যৌতুকের জন্য জখম: ভুক্তভোগী নারীর জন্য বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা তুলে দিতে হবে
Published: 17th, September 2025 GMT
যৌতুকের মতো অপরাধের ঘটনায় মামলার আগেই ভুক্তভোগী নারীকে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতায় যেতে বাধ্য করা গ্রহণযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে যৌতুকের কারণে নির্যাতনে সাধারণ জখমের শিকার হওয়া নারীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার বাধাগ্রস্ত হবে। এ অভিমত দিয়ে সরকারকে দ্রুত এ ধরনের বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা তুলে নিতে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন একটি মতবিনিময় সভার বক্তারা।
আজ বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এ সভার আয়োজন করে। ‘যৌতুক দাবি, যৌতুকের কারণে সাধারণ জখমের শিকার নারীদের মামলার আগে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার বিধান’ শিরোনামে মতবিনিময় সভাটি অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কার্যালয়ের সুফিয়া কামাল ভবনের আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে।
মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেন, প্রয়োজনে এটাকে ঐচ্ছিক করা যেতে পারে। যাতে ভুক্তভোগী নারী নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তিনি আপসে যাবেন, নাকি সরাসরি মামলা করবেন। তা না হলে লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার কাছে গিয়ে মধ্যস্থতার হাজার হাজার ঘটনায় জেলা পর্যায়ে বিচারব্যবস্থা ধসে পড়তে পারে।
সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম। তাতে বলা হয়, সার্বিক দিক বিবেচনা করে যৌতুক দাবি ও যৌতুকের কারণে সাধারণ জখমের শিকার নারীদের মামলা রুজু করার আগে বাধ্যতামূলক মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার বিধানটি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। যদিও সরকার মনে করছে, মামলার জট কমানোর জন্য মামলা করার আগে অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের মধ্যে মধ্যস্থতা করে মামলার জট কমানো সম্ভব হবে। তবে অভিজ্ঞতা বলে, এতে মামলার দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তা ছাড়া যৌতুকের কারণে সাধারণ জখম হলেও মেডিকেল রিপোর্ট প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে সমঝোতার সুযোগে সাধারণ জখমের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, ফলে পরবর্তী সময়ে মামলা প্রমাণে আইনগত জটিলতার সৃষ্টি হবে।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যৌতুকের কারণে সাধারণ জখমের ১১(গ) ধারায় মিথ্যা মামলা হয়, এটা ঠিক। তাই বলে অপপ্রয়োগ ঠেকাতে সত্যিকারের ভুক্তভোগীকে হয়রানি করা যাবে না। সহিংসতার শিকার নারীকে জোর করে সমঝোতায় নেওয়া যাবে না। এটা মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। তিনি বলেন, ‘বাধ্যতামূলক’ শব্দ ব্যবহারের বিরুদ্ধে অধিকারকর্মীরা আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারেন। কারণ, এই বাধ্যবাধকতা একজন নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যন্ত করবে। আপস সম্ভব না হলে একধরনের সামাজিক কলঙ্ক মাথায় নিয়ে তাঁকে আদালতে যেতে হবে। প্রতি জেলায় কমপক্ষে সাত–আটটি পারিবারিক আদালত এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এখানে যাঁরা মামলা করতেন, তাঁদের সবাইকে এখন যেতে হবে লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে।
সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইন বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ফউজুল আজিম বলেন, পারিবারিক আদালত, যৌতুকসহ ৯টি ক্ষেত্রে মামলা করার আগে মধ্যস্থতার জন্য লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার কাছে যেতে হবে। এতে করে আগামী এক মাসের মধ্যে জেলার বিচারব্যবস্থা ধসে পড়বে। হাজার হাজার মামলার চাপ পড়বে। ভুক্তভোগীদের দরখাস্তের বিপরীতে কতজনকে সমন পাঠাবেন লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ১১(গ) ধারায় মামলার অপব্যবহার হয়, সেটা অন্য জিনিস। কিন্তু যেসব মামলা প্রকৃত, সেসব কেন যথাযথভাবে শনাক্ত হবে না। কেন ওই নারীকে আপসে যেতে বলা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন’ সংশোধন করে মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করে গত ১ জুলাই অধ্যাদেশ জারি করে। ‘আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ অধ্যাদেশ অনুসারে, যৌতুকের ক্ষেত্রে সাধারণ জখমের মামলায় প্রথমে ভুক্তভোগী নারীকে লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করতে হবে। মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে কোনো পক্ষ প্রয়োজনে আদালতে মামলা করতে পারবে। সংশোধিত অধ্যাদেশের ২১ (খ) ধারা ৯টি আইনের সুনির্দিষ্ট কিছু ধারার ওপর প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১১ (গ) ধারা এবং যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮-এর ৩ ও ৪ ধারা, পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩–এর ৫ ধারা ইত্যাদি। ১৫ সেপ্টেম্বর সরকারের গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা ১২টি জেলায় কার্যকর হয়েছে। জেলাগুলো হলো ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাঙামাটি, সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ।
