোপ চেয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। তবে ছাত্রদলের বিপক্ষে কেউ লেখালেখি করলে কিংবা প্রতিবাদ জানালে নেতা–কর্মীরা আগের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের ট্যাগিং শুরু করেন।

জাকসু নির্বাচনের আগে শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে হেপাটাইটিস বি টিকাদান কর্মসূচি শুরু করে ছাত্রদল। তবে ওই টিকা কার্যক্রমে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে সংবাদ প্রচার করেন এক সাংবাদিক। এরপর সাংবাদিককে মামলার হুমকিসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। তাঁকে শিবির ট্যাগিংও দেওয়া হয়। এ ছাড়া ছাত্রদলের কর্মকাণ্ডে সমালোচনা করে কোনো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেও শিবির আখ্যায়িত করতে দেখা গেছে তাঁদের। সর্বশেষ জাকসু নির্বাচনের আগে বেসরকারি একটি টেলিভিশনের টক শোতে সম্ভাব্য ভিপি প্রার্থীদের একটি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে ছাত্রদলের সম্ভাব্য ভিপি প্রার্থী হামিদুল্লাহ সালমান মন্তব্য করেন, সাধারণ শিক্ষার্থী যাঁরা হলে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ চান, তাঁরা সব শিবির। এটার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ক্যাম্পাসে। শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ মো.

ফয়সালও বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনকে শিবির আখ্যা দেন। যাতে শিক্ষার্থীদের মনে ছাত্রদল সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়।

গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি-ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সামনে আসতে থাকে। যার সুযোগ নেয় প্রতিপক্ষ সংগঠনগুলো। দেশের যেকোনো প্রান্তে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে কোনো বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ানোর অভিযোগ উঠলেই ছাত্রশিবির বা অন্যান্য সংগঠনের কর্মী–সমর্থকেরা সেসব ফেসবুকে ফলাও করে প্রচারণা করতেন। প্রতিপক্ষরা ‘ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ’ হিসেবে প্রচারণা চালান। এসব প্রচারণা মোকাবিলা করতে ছাত্রদলের কোনো কৌশল ছিল না।

আরও পড়ুনজাকসু নির্বাচনে শিবিরের জয়ের প্রধান নিয়ামক ইতিবাচক ভাবমূর্তি, আছে আরও অনেক কারণ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫প্যানেল গোছাতেও ‘অনৈক্য’জাকসু নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন ছাত্রীরা। গত বৃহস্পতিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেসা হলে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ছ ত রদল র স র জন ত আগস ট স গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

জকসুতে এআই ব্যবহারে থাকবে শিথিলতা, তবে অপব্যবহার করা যাবে না: নির্বাচন কমিশন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহারে শিথিলতা থাকবে। তবে এর অপব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য জুলফিকার মাহমুদ।

রোববার উপাচার্যের সভাকক্ষে রাজনৈতিক ও সক্রিয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত জকসু ও হল সংসদ নির্বাচন-২০২৫-এর আচরণবিধিবিষয়ক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।

ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক ফয়সাল মুরাদের এক দাবির জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। এর আগে ফয়সাল মুরাদ বলেন, ‘নির্বাচনী আচরণবিধির ৭–এর ঘ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করা যাবে না। আমরা যারা ছোট সংগঠন, আমাদের তহবিল সীমিত। আমরা নির্বাচনী প্রচারের জন্য এআই ব্যবহার করে দু-এক মিনিটের ভিডিও বানিয়ে প্রচার কার্যক্রম চালাতে চাই। আমাদের দাবি, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যেন শিথিল নীতি গ্রহণ করে।’

মুরাদ আরও বলেন, বিগত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কিছু ত্রুটি লক্ষ করা গেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনকে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত রাখার জন্য যতগুলো ভোটকক্ষ থাকবে, সব কটি সিসিটিভি ফুটেজের আওতায় রাখতে হবে। সবার জন্য সেই সিসিটিভি ফুটেজ উন্মুক্ত রাখতে হবে। ভোট গ্রহণকে স্বচ্ছ রাখার জন্য ভোটকক্ষের ভেতরে জাতীয় গণমাধ্যমকে সরাসরি সম্প্রচার করার অনুমতি দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জকসুর নির্বাচন কমিশনার জুলফিকার মাহমুদ বলেন, ‘এআই ব্যবহার করে বিভিন্নজনের চরিত্র হনন করা হয়, অপপ্রচার চালানো হয়। সেদিক থেকে চিন্তা করে এআই ব্যবহার নিষিদ্ধ রেখেছিলাম। তোমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এআই ব্যবহারে শিথিলতা থাকবে প্রচার–প্রসারে, তবে অপব্যবহার করা যাবে না। আর সরাসরি সম্প্রচারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আলোচনা করে।’

প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোস্তফা হাসানের সভাপতিত্বে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য রেজাউল করিম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ ও হল শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন ২০২৫–এর নির্বাচন কমিশনার ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