জলবায়ু পরিবর্তনে বদলাচ্ছে রোগের চিত্র, বাড়ছে বিরল সংক্রমণ
Published: 18th, September 2025 GMT
ভারতের কেরালায় চলতি বছর ৭০ জনের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন প্রাণঘাতী ‘মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবাতে’। এরমধ্যে ১৯ জন মারা গেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু কেরালার নয় বরং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে রোগের মানচিত্র বদলাচ্ছে এবং আগে বিরল হিসেবে পরিচিত সংক্রমণগুলোও ক্রমেই সাধারণ মানুষকে হুমকিতে ফেলছে। উষ্ণ পানির উপস্থিতি, দীর্ঘ গ্রীষ্মকাল এবং পানিদূষণ এই ঝুঁকিকে আরো বাড়াচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ রোগ এতটাই বিরল যে অনেক চিকিৎসক তাদের পুরো কর্মজীবনে একটি কেসও দেখেন না। অথচ মাত্র এক বছরেই শুধু কেরালাতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭০ জনের বেশি মানুষ।
কেরালা অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে আনন্দময় উৎসব ওনামের প্রাক্কালে ৪৫ বছর বয়সী শোভনা হঠাৎ কাঁপতে কাঁপতে অচেতন হয়ে পড়েন। দলিত সম্প্রদায়ের এই নারী জীবিকা নির্বাহ করতেন ফলের রস বোতলজাত করে। কয়েকদিন আগে মাথা ঘোরা ও উচ্চ রক্তচাপের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেও ওষুধ নেওয়ার পর কিছুটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল তাকে। কিন্তু হঠাৎ করেই জ্বর ও কাঁপুনি দেখা দেয়, যা দ্রুত প্রাণঘাতী রূপ নেয়। ৫ সেপ্টেম্বর ওনামের মূল অনুষ্ঠানের দিনেই তার মৃত্যু হয়।
আরো পড়ুন:
শেরপুরে পুলিশের উপর হামলা: থানায় মামলা, গ্রেপ্তার ৪
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
পরিবারের সদস্য ও সমাজকর্মী অজিথা কাথিরাদাথ বলেন, “আমরা একেবারেই অসহায় ছিলাম। শোভনার মৃত্যু হওয়ার পরেই রোগটি সম্পর্কে জানতে পারি।”
কীভাবে সংক্রমণ ছড়ায়
এই এককোষী জীব সাধারণত উষ্ণ মিষ্টি পানিতে থাকে এবং ব্যাকটেরিয়া খেয়ে বেঁচে থাকে। সাঁতার বা গোসল করার সময় নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে এটি প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিস নামক মারাত্মক সংক্রমণ ঘটায়। এতে মস্তিষ্কের টিস্যু দ্রুত ধ্বংস হয়।
কেরালায় প্রথম এ রোগ শনাক্ত হয় ২০১৬ সালে। তখন বছরে এক বা দুটি কেস ধরা পড়ত এবং প্রায় সবগুলোরই মৃত্যু ঘটত। বিশ্বব্যাপী ১৯৬২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪৮৮টি কেস রিপোর্ট হয়েছে—প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ায়। আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৯৫ শতাংশ।
ভারত সরকারের পদক্ষেপ
পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেরালার জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। আগস্টের শেষ দিকে ২৭ লাখ কূপে ক্লোরিন দেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় পুকুরের চারপাশে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছে। সুইমিং পুল ও পানির ট্যাংক নিয়মিত ক্লোরিনেশনের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
তবে স্থানীয় কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, বাস্তবে প্রতিটি গ্রামীণ পানির উৎসে এমন ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব নয়। পুকুরে ক্লোরিন দিলে মাছ মারা যায়, আর কোটি মানুষের অঙ্গরাজ্যের প্রতিটি পানির উৎসে নজরদারি করাও অকার্যকর হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সচেতনতা তৈরিই এখন মূল লক্ষ্য।
জনগণের জন্য সতর্কতা