বিষয়টি নিয়ে আজকের মতবিনিময় সভায় অনলাইনে যুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন। তিনি বলেন, সহিংসতার শিকার নারীর জন্য ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল, তিনি পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনে যাবেন, নাকি ১১( গ) ধারায় মামলা করবেন। বাধ্যতামূলক করে তাঁর ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার সংকট রয়েছে। এতসংখ্যক মধ্যস্থতা করার সক্ষমতা তাদের আছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। গোড়াটা চিন্তা না করে ওপর থেকে আইন সংশোধন চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার হতে হবে।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর অধিকারের ক্ষেত্রগুলো এখন সবদিক দিয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এই অধ্যাদেশ সেটাকে আরও সংকুচিত করে দিল। এটা নারীর মানবাধিকারের মৌলিক জায়গা নস্যাৎ করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, দীর্ঘদিন লড়াই করে যৌতুকের শিকার নারীদের সুবিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য আইন করা গিয়েছিল। অধ্যাদেশের মাধ্যমে এখন সেই অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।
মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহার সঞ্চালনায় সভায় আইনজীবীদের মধ্যে বক্তব্য দেন এস এ এ সবুর, জাহিদুল বারী, এ কে রাশেদুল হক এবং অমিত দাশগুপ্ত। বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন ব্র্যাকের মিতালী জাহান, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সুরাইয়া জামান, নারীপক্ষের ফেরদৌসী আক্তার, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের সেলিনা পারভীন এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের শিল্পী সাহা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল গ য ল এইড ক ব যবস থ র জন য র বক ত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শ্রীবরদীতে ভারতীয় জিরা নিয়ে তুলকালাম
শেরপুরের শ্রীবরদী সীমান্তে ১৬ বস্তা ভারতীয় চোরাই জিরা ও কাপড় আটক করেছেন স্থানীয়রা। পরে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী একটি মহল আত্মসাতের উদ্দেশ্যে সেসব জিরা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে অন্য একটি পক্ষ আবার সেই জিরা আটক করে। এ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাত ৯টার দিকে উপজেলার ভায়াডাঙ্গা বাজারে এ ঘটনা ঘটে।
পরবর্তীতে হাসধরা এলাকায় দ্বিতীয়বার আটক হয়। এসময় স্থানীয়রা বেশকিছু বস্তা জিরা লুট করে নিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা পুলিশ ও বিজিবিকে খবর দিলে তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে মালামাল উদ্ধার করে তাওয়াকুচা বিজিবি ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানান, রাত ৯টার দিকে ভারতীয় চোরাই জিরা ও কাপড় বোঝাই একটি ট্রলি ঝিনাইগাতী থেকে ভায়াডাঙ্গা বাজার দিয়ে শ্রীবরদী হয়ে শেরপুরের দিকে যাচ্ছিলো। স্থানীয়রা বিষয়টি টের পেয়ে ট্রলিটি আটক করে। এসময় ট্রলি চালক কৌশলে পালিয়ে যায়।
সেসময় স্থানীয় অপর একটি পক্ষ সুকৌশলে আরেক চালককে দিয়ে ট্রলিটি সরিয়ে নিয়ে যায়। ঘটনা জানাজানি হওয়ার সাথে সাথে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে হাসধরা এলাকায় ট্রলিটি আবার আটক হয়। এসময় প্রায় অর্ধেক মালামাল লুট করে এক পক্ষ।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইমন আকন্দ বলেন, “আমরা ভায়াডাঙ্গা বাজারে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। পরবর্তীতে স্থানীয় কয়েকজন নেতা নতুন করে অন্য ড্রাইভার দিয়ে ট্রলি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। আমরা অবৈধ পাচার হওয়া মালামাল জব্দ হোক এটাই চাই। এছাড়াও যারা মালামাল লুট করেছে এবং এই পাচারের সাথে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি করছি।”
এ ব্যাপারে শ্রীবরদী তাওয়াকুচা বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডার নায়েব সুবেদার আতিয়ার রহমান বলেন, “আমরা স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে গিয়ে ১৬ বস্তা অবৈধ মালামাল জব্দ করেছি। এই ব্যাপারে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা চলমান আছে।”
শ্রীবরদী থানার উপ-পরিদর্শক সুলতান আহমেদ বলেন, “আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার পূর্বেই বিজিবি মালামাল জব্দ করেছে। এই ব্যাপারে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।”
ঢাকা/তারিকুল/এস