স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ পরিবারগুলোকে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো হলো—পানির ট্যাংক ও সুইমিং পুল নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে, নাক ধোয়ার সময় পরিষ্কার উষ্ণ পানি ব্যবহার করতে, শিশুদের বাগানের স্প্রিংকলার থেকে দূরে রাখতে, অনিরাপদ পুকুরে সাঁতার বা গোসল এড়িয়ে চলতে, সাঁতারুদের নাক রক্ষার জন্য নাকের প্লাগ ব্যবহার করা, মাথা পানির ওপরে রাখা এবং অপরিশোধিত পানিতে তলদেশ নাড়াচাড়া না করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডেনিস কাইল বলেন, “এটি একটি জটিল সমস্যা। কোনো কোনো জায়গায় সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড থাকলেও অধিকাংশ পানির উৎসে ঝুঁকি থেকেই যায়। তবে সুইমিং পুল বা কৃত্রিম জলাশয়ের মতো নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সঠিকভাবে ক্লোরিনেশন মনিটরিং করলে ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।”
অন্যদিকে কেরালার অধ্যাপক অনীশ জানান, জলবায়ু পরিবর্তন এই ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তার ভাষায়, “মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিই কেরালার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় অ্যামিবার বিস্তার ঘটাতে পারে। উপরন্তু পানিদূষণ ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বাড়ায়, যা অ্যামিবার খাদ্য।”
চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা
অধ্যাপক ডেনিস কাইল সতর্ক করে বলেছেন, “অতীতে অনেক কেস হয়তো শনাক্তই হয়নি। আর যেগুলো শনাক্ত হয়েছে, সেখানে ব্যবহৃত ওষুধের সমন্বয় এখনো অপর্যাপ্ত।”
তিনি বলেন, “যে অল্প সংখ্যক রোগী বেঁচে যান, তাদের চিকিৎসা পদ্ধতিই পরবর্তীতে মানদণ্ডে পরিণত হয়। কিন্তু আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য নেই যে সব ওষুধ আসলে কার্যকর কি না, বা সবগুলো একসঙ্গে প্রয়োজনীয় কি না।”
কেরালা কিছু রোগী শনাক্ত করতে ও প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হলেও এর শিক্ষা কেবল স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন রোগের মানচিত্র নতুন করে আঁকছে। তাই সবচেয়ে বিরল জীবাণুগুলোও হয়তো আর খুব বেশি দিন বিরল থাকবে না।
ঢাকা/ইভা
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জলব য জলব য় সতর ক
এছাড়াও পড়ুন:
‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ায় রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার তীব্র সমালোচনা
‘আমার সোনার বাংলা...’ গাওয়ায় রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার নির্দেশ দিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। রাজ্যের এক সিনিয়র কংগ্রেস নেতার বিরুদ্ধে এই মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় তীব্র সমালোচনা করেছেন রবীন্দ্রপ্রেমীরা। রবিবার আসমের এই ঘটনার প্রতিবাদে পথে নেমেছে বিশ্বভারতীর এসএফআই ইউনিটের সদস্যরা।
গত সোমবার আসামের শ্রীভূমি জেলার ইন্দিরা ভবনে কংগ্রেস সেবা দলের বৈঠকের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি গেয়েছিলেন বিধুভূষণ দাস নামে এক সিনিয়র কংগ্রেস কর্মী। এরপরই বিতর্ক ছড়ায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বিভিন্ন সময় গেয়েছেন প্রখ্যাত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র, মান্না দে, শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লোপামুদ্রা মিত্র, নচিকেতাসহ আরো অনেক প্রথিতযশা শিল্পীরা। কিন্তু সেই গান নিয়েই এত বিতর্ক মেনে নিতে পারছেন না শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক, শিক্ষার্থী থেকে বিদ্বজনেরা।
রাজ্যটির বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে সিনিয়র আশ্রমিকেরা বলছেন এ তো একেবারে ‘হাস্যকর’! রবি ঠাকুরের পরিবারের সদস্য সুপ্রিয় ঠাকুরের প্রশ্ন ‘আমরাও কি তাহলে রাষ্ট্রদ্রোহী?’
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের ‘বঙ্গভঙ্গ’ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। এর প্রতিবাদে রাখিবন্ধন করে পথে নেমেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই সময় ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনা করেছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এই গানটিকে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ হিসাবে গ্রহণ করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের সদস্য সুপ্রিয় ঠাকুর বলেন, “এক্কেবারে হাস্যকর ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের গান সবার জন্যই, সবাই গেয়ে থাকেন। আমরাও এখনো গেয়ে থাকি। এটা যদি দেশদ্রোহীতা হয়, তাহলে আমরা দেশদ্রোহী। একজন মুখ্যমন্ত্রী (হিমন্ত বিশ্ব শর্মা) যদি এধরনের কথা বলেন, তাকে তাহলে ‘মুখ্য’ বলা যাবে না, অন্য কিছু বলতে হবে।”
বিশ্বভারতীর পাঠভবনের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ও সিনিয়র আশ্রমিক সুব্রত সেন মজুমদার বলেন, “ব্যাপারটা আমার কাছে অত্যন্ত হাস্যকর ও লঘু মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববন্দিত, তাই তার গান সব জায়গায় গাওয়া যায়। কিন্তু, একথা স্বীকার করি ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত এবং তারা গুরুদেবের এই গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করেছেন বলে আমরা সম্মান করি। এই গান কোথাও গাওয়া যাবে না এমন বিধিনিষেধ থাকা ভালো নয়। এটা অত্যন্ত ছোট মনের পরিচয়। তাই এই ধরনের ঘটনা দেখে আমরা অত্যন্ত মর্মাহত। তাদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে তারা যেন আকাশের মত মন নিয়ে বিষয়গুলি দেখেন। মুখ্যমন্ত্রীকে সবাইকে নিয়ে রাজ্য চালাতে হয়, তাই তার অনেক উদার হওয়া উচিত।”
আরেক সিনিয়র আশ্রমিক অপর্ণা দাস মহাপাত্র বলেন, “জিনিসটা খুব হাস্যকর। রবীন্দ্র সঙ্গীত যে কোনো জায়গায়, যে কোনো পরিস্থিতিতে গাওয়া যায়। তার সঙ্গে দেশদ্রোহীতার সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়া অত্যন্ত হাস্যকর। ‘আমার সোনার বাংলা’ এত সুন্দর একটি গান, যা যে-কোন উপযুক্ত পরিস্থিতিতেই গাওয়া যায়। আসামের মুখ্যমন্ত্রীর যদি এইটুকু জ্ঞান না থাকে বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা না থাকে সেটা আমাদের কাছে খুব দুঃখের।”
আশ্রমিক সুলগ্না মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমার সোনার বাংলা গানটি একটা জাতীয় সঙ্গীতের ঊর্ধ্বে গিয়ে এটা রবীন্দ্র সঙ্গীত। আর কি বলবো, কিছু বলারই নেই।”
আসামের ঘটনার নিন্দায় সরব হয়েছে বিশ্বভারতীর বাম ছাত্র সংগঠন ‘স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া’ (এসএফআই)। তাদের সদস্যরাও পথে নেমে স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন।
আসমের এই ঘটনার প্রতিবাদে রবিবার পথে নেমেছে বিশ্বভারতীর এসএফআই ইউনিটের সদস্যরা। এসএফআই ইউনিটের সম্পাদক বান্ধুলি কারার বলেন, “আমরা একটা বড় সমস্যার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। রবীন্দ্রনাথের লেখা গান গাওয়ায় আসামে একজনের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে। এই গানটা শুধু একটা দেশের জাতীয় সংগীত নয়। এই গানটা মাটির গান, ভালোভাসার গান, মানবতার গান, একতার গান। এই গান গাওয়ায় যারা রাষ্ট্রদ্রোহী বলছেন, আসলে তারা মানবতাবিরোধী। রবীন্দ্রনাথের গান, তার লেখা, তার মুক্ত চিন্তা এগুলো বাঙালির চেতনার একটা অংশ। রবীন্দ্রনাথকে যদি অপমান করা হয় তার অর্থ বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতির অপমান করা। রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা নন, তিনি আমাদের বাংলার গর্ব, ভারতের গর্ব। যারা বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতে চাইছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ চলবে।”
সুচরিতা/শাহেদ